বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

নজরুলের গল্পের বৈশিষ্ট

বা সা র তা সা উ ফ

| প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মূলত ‘কবি’ হিসেবে অধিক পরিচিত এবং ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে খ্যাত হলেও কাজী নজরুল ইসলাম কিছু অসাধারণ গল্পও লিখেছেন। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো তিনি খুব বেশি গল্প লিখেন নি। তাঁর গল্পগ্রন্থ সংখ্যা মাত্র ৩টি। ‘ব্যথার দান’ (১৯২২) ‘রিক্তের বেদন’ (১৯২৫) ও ‘শিউলিমালা’ (১৯৩১)। এগুলোতে সর্বমোট গল্প সংখ্যা ১৮টি।
নজরুলের গল্পের মান কিংবা চমৎকারিত্ব নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। আমি শুধু তার গল্পের বৈশিষ্ট্য বলব বলে এ প্রবন্ধটি লিখতে ইচ্ছে পোষণ করেছি। নজরুলের গল্পের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, প্রেম। নিখাদ প্রেমের চিরকালীন আকুতি ফুটে উঠেছে তাঁর গল্পে। এই প্রেম শুধু মানসীর প্রতি নয়, দেশের প্রতিও। আমরা সকলেই জানি নজরুলের জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে, যখন ভারতের ওপর শোষণ ও জুলুম চালাচ্ছিল তারা। নজরুলের জীবনটাই ছিল পরাধীনতার গø­ানি ও যন্ত্রণার। আদতেই তিনি কবিতা, গান আর প্রবন্ধে শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে শব্দ-নিনাদ ঝংকার তুললেও তাঁর বুকের গহিনে নিভৃত মনটি একজন রমণীর কোমল হাতের স্পর্শ পাবার আকাঙ্খায় ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। তাঁর গল্পে চিঠি লেখক শ্রীধূমতেুকে পাই। এই ধূমকেতুকে স্বয়ং নজরুল বলেই ধরে নেয়া হয়। এই ধূমকেতু তার প্রিয়াকে জানানোর ছলে সমগ্র জাতিকে জানিয়ে গেছেন মনের অব্যক্ত কথা। সাহিত্যের বড় কাজ হলো মানুষের মনে জাতীয় চেতনা ও কল্যাণবোধ জাগিয়ে তোলা। ধূমকেতু তাঁর চিঠির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। নজরুলের কোমল হৃদয়ের পাশাপাশি কঠিন দিকনির্দেশনা আছে। পরোক্ষে বলা হয়েছে ভালোবেসে ত্যাগের কথা, জীবন উৎসর্গের কথা। অধিকাংশ গল্পের নায়ক চরিত্রেরই বাউÐুলে বা দুরন্তপনার স্বভাব আছে। তিনি নিজেও ছিলেন বাউÐুলে আর দুরন্ত স্বভাবের। তিনি স্বাধীনতার বাসনা ও বিরহের বেদনা সমানতালে বাজিয়েছেন। সমাজের পবিত্র-অপবিত্র জ্ঞান, উঁচু-নিচু ভাব, সর্বোপরি সামাজের সকল ভেদাভেদ অগ্রাহ্য করার প্রবণতা তুলে ধরেছেন। সমাজের অনিয়ম আর ভন্ডামির ধরন বুঝতে পেরেছেন আর সেই ভন্ডদের মুখোশ তুলে ধরছেন, তা বর্তমানেও সত্য। কিন্তু নজরুলের গল্প পড়তে গিয়ে মনে হবে, সব গল্পই একই সময়ে, একই বিষয়ে অপ্রকাশিত সুর তিনি বাজাতে চেয়েছেন শব্দ-নিনাদে, তাঁর প্রতিটি গল্পের সুর, বেদনা আর ভালোবাসা যেন এক। তাঁর মনের সব হাসি-কান্না ও আনন্দ-বেদনা যেন একই সুতোয় গাঁথা। তাঁর গল্পে মানুষের যেসব যাতনা ও হাহাকারের চিত্র ফুটে উঠেছেÑ তা আমাদের সমাজে আজও বিদ্যমান আছে। সমাজের ঔপনিবেশিক শোষণ ও ব্যাপক মহামারীর বিস্তার সম্পর্কে যেমন বাস্তব বিবরণ আছে, তেমনি জাত-পাত-বংশমর্যাদা বিষয়ক বিভেদ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর দিকটা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হয়েছে তাঁর গল্পে। সমাজের গভীরে নিহিত ও সামাজিক ব্যাধিকে দেখিয়েছন ক্ষতিকর হিসেবে। দরিদ্র মহিলা বিধবা হলে তার আর কোনো রক্ষা নেই। বাংলার অবহেলিত, নিপীড়িত নারীর অবস্থা তিনি গল্পের ঢঙে রূঢ় বাস্তবভাবে ফুটিয়ে তুলে ধরেছেন। নজরুল ছিলেন চির দুরন্ত, মুক্তি পাগল, শোষণ ও শৃঙ্খলতা কখনোই তাঁর পায়ে শিকল পরাতে পারে নি। তাঁর গল্পেও সেই অদম্যতা ফুটে উঠেছে।
নজরুলন কবিতার মতো গল্পেও আবহমান লোকজ-সংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরেছেন। মানুষের মনে কত ধরনের কামনা-বাসনা হতে পারে, তার একটা দিক তিনি সফলভাবে চিত্রিত করেছেন। তাঁর গল্পে সমাজের উচ্চবংশীয় লোকজনের বিনাশের চিত্র রুপায়িত হয়েছে। তখনো গ্রামে জিন-ভূতের উপদ্রব ছিল। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার সঙ্গে জিন-ভূতের একটা সম্পর্ক আছে। শহরে ধনী ও শিক্ষিত লোকদের জিনে-ভূতে তেমন বিশ^াস হয় না। জিনে আর ভূতে ধরে অশিক্ষিত দরিদ্রকে। এটাও অনুন্নত ও অশিক্ষিত সমাজের বৈশিষ্ট্য। গ্রামীণ মানুষের সমাজে ও মনোজগতে জিন-ভূতের ধারণা কীভাবে কাজ করে তা তিনি গল্পে তুলে ধরেছেন আবার বাস্তবে জিন-ভূত বলতে যে কিছুই নেই- তাও জানিয়েছেন। তাঁর গল্পে সমগ্র বাঙালি জাতির ভাবনা, বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তর সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর গল্পের শেষে এসে বিষাদের করুণ রাগিণীপাঠকের মনকে দীর্ঘক্ষণ আবিষ্ট করে রাখে।
নজরুলের ছোটগল্প সম্পর্কে গবেষক আতোয়ার রহমান বলেছেন, ‘নজরুল ছোটগল্পে আঙ্গিনায় ফোটা সন্ধ্যামনিটির মতো ¯িœগ্ধ, প্রেমিক এবং প্রেমপিয়াসী। মধুর অনুভূতির সামান্যতম স্পর্শেও তার অন্তওে বিপুল আলোড়ন জাগে এবং নজরুল সাহিত্য পরিক্রমণ করলে দেখা যাবে, বিদ্রোহের সুরের থেকে এই সুরটি প্রকাশ ক্ষেত্রে অনেক বেশি ব্যাপক। কাব্যের জগতে তিনি অর্ধেক বিদ্রোহী, অর্ধেক প্রেমী। আর ছোটগল্পের বেলায় বলতে গেলে, তার পরিমÐল শুধুমাত্র প্রেমেরই।’
নজরুলের মোট আঠারোটি গল্পের মধ্যে চৌদ্দটিই প্রেমের গল্প। সার্বিক বিবেচনায় এবং রসঘন আবেদন সৃষ্টির দিক থেকে নজরুলের ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যেও এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। গল্প রচনার ক্ষেত্রে তিনি এক নতুন রুচি, ভঙ্গী ও দৃষ্টিকোণ নিয়ে এসেছেন, তাঁর গল্প পাঠক মনে আবেগ ও আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে, এখানেই ছোট গল্প রচয়িতা হিসেবে নজরুলের সার্থকতা।
নজরুলের ছোটগল্পের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলোÑ
কবিতায় তিনি ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে পরিচিত। পরাধীনতা, অন্যায়, শোষণ, জুলুম, নিগ্রহ ও সকল আমনবিবতার বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহের বজ্র নির্ঘোষ আওয়াজ তুলেছেন। কিন্তু ছোটগল্পে তিনি শুধুই প্রেমিক। এখানে তাঁর ভাষা মধুর, কোমল ও অনুভূতির জারক রসে স্নিগ্ধ সমুজ্জ্বল।
নজরুলের প্রায় সবগুলো ছোটগল্পে ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে। না পাওয়ার, ব্যর্থতার সুর-রাগিণী ঝংকৃত হয়েছে।
নজরুলের সাতটি গল্প যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা বা কোনো না কোনো ভাবে যুদ্ধের কথা বর্ণিত হয়েছে। বাংলা ছোটগল্প এটি নতুন বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। নজরুল সৈনিক হিসেবে করাচী যাওয়ার পরই গল্পগুলো লিখতে শুরু করেন, তাই স্বাভাবিক কারণেই গল্পগুলোতে যুদ্ধের পটভূমি বিস্তার করেছে।
তথ্যঋণ
১. নজরুলের ছোটগল্প: শিউলিমালা প্রসঙ্গ
লেখক : অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান
২. নজরুল গল্প-সমগ্র
কাজী সব্যসাচী এবং অন্যান্য-সম্পাদিত

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন