বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

সান্ত¡না

| প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম


শ ফি কু ল ই স লা ম শ ফি ক

ছোটবেলা থেকেই আমার খুব জেদ ছিল। প্রতিনিয়ত মায়ের কাজে ওটা ওটা খুঁত ধরার চেষ্টা করতাম। আমার মা সব কাজ একটু দেরিতে শেষ করেন। তবু তার কাজগুলো একদম নিখুঁত মানের ছিল। কেন জানি তা একবার বুঝেও না বোঝার ভান করেছি! বেশ কিছু রুটিন আমার আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা ছিল। প্রথমত, সময়মতো তিনবেলা গরম ভাত। দ্বিতীয়ত, গমের রুটি একদম নাকোচ। তৃতীয়ত, কাঁচা কলা, খিঁচুড়ি বা তিতা জাতীয় কোনো তরকারি রান্না করা যাবে না। এমনকি এ ধরনের আরও কিছু রুটিন। রুটিন হেরফের হলে মায়ের সঙ্গে অনেক রাগারাগী করতাম। এ সব রান্না করলে অন্য কারো বাড়ি থেকে ভাত এনে দিতেন। কখনও রাগ করে কতদিন যে অনাহারে থেকেছি, তার হিসেব আজও জানা নেই। আবার কখনও বা না খেয়ে রাতে শুয়েছি। বিছানায় মা জোর করে মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিতেন। পেট পুরে খেয়ে দেয়ে সব রাগ মাটি হয়ে যেত। জেদ ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় এভাবে কাটতে থাকে আমার ছোটবেলা।
একদিন পেটে খুব খিদে পেয়েছিল। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে দেখি এখনও রান্না হয়নি। মা বললেন, ‘রান্না শেষ হতে আরও আধা ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন।’ সেদিন মনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জেদ চেপে বসে। যথা সময়ে ভাত না পাওয়ায় ভাতের থালা মাটিতে জোরেশোরে ফেলে দিয়ে চ্যাপ্টা করলাম। মা তবু নরম গলায় বললেন, ‘আজ তোর কপালে ভাত নেই। কপালে খারাপ আছে।’ এরপর বাড়ি থেকে একটু বাইরে গেলাম। সেদিন মায়ের কিছু কথায় অনেকক্ষণ ধরে বারবার অনুশোচনা করলাম। ভাবলাম, মায়ের সামনে এত বড় অন্যায় কাজ করা উচিৎ হয়নি। মা কী আমাকে ক্ষমা করবে? শিগগিরই বাড়ি ফেরে ভাত চাইলাম। মা নীরবে খেতে দিলেন। আমাকে আর কিছুই বললেন না। খাওয়া-দাওয়ার শেষে মায়ের কাছে প্রাণভরে ক্ষমা চাইলাম। মা হাসিমুখে সব অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন।
ছাত্র হিসেবে আমি খুব মেধাবী ছিলাম। অভাবের কশাঘাতে পিষ্ট হতে থাকে গরিবের সংসার। মা কোনোমতে শুধু নিজের নামটা সই করতে পারেন। তবু আমাকে পড়াতে চাইতেন, বাবা বেশি দূর অবধি পড়াতে চাইতেন না। গ্রাম থেকে কলেজ পাস করলাম। জিপিএ ফাইভ পেলাম। বাবা ভার্সিটিতে ভর্তির টাকা হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমি এত খরচ বহন করতে পারব না। সংসার চালাব নাকি পড়াশোনা চালাব? ’ বাবাকে বললাম, ‘কোনো ভয় নেই। মাত্র দু-চার মাস খরচ দিলেই চলবে। আমি টিউশনি করে পড়াশোনার সব খরচ চালাব।’ মা বললেন, ‘খাকা, তুই কোনো দুশ্চিন্তা করিস না। প্রয়োজনে আমার কিছু জমি বিক্রি করে তোকে পড়াব।’ মায়ের কথায় মনে-প্রাণে শক্তি সাহস পেলাম। ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। কয়েক মাস পর এক বন্ধুর মারফতে বেশ কয়েকটা টিউশনি পেলাম। বাড়ি থেকে আর কোনো খরচ নিতে হয়নি। প্রতি মাস শেষে বাবাকে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিতাম। মাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে সহজে তিনি হাতে নিতেন না। বলতেন, ‘খোকা, আমাকে কিছুই দিতে হবে না। তোর যা যা প্রয়োজন, আমাকে বলবি। আমি সব ব্যবস্থা করব।’
মা বারবার বলেন, ‘খোকা, তুই চাকরি না পেলেও কোনো দুশ্চিন্তা করিস না। যত টাকার প্রয়োজন, আমি ব্যবস্থা করে দেবো। ব্যবসা-বাণিজ্য করবি। বাড়িতে আমার কাছে থাকবি। পড়াশোনা শেষ করেছিস। তুই আমার আশা পূর্ণ করেছিস। চাকরি না পেলেও আমা দুঃখ নেই। বড় শিক্ষিত ছেলে। এটাই আমার গর্ব।’ দু-তিন মাস পর গ্রামের বাড়িতে যাই। মা শুধু বলেন, ‘খোকা, এবার ক’দিনের ছুটি? এদিক সেদিক ঘুরে সময় অযথা নষ্ট করিস না। তোর পছন্দের খাবারগুলো রান্না করব। বসে বসে খাবি।’ মা শুধু খাওয়ার কথা বলেন। মাঝে মধ্যে ঠাট্টা করে বলি, ‘আমার তো ছোট পেট। এত খাবার রাখার জায়গা নেই।’
বাড়ি থেকে শহরে আসার সময় মা নিষ্পলকভাবে চেয়ে থাকেন। হেঁটে হেঁটে কিছু দূর পথ এগিয়ে দেন। মায়ের চোখের পানে তাকিয়ে বিদায় নিতে পারি না। তাকালে কান্নার নোনাজলে সারা বুক ভিজে যায়। আনমনে চেয়ে চেয়ে বিদায় নিই। দেখতে দেখতে ভালো ফলাফল নিয়ে ভার্সিটি জীবন শেষ করলাম। চাকরির পড়াশোনা করে বছর চারেক কেটে গেল। এখনও চাকরি পাইনি। বেশ কয়েকটা টিউশনি আছে। চাকরির আশা ছেড়ে দিয়েছি। আজকাল ক’জন ছাত্র মেধার মূল্য পায়? মামা, খালু নেই। টাকার জোরও নেই। চাকরি পাওয়া মহামুশকিল। বাড়ি গেলে আরও মন খারাপ হয়। ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা। মা হয়তো ভাবেন না, বাবা ছেলের জন্য চাকরির কথা ভাবেন। মা অসুস্থ। তবু আমাকে আজ অবধি সান্ত¡না দিচ্ছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন