দেশব্যাপী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে গত শুক্রবার দিবাগত রাতে ১০ জেলায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরো ১২জন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে গত ১২ দিনে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮১ জনে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবিমতে, তাদের মধ্যে ৭৪ জনই মাদক ব্যবসায়ী। পুলিশের সদর দফতরের সূত্র অনুযায়ী, ১৭ মে থেকে গত শনিবার পর্যন্ত ৯ দিনের অভিযানে মাদকব্যবসার সঙ্গে জড়িত সন্দেহ সাত হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ১৫ লাখ ইয়াবা, দুই হাজার কেজি গাঁজা, ১৭ কেজি হেরোইন, ১৩ হাজার বোতল ফেন্সিডিল এবং এক হাজার ১০০ ক্যান বিয়ার উদ্ধার করা হয়েছে। মাদক বহনে ব্যবহৃত মোটর সাইকেল, মাইক্রোবাস এবং টাকাও উদ্ধার করা হয়েছে। সারাদেশের বিভিন্ন থানায় এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার। যেভাবে দেশজুড়ে মাদকের ব্যাপক ও বেপরোয়া বিস্তার হয়েছে, তাতে মাদকবিরোধী কঠোর অভিযান পরিচালনার বিকল্প ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়েই এই অভিযান চালানোর নির্দেশনা প্রদান করেন। স্বভাবতই আশা করা গিয়েছিল, মাদককারবারে যারাই যেভাবে জড়িত আছে, এই অভিযানে তাদের আটক করা হবে এবং দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। অথচ আমরা দু:খের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, এই অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাত জন নিহত হয়েছে। এটা একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে ভীতি, শংকা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ভাষ্য দেয় তা একই গল্পের পুনরাবৃত্তি মাত্র। মানুষ তা বিশ্বাস করেনা। মাদকব্যবসায়ীদের দমন করতে হবে, এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্যও আছে। তবে বন্দুকযুদ্ধই তার উপায় কিনা তা নিয়ে দ্বিমত আছে।
বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড’ বলে অভিহিত করা হয়। আর হত্যাকান্ডের দায়-দায়িত্ব আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপরই গিয়ে বর্তায়। কারণ ‘যুদ্ধটি’ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে, হয় এবং তথাকথিত দুষ্কৃতীরাই এতে নিহত হয়। বন্দুকযুদ্ধ নতুন নয় দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলো শুরু থেকেই একে বিচারবর্হির্ভূত হত্যাকান্ড বলে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে আসছে। হত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। বিরোধী রাজনৈতিক মহল থেকেও একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। অবশ্য তাতে বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ হয়নি। উল্টো বরং বাড়ছে এবং নিহতের সংখ্যাও বাড়ছে। বেঁচে থাকার অধিকার সবচেয়ে বড় অধিকার। এ অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারেনা। যে যত বড় অপরাধই করুক না কেন, আইন তাকে বিনাবিচারে হত্যা করার অনুমতি দেয় না। অপরাধীকে গ্রেফতার করে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ায় বিচার করে যে শান্তি নির্ণীত হয় তা কার্যকর করতে হবে-আইনের শাসন এমনটাই বলে। অনেকেই এখন বলেছেন, আমরা তো যুদ্ধের মধ্যে নেই। একটা স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে আছি। যেখানে প্রতিদিন এতলোক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনোই বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাকে বিচারবর্হির্ভূত হত্যাকান্ড বলে মনে করেনা। তার বক্তব্য সকলের জানা আছে। তবে ওই বক্তব্য ‘পাবলিক পারসেপশনে’র সঙ্গে যায় না। বিষয়টি সরকার ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
প্রশ্ন হলো, এই অভিযান, ধরপাকড় ও বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে মাদকমুক্ত এবং মাদকব্যবসায়ীদের দমন করা কি সম্ভব হবে? মাদক কারবারের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের লোক জড়িত। নীচে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সরবরাহকারী বা বাহক আর উপরে আছে ‘গডফাদার’। খবরাখবরে জানা গেছে, বন্দুকযুদ্ধে যারা এ যাবৎ মারা গেছে তারা গডফাদার, এমন কি ওপর পর্যায়ের কেউ নয়। তাদের অনেকেই বাহক পর্যায়ের। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিহতদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি তালিকায় মাদককারবারি হিসাবে নাম নথিভূক্ত ছিল। ধারণা করি, ওই তালিকায় গডফাদারদের নামও আছে। কিন্তু তাদের কেউ নিহত হয়েছে বা কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এমন তথ্য নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হচ্ছে: সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, র্যাব, সাংবাদিক যারাই মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকবে তাদের ছাড় নয়।’ এই শ্রেণীভুক্তদের কাউকে আমরা এ পর্যন্ত ধরতে দেখিনি। এর মধ্যেই পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে মাদকের বড় ব্যবসায়ী ও গডফাদারদের অনেকেই ইতোমধ্যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তারা সেখানে কিভাবে গেল? অভিযানের শুরু আগেই এরূপ আশংকার কথা মাথায় রেখে সীমান্ত সিল করে দেয়া উচিৎ ছিল। কেন সেটা করা হয়নি, কে জবাব দেবে? বলা নিষ্প্রয়োজন, মাদক কারবারের সঙ্গে যুক্ত ‘চুনোপুটি’ ধরলে বা মারলে কিছুই হবে না যদি বড় ব্যবসায়ী ও গডফাদাররা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। তারা আবার সময়-সুযোগ মত ব্যবসা জমিয়ে তুলতে পারবে। তাদের লোকের অভাব হবে না। সরকারের ভাষায়, ভারত আমাদের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু, কাজেই এই দাবিতে সরকারের এখন বলা উচিৎ, মাদককারবারীরা যেন যেখানে আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়। আইনশৃংখলা রক্ষাকারীবাহিনী যে তালিকা করেছে সেই তালিকা দিয়ে ভারতকে বলা হোক, ‘এদের ফেরৎ দাও।’ এত কিছু দেয়ার পর বন্ধুদেশ এটুকু করবে না? একই সঙ্গে এখনই সীমান্ত সম্পূর্ণ সিল করে দেয়া দরকার যাতে ছোড়বড় কোনো মাদককারবারিই সেখানে যেতে না পারে। বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এক সময় সব কিছুরই আর হিসাব হবে। সেদিন অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার ও অতি উৎসাহের ফলাফল ভোগ করতে বাধ্য হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন