\ শেষ \
তাই মাহে রমযানের আগমনে যেন মন ও মননে উদ্বেলিত হতে থাকে আনন্দের দোলা। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে জারির আল তাবারি রহ. (৮৩৮-৯২৩ খৃ.) তাঁর তাফসিরে উল্লেখ করেন, ‘‘আনন্দের উপকরণ হল আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ কোরআন, ইসলামের ফরজ বিধি-বিধান, ও আনুষঙ্গিক সম্পূরক বিষয় সমূহ-যার অন্যতম হলো সিয়াম। (জামিউল বায়ান ফি তাওইলিল কুরআন, খন্ড : ৬, পৃষ্ঠা : ৫৬৮)। অনেকেই মনে করেন, রমযান কষ্টের মাস তাতে আবার আনন্দ কী? আসলে মুমিন বান্দাতো তারাই যারা আল্লাহর হুকুম পালন করে আনন্দিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘আপনি বলুন, আল্লাহর ফযল ও করুণায় এই হয়েছে (আল্লাহর পক্ষ থেকে উপদেশ বাণী এসেছে)। এর মাধ্যমেই তারা যেন আনন্দিত হয় (সন্তুষ্ট থাকে)। তারা যা সঞ্চয় করে, সে তুলনায় তা উত্তম।’’ (সূরা ইউনুস : ৫৮)। আল্লাহ তা’আলা কারুন গোত্রের প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, ‘‘তুমি আনন্দিত হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা (অনৈতিক উপায়ে) আনন্দিতদের পছন্দ করেন না।’’ (সূরা কাসাস : ৭৬)।
রোযা শুরুর আগেই তারাবিহের ইমাম নির্ধারণ করে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় মুসল্লিগণ অতি দ্রুতগতি সম্পন্ন তিলাওয়াতকারী ইমাম সাহেবকে পছন্দ করেন বেশি। যিনি যত তাড়াতাড়ি নামায শেষ করেন তিনি তত ভাল ইমাম এবং সেই মসজিদে মুসল্লিদের জায়গা দিতেই কর্তৃপক্ষ হিমশিম খান। না, এরকম দৃষ্টিভঙ্গি তাকওয়ার খেলাপ শুধু নয়, তাতে নামায অশুদ্ধ হয়ে যাবার ভয় রয়েছে। তাই বিশ্রামের সাথে ধীর স্থির ভাবে নামায আদায়ের মনোভাব আগে থেকেই তৈরি করে নিতে হবে। রোযা দীর্ঘ সময় ব্যাপি একটি ইবাদাত। নামায পড়লে সর্বোচ্চ পনের-বিশ মিনিট প্রয়োজন। কিন্তু রোযার সময় হল পূর্ণ চবিবশ ঘণ্টা। এই চবিবশ ঘণ্টা সময় কিভাবে কাটাতে হবে তার একটি দৈনিক রুটিন বা কার্যতালিকা একান্তই নিজের পছন্দ মত আগে থেকেই প্রণয়ন করে নিতে হবে। রুটিনে কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকারসহ সকল ভাল কাজের উল্লেখ থাকতে হবে। অনেক লোক এমন আছেন যিনি সিয়াম সাধনার পাশাপাশি অশ্লীল সিনেমা দেখে অলস সময় কাটান। আমাদের মনে রাখতে হবে শুধু উদরের রোযা নয়- হাত, পা, চোখ, কান ও হৃদয়সহ সারা অঙ্গের রোযাই হলো প্রকৃত রোযা। শিশুদেরকে রোযার প্রতি যথাসাধ্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। রমযানের আনন্দের ভাগ তাদেরকেও দিতে হবে। ছোট বেলায় দুয়েকটা রোযা রেখে অভ্যস্ত হলে পরবর্তীতে সব কটি রোযা রাখা তাদের জন্য অতিশয় আরামদায়ক হবে। এমনকি রোযা রেখে তারা তৃপ্তিও অনুভব করবে। দরিদ্র জনগণের খোঁজ-খবর নিতে অন্তত একটি পরিবারে যাওয়া প্রয়োজন। রোযার আগেই তাদের প্রতি দানের হস্ত প্রসারিত করে ধনী-গরিব সবাই মিলে আনন্দ উপভোগ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। পরিবারের জন্য প্রথম রোযার সেহরি ও ইফতারের প্রয়োজনীয় খাবার কিনে রাখলে ভাল হয়। যেমন- ছোলা, বেগুন, পেঁয়াজ, মুড়ি, সরিষার তেল, খেজুর ইত্যাদি। অনেকেই একসাথে সারা মাসের বাজার কিনে রাখেন। তাঁরা মনে করেন পরবর্তীতে মূল্য বৃদ্ধি পাবে। মূলতঃ ব্যাপারটি সেরকম নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে সমস্যা আরও জটিল ও কঠিন হয়। এক সাথে খাদ্য বস্তুর এত অধিক চাপ সহ্য করা এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কর্তৃপক্ষের দ্বারা সম্ভব হয়ে উঠে না। শুরু হয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তাই খাদ্য আয়োজনে এত বেশি ব্যস্ত না হয়ে ইবাদাত ও সংযমে মনোনিবেশ করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীগণ অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য মাল মজুদ করেন। এই কাজটি অত্যন্ত গর্হিত। রোযাদারের সুবিধার্থে মাহে রমযানে প্রয়োজনীয় সকল বস্তু বাজারে উন্মুক্ত রেখে মূল্য স্থিতিশীল রাখা ব্যবসায়ী ভাইদের ঈমানি দায়িত্ব।
উপরে উল্লেখিত সকল করণীয় কার্য সম্পাদনের পর সবশেষে আমাদের দায়িত্ব হলো মাহে রমযানের চাঁদ দেখা। এ ব্যাপারে হাদিস শরিফে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, মানুষ সম্মিলিতভাবে চাঁদ দেখল, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সংবাদ প্রদান করলাম যে, আমি চাঁদ দেখেছি। রাসূল সা. রোজা রাখলেন এবং রোজা পালনের জন্য সকলকে নির্দেশ দিলেন। (আবু দাউদ : ২৩৪২)। আল্লাহর রাসুল সা. এরশাদ করেন, ‘‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ, চাঁদ দেখেই রোযা ভঙ্গ কর। চাঁদ দেখাকে অভ্যাসে পরিণত কর। যদি চাঁদ না দেখা যায়, তবে ত্রিশ দিন পূরণ কর। যদি দুইজন ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করে, তবে তোমরা রোজা রাখ এবং রোজা ভঙ্গ কর।’’ (নাসায়ি : ২১১৬)। তিনি আরও বলেন, ‘‘মাস হল ২৯ রাত্রি। তবে চাঁদ না দেখে তোমরা রোজা রেখ না। যদি চাঁদ দেখা না যায়, তবে শাবানকে ত্রিশ দিন পূর্ণ কর।’’ (বোখারি : ১৮০৮)। তাই আমাদের উচিত শাবানের উনত্রিশ তারিখ দল বেঁধে রমযানের চাঁদ তালাশ করা। মাহে রমযানের চাঁদ দেখার সাথে সাথে এই দোয়া পড়তে হয়। কেননা রমযানকে স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে সুন্নত হল, রমযানের চাঁদ দেখে নিম্নের দু’আটি পাঠ করা। ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল-আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম।’’ অর্থাৎ- ‘‘হে আল্লাহ, আমাদের উপর তুমি এই নতুন চাঁদকে নিরাপত্তা, বিশ্বাস ও প্রশান্তি দায়ক রূপে উদিত কর।’’ (তিরমিযি)। মহান আল্লাহ আমাদের উপরোক্ত আলোচনার উপর আমল করার তাওফিক দিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন