শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইনকিলাব বর্ষ শুরু সংখ্যা

আমাদের পথ

জি য়া উ র র হ মা ন | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

মানুষের কর্মে, চিন্তাভাবনা, রাজনীতি-এসব কিছুই নির্ণীত ও পরিচালিত হয় একটা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে এ জীবনদর্শনের তারতম্য ঘটতে পারে। তাই বিশ্বাসের কোনো কোনো মানুষের রাজনীতি ও জীবনদর্শন ভীতির উদ্রেক করলেও সবসময় তা বিপজ্জনক বা অকল্যাণজনক নাও হতে পারে। বস্তুতঃ কোনো কিছুই অবলম্বন না করে রাজনীতি কোনো দর্শনের উন্মেষ এবং বিকাশ ঘটতে পারে না। উদাহরণস্বরুপ মার্কস ‘ইজম’ -এর কথা বলা যেতে পারে। যদি আমরা মার্কস-ইজম নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করি তাহলে দেখা যাবে, এর একটা আদর্শ এবং লক্ষ্য আছে। এ আদর্শ ও লক্ষ্যকে ভিত্তি করেই রাশিয়ায় মার্কস-ইজম কায়েম হয়েছিল। এ কথা আজ বিনা দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় মার্কস-ইজমের প্রভাব না ঘটলে হয়তো ইউরোপ জাতি এতটা উন্নত অবস্থায় উপনীত হতে পারত না। হয়তো বা সেখানকার সাধারণ মানুষের অবস্থার আরো অবনতি ঘটত।
এই যে আমরা রাতের বেলায় আলো জ্বালাই, এর পেছনেও যুক্তি আছে, ভিত্তি আছে। রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার পেছনেও রয়েছে একটা ভিত্তি। এ ভিত্তিটা কি? অপরাপর বিরোধী রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক দর্শনকে যথার্থভাবে যুক্তি ও কর্মসূচিসহ মোকাবেলা করে স্বীয় জীবন বোধের আলোকে সমাজ ও জাতিকে গড়ে তোলা এবং কখনো কখনো পখভ্রষ্ট স্বেচ্ছাচারের কাছ থেকে বাঁচার তাগিদে হচ্ছে একটি রাজনৈতিক মতের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার মৌল কারণ। এর অর্থ এই দাঁড়াচ্ছে যে, রাজনীতি, রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্বাস মানুষের একটা সুষ্ঠু সুন্দর চেতনাবোধ।
বাংলাদেশ ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই। উপমহাদেশ এবং অঞ্চলের মানচিত্রের দিকে তাকালে এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ ভৌগলিক অবস্থানের সঙ্গে তুরস্ক-মিসর-মরক্কো এবং স্পেনের ভৌগলিক অবস্থানের একটা সাদৃশ্য আছে। বাংলাদেশ এ উপমহাদেশে এ অঞ্চলের সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। এর উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বত আর দক্ষিণে সুগভীর বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ-পূর্বে এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছে বাংলাদেশ তার আপন ভূখন্ডের বৈচিত্র দিয়ে। তাই বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডটিতে অতীতে অনেক উত্থান-পতন ঘটে গেছে। হাজার হাজার বছরের পট-পরিবর্তনের ইতিহাসকে বুকে ধারণ করে আছে বাংলাদেশ।
এখানে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে যে, ইংরেজ জাতি এ উপমহাদেশে তাদের উপনিবেশ কায়েমের প্রাথমিক ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিল কেন? উপমহাদেশের অন্য যে কোনো স্থান তারা প্রথমে দখল করতে চাইলে নিশ্চয়ই পারত। কিন্তু বাংলাদেশকে তারা এ জন্য বেছে নিয়েছিল যে, এখান থেকে আন্তর্জাতিক চলাচলে সুবিধা হবে। বাংলাদেশের যে ভৌগলিক অবস্থান ও আকার তাতে এখান থেকে পশ্চিমে ও পূর্বদিকে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করাও সুবিধাজানক বলে ইংরেজগণ এ স্থানকে প্রথমে বেছে নিয়েছিল। সুচতুর ইংরেজের এ পরিকল্পনা এতটা নির্ভুল ছিল যে, পর্যায়ক্রমিকভাবে তারা গোটা ভারতবর্ষ এবং ব্রহ্মদেশ দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এ থেকে তাই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, বাংলাদেশের ছিল এক বিরাট ‘স্ট্যাটেজিক’ অবস্থান এবং বলা বাহুল্য যে অবস্থান আজও গুরুত্বপূর্ণই রয়ে ছিল। এ কারণেই বাংলাদেশের ভূখন্ড এবং বঙ্গোপসাগরের জলরাশির উপর এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ এবং পরশক্তিগুলোর অশুভ দৃষ্টি রয়েছে। যা আমাদের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আমাদের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আধিপত্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ। কাজেই বাংলাদেশের ৯ কোটি মানুষের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে এবং এই আধিপত্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য আমাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। আমাদের কর্মকান্ডের মূল ভিত্তি হলো জাতীয়তাবাদী চেতনা। কারণ জাতীয়তাবাদী চেতনাই দেশকে ও জাতিকে বহিঃশক্তির হুমকি থেকে রক্ষা করতে পারে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ যখনই হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, তখনই জাতীয়বাদী চেতনার পথ অবলম্বন করেছে। জার্মানির হিটলারও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু নয়। তারা ‘জার্মান’, ‘এরিয়ান’ জাতীয়তাবাদের ছাত্রছায়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। পঞ্চাম দশকে জাতীয়তাবাদের ছত্রছায়ায় সমগ্র আরব জাহানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে হওয়ার প্রচেষ্টা চলেছিল। মিসরের তদনীন্তন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এতে কিছুটা সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার সুফলও তারা পেয়েছেন। জাতীয়তাবাদী চেতনার ঝড় আজ প্রবাহিত হয়ে চলেছে কালো আফ্রিকার এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। বিদেশিদের দ্বারা শোষিত লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে আজ তারা ‘আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ’ এর আদর্শকে গ্রহণ করেছে। ফলে তাদের মধ্যে একতার সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয়তাবাদ আবার রকমফের আছে। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ‘জাতীয়তাবাদ’ বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্নভাবে কার্যকরী হয়েছে। আরব জাতীয়তাবাদ জার্মান জাতীয়বাদ, এরিয়ান জাতীয়তাবাদ হলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়বাদ। কেউ ভাষাভিত্তিক আবার কেউ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সমর্থক।
মলয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন আঞ্চলিক মতবাদ গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে। ‘আসিয়ান’এর ভিত্তিক তাদের এ আঞ্চলিক মতদর্শ পরিচালিত হচ্ছে। অন্যদিকে রয়েছে অর্থনীতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক হিসেবে ইইসি। একে আমরা যুদ্ধভিত্তিক জাতীয়তাবাদও বলতে পারি। কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদ এদের চেয়ে পৃথক। আমরা খন্ডিত চেতনায় বিশ্বাসী নই। তাই আমাদের জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিক ভিত্তিক।এ জাতীয়তাবাদের মধ্যে রয়েছে জাতিগত চেতনা, ভাষার ঐতিহ্য, ধর্মীয় অধিকার, আঞ্চলিক বোধ, অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের প্রচেষ্টা এবং সংগ্রামের উন্মাদনা।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে। অকারণ এ দাবি নয়। বিশ্বের অপরাপর দেশের নেতৃবৃন্দ রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিবর্গের মতে, বাংলাদেশ আগের তুলনায় অনেক পরিমাণে স্থিতিশীলতা এসেছে। এ স্থিতিশীলতা, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’-এর যে পন্থার আমরা গড়ে তুলতে চাচ্ছি, তারই ফলশ্রুতি।
বিশ্বে আর যাই থাকুক মতাদর্শের অভাব অন্তত নেই। মার্কস-ইজম, লেনিন-ইজম, মাও-ইজম, ক্যাপিটাল-ইজম ইত্যাদি বহু ধরনের ইজমের অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের উৎকর্ষ এত দ্রুততার সঙ্গে ঘটে চলেছে যার ফলে এসব ইজম তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। এসব মতাদর্শের স্রষ্টাদের মানসিক এলাকা থেকে বিজ্ঞান বর্তমান পরিবেশেকে বহুদূরে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কাজেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এসব মতাদর্শের প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং সংযোজন। কিন্তু একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া এ ক্ষেত্রে আছে। কেন আমরা এসব মতাদর্শের রদবদল ঘটাব? সমাজতান্ত্রিক দেশে মার্কসীয় দর্শন পুরোপুরিভাবে রূপ পরিগ্রহ করতে সক্ষম হচ্ছে না। রেজিমেন্টেশনের যাঁতাকলে পড়ে হিউম্যান এনার্জি স্থবির হয়ে রয়েছে। এদের কাছে বিজ্ঞান ও কারিগরি সুযোগ সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে হবে। একটা মানুষের তার ইচ্ছামতো পছন্দমতো বিষয়ে গড়বার অধিকার দিতে হবে, তবেই না তার প্রতিভার বিকাশ পরিপূর্ণভাবে ঘটতে পারে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের যে সব দেশে রেজিমেন্টেশন চরমভাবে বিদ্যামন, সেখানে প্রতিভার বিকাশ স্বভাবিকভাবে ঘটতে পারছে না।
এ সত্য উপলব্ধি করে গণচীন আজ আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের বিশ্ব দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে চীনে সংঘটিত ব্যাপক ধরনের এ রদবদলকে প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের প্রথম দিকে চীনদেশে যে অবস্থা দেখেছিলাম, তার থেকে আজকের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। কিন্তু সব সমাজতান্ত্রিক দেশ এখন মারাত্মক স্ববিরোধিতায় ভুগছে। আমাদের সামনে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্ববিরোধিতামূলক তিক্ত পরিবেশের চিত্র রয়েছে। কাজেই যে মতাদর্শে গলদ রয়েছে তা আমরা গ্রহণ করব কেন? যে জিনিস আমাদের পুরোপুরি কাজে লাগে না তা গ্রহণ করে কি লাভ?
আমাদের সামনে বর্তমানে লক্ষ্য একটাই, আর তা হলো দেশ ও জাতি গঠন। দু’শত বছর পরাধীন থাকার ফলে দেশ ও জাতির অনেক ক্ষতি হয়েছে, সময়ও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমাদের প্রয়োজন অনতিবিলম্বে জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। তবে কথা থেকে যায়, জনগণকে এক্যবদ্ধ করা হবে কিভাবে? একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে? নিশ্চয়ই নয়। ‘ওয়ান পার্টি সিস্টেম’ এবং ‘রেজিমেন্টেশন ইনফোর্স’ করে যে সাফল্য অর্জন করা যায় না নিকট অতীত তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশের জনগোষ্ঠীকে একটা পথে পরিচালিত করাই সর্বোত্তম পথ বলে আমি মনে করি। জনগণ স্বতঃফূর্তভাবে ‘খাল খনন’-এর কর্মসূচিতে সাড়া দিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে রেজিমেন্টেশনের মাধ্যমে যে কাজ হতো, সে কাজ আমরা জনগণের স্বেচ্ছা অংশগ্রহণের ভিত্তিতে করিয়ে নিচ্ছি। এখানেই আমাদের দর্শনের সাফল্য।
অপ্রিয় হলেও একটা সত্য কথা বলতে চাই। আর তা হলো- চারিত্রিক বলিষ্ঠতা অর্জনের প্রসঙ্গটি। আমাদের যে চরিত্রগত দিক রয়েছে, তা ভালো নয়। আমাদের গলদ, আমার নিজে যা পছন্দ করি না তা অপরকে করতে বলি। ‘আত মারুনা আননাশ বিল বারবে ওয়আ কানমুনা আন ফুসাকুম’ অর্থাৎ,- ‘তুমি নিজে যেটা করো না তা অন্যকে করতে বলো কেন?’ এ ব্যাপারে সবাই সংযত হতে পারলে বা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে আমার আরো দ্রুত গতিতে অগ্রগতিতে পথে চলতে পারব।
এ দেশের মানুষ কোনোদিন ভালো কিছু পায়নি। সবসময় পেয়েছে দুঃখ, নির্যাতন, অন্যায়-অত্যাচার আর এক্সপ্লয়েটেশন। একই সঙ্গে দেশের সর্বত্র বিরাজ করছে পাহাড়-পর্বতের মতো সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। গত বছরের আগের বছর নাভানায় গিয়েছিলাম। ফিদেল কাস্ট্র্রোর সঙ্গে আলোচনায় একপর্যায়ে- ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে সাড়ে আট কোটি জানালে তিনি মাথায় হাত দিয়ে জিব কেটে বললেন- ‘এটা চালাও কিভাবে?’ আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে না উঠলে জগদ্দল পাথরের মতো সমস্যাবলির সমাধান করা সম্ভব নয়। সেই দুরূহ কাজে আট কোটি মানুষের হাতকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশ গড়ার কাজে লাগাতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন