সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের পাশে কি রাষ্ট্র দাঁড়াতে পারে না?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

দুর্ঘটনায় মানুষের হাত নেই, কথাটি দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে এখন সর্বাংশে সত্য নয়। অন্তত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তার ধরন দেখলে মনে হবে দৈবক্রমে খুব কমই দুর্ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার পেছনে মানুষের হাত রয়েছে। ে ইচ্ছাকৃত ভুল রয়েছে। এই ভুল করছে গাড়ি চালকরা। আরেকটু গোড়ার দিকে গেলে, পরিবহন মালিক এবং আরও গভীরে গেলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের চরম উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনা রয়েছে। গাড়ি চালকদের বেপরোয়া মনোভাব ও অদক্ষতা তাদের জানাশোনার মধ্যেই রয়েছে। চালকরা নিজেদের অদক্ষতা জেনেবুঝেই গাড়ির স্টিয়ারিং ধরছেন। গাড়ি মালিকরাও তাদের জ্ঞাতসারেই ভুয়া লাইসেন্সধারী ও অদক্ষ চালকদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আর সরকারের সংশ্লিষ্টদের আইনের যথাযথ প্রয়োগে উদাসীনতা ও শৈথিল্য রয়েছে। কাজেই দুর্ঘটনা যে শুধুই দুর্ঘটনা, এতে মানুষের হাত নেই-এটা এখন আর বলা যাচ্ছে না। বলা যায়, জানার মধ্যে থেকেই দুর্ঘটনা ঘটছে, রুঢ়ভাবে বললে ঘটানো হচ্ছে। যাত্রীদের যানবাহনে উঠিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী করা হচ্ছে। এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মহাসড়কে প্রতিদিন প্রাণ ঝরছে। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঈদের তিন দিনের ছুটিতে ৫২ জন নিহত হয়েছে। এ সপ্তাহে নিহত হয়েছে ৪৭ জন। আহত হয়েছে অসংখ্য। বিশেষজ্ঞরা দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ওভারটেকিং ও ফিটনেসবিহীন গাড়িকে দায়ী করার পাশাপাশি চলন্ত অবস্থায় চালকের মোবাইলে বা হেডফোনে কথা বলা, মাদকসেবন করে গাড়ি চালানো, মহাসড়ক ও রেলক্রসিংয়ে ফিডার রোডে যানবাহন উঠে পড়া, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা দখল হয়ে যাওয়া, রাস্তার মাঝ দিয়ে পথচারিদের পারাপার উল্লেখ করেছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর রয়েছে প্রায় ২০০ বাজার। এ এক অকল্পনীয় ব্যাপার। বিশ্বের কোনো সভ্য দেশে মহাসড়কে এভাবে বাজার বসে কিনা, জানা নেই। এ যে এক ধরনের আত্মঘাতী প্রবণতা তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। অর্থাৎ জেনেবুঝেই দুর্ঘটনা ঘটছে, ঘটানো হচ্ছে। বলা যায়, একশ্রেণীর গাড়ি চালক ঘাতক হয়ে মানুষ হত্যা করছে। সমস্যা হচ্ছে, গাড়িচালকদের ঘাতক বলতেও এক মন্ত্রীর খুবই আপত্তি। তিনি তাদের ঘাতক বলতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, গাড়িচালকদের ঘাতক ও হত্যাকারী বলা যাবে না। তার এ কথা মানতে অসুবিধা হতো না, যদি গাড়ি চালকদের ভুল ও বেপরোয়া মনোভাবের কারণে নয়, দৈবক্রমে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটত। প্রতিনিয়ত আমরা তো দেখছি, গাড়ি চালকের অদক্ষতা, বেপরোয়া মনোভাবের কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। 

দুই.
এখন সমাজ ও পরিবার এমন একটা সময় অতিক্রম করছে, যে সময়ে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ চরম অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত। একের পর এক অনৈতিক ঘটনা ঘটছে, মানুষ খুন হচ্ছে। আপন মানুষ খুনি হয়ে উঠছে। যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে, তাদের একটা শ্রেণীও অপরাধমূলক কর্মকাÐে জড়িয়ে পড়ছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় মনুষ্যসৃষ্ট এক ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সমাজ ও পরিবার অস্থির হয়ে উঠেছে। যেসব ঘটনা ঘটছে, এগুলো কোনভাবেই দুর্ঘটনা নয়। জেনেবুঝেই করা হচ্ছে। খুনি কিভাবে খুন করেছে, তা যেভাবে নিঃসংকোচে অবলীলায় বর্ণনা করছে, তাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। একইভাবে সড়ক ও নৌপথে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, সেগুলোকেও এখন আর শুধু দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য করা যাচ্ছে না। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ১৪ বছরে সারাদেশে ৪৯ হাজার ৭৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ৯১ শতাংশই হয়েছে অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া চালনার জন্য। এসব দুর্ঘটনায় মারা যায় ৪২ হাজার ৫২৬ জন। সংস্থাটির হিসাবে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশই ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে। এর অর্থ মহাসড়কগুলো যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে হয়েছে। তাহলে এসব দুর্ঘটনাকে কি ¯্রফে দুর্ঘটনা বলা যায়? নাকি হত্যাকাÐ? নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের একাধিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর চারটি বড় কারণ হচ্ছে, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, স্থায়ী নিয়োগের বদলে যাত্রার ওপর বেতন নির্ধারণ, শাস্তির অপ্রতুলতা এবং হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা। এসব কারণ থেকে না বোঝার কি কোন কারণ আছে যে দুর্ঘটনার পেছনে মানুষের হাত নেই? এসব কারণ কি প্রাকৃতিক, যে তা বলে কয়ে আসে না বা ঠেকানো যায় না? নিশ্চিতভাবেই এসব কারণ দূর করা যায়, ঠেকানো যায়। যদি সংশ্লিষ্টরা সচেতন হন, দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে দায় না সারেন এবং দুর্ঘটনার কারণগুলো দূর করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বড় ধরনের কোন ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটলেই আমরা কেবল তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ থেকে শুরু করে কারণ ও প্রতিকার নিয়ে মেতে উঠি। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পথও বাতলে দেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন গেলেই তা ভুলে যাই। ২০১১ সালের মিরসরাই ট্র্যাজেডিও আমরা ভুলে গেছি। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মনিরের ট্র্যাজিক দুর্ঘটনার কথা এখন আর শোনা যায় না। এসব দুর্ঘটনার পর কত কথাই না বলা হয়েছে। মানববন্ধন থেকে শুরু করে পত্র-পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় শোধরানোর কথাও বলেছে। তারপর সময় পরিক্রমায় সবই হারিয়ে গেছে। কারণ নির্ধারণ করা গেলেও, তা প্রতিকারের কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আমরা যেন আরেকটি ট্র্যাজিক দুর্ঘটনা ঘটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। এই যেমন নাটোরের বড়াইগ্রাম ট্র্যাজেডি নিয়ে বেশ আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ ঘটনা আড়ালে চলে যাওয়া শুরু হয়েছে। সরকার তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্ত রিপোর্টও দিয়েছে। নিহতদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপুরণ দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব যেন এখানেই শেষ। কিন্তু দুর্ঘটনার জন্য যেসব কারণ উঠে এসেছে এবং এর জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে কি সুপারিশ বা কি শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা সার্বিক সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে গৃহিত কার্যক্রম কতটা জোরদার হয়েছে, তা অস্পষ্টই থেকে গেছে।
তিন.
সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের উপার্জনক্ষম কোন সদস্য মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের শিকার হলে সে পরিবারটি কি শোচনীয় ও অশেষ দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে, তা তারা ছাড়া আর কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আমরা দূর থেকে দুঃখ ও শোক প্রকাশ করা ছাড়া কিছু করতে পারি না। পুরো পরিবারটিই যে ছারখার হয়ে গেল, তা গভীরভাবে চিন্তা করি না। বিগত ১৪ বছরে যে ৪২ হাজার ৫২৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এসব মানুষের পরিবারগুলো কি অবস্থায় আছে, তা কি আমরা কেউ জানি? দূর অতীতের পরিসংখ্যানে না গিয়ে এ বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে তাদের পরিবারগুলো কি অবস্থায় রয়েছে, তাও তো আমরা জানি না। পরিবারগুলোর খোঁজও কেউ নিচ্ছে না। অথচ রাষ্ট্রের মানবিক দায়িত্ব এসব পরিবারগুলোর খোঁজ নেয়া এবং তারা যে নির্মম পরিণতি ভোগ করছে, তা উপলব্ধি করে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। পরিবারগুলোর পাশে সরকারের দাঁড়ানো দরকার। দুর্ঘটনায় নিহত উপার্জনক্ষম ব্যক্তির পরিবারের পাশে সরকার দাঁড়িয়েছে, এমন নজির আমরা দেখিনি। অথচ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে দুর্ঘটনার শিকার পরিবার সরকারি সহায়তা পাওয়ার অধিকার রাখে। আর যারা আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে দুঃসহ জীবনযাপন করছে, তাদের হিসাব কেউই রাখে না। এটা কোনো সভ্য রাষ্ট্রের আচরণ হতে পারে না। দুর্ঘটনা কমাতে পারব না, আবার যারা দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত ও আহত হয়েছে, তাদের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াবে নাÑএটা কি কোনো সভ্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব হতে পারে? সরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতিদিন গড়ে ৮ জন মানুষ মারা যায়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ৩০ জন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ৪৮ জন। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী বছরে ৩ হাজার, বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ১২ হাজার এবং অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে ১৮ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর এই যে মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, এর রাশ টেনে ধরার কোন কার্যকর উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। উদ্যোগ যদি থাকত, তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩৭ শতাংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর হারটি কমিয়ে আনা যেত। অনেক পরিবার নিঃস্ব ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেত। বলা বাহুল্য, সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু একটি পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরই মৃত্যু হয় না, পুরো পরিবারটিকেও বিপন্ন অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। এভাবে অভিভাবকহীন কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার খবর কখনোই পাওয়া যায় না। এ নিয়ে কোন পরিসংখ্যানও করতে দেখা যায় না। দুর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলো সমাজে বা রাষ্ট্রের কি প্রভাব ফেলছে তারও হিসাব করা প্রয়োজন। গত আগস্টে একটি ইংরেজি দৈনিকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে বলেছে, দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের শতকরা ৭৩ ভাগ উৎপাদনশীল খাতের সাথে জড়িত। সরকারি হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ থেকে ২ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের এক নেতা বলেছিলেন, ‘এর দায় সরকারেরও আছে। মানছি, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব আছে। তাহলে সরকার কেন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না? হাইওয়ে পুলিশের তো যন্ত্র আছে। তারা ব্যবস্থা নেয় না কেন? আসলে চালকরা মুনাফাবাজির শিকার।’ তার কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সরকারের নিশ্চয়ই দায় রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি চালকদের ডাটাবেজ তৈরি করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে শতকরা ৯২ ভাগ চালককে ঘুষ দিয়ে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হতো না। হাইওয়ে পুলিশ যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করত তবে, গাড়ি চালকরাও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে পারত না। অথচ মোটরযান আইনে জাতীয় মহাসড়ক এবং শহর ও লোকালয়ের জন্য আলাদা গতিসীমা রয়েছে। মহাসড়কে বাস, কোচ ও পিকআপের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ঘন্টায় ৫৫ কিলোমিটার, ভারী ট্রাক ও লরির গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও অন্যান্য ভারী যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়ির সার্বোচ্চ গতি ১১০ কিলোমিটার। অন্যদিকে শহর ও লোকালয়ে বাস, কোচ, পিকআপ, ভারী ট্রাক, লরির সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও ভারী যানবাহন ২০ কিলোমিটার এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ৫০ কিলোমিটার। মহাসড়ক ও শহরের যানবাহনের গতির দিকে তাকালে গতিসীমার এ আইন যে কেউ মানছে না বা কর্তব্যরত ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ মানানোর যে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, তা যে কেউ বুঝতে পারবেন। হাইওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘অতিরিক্ত গতি মাপার যন্ত্র হাইওয়ে পুলিশের সব স্থানেই আছে। গতি না মানার দায়ে প্রতিদিনই মামলা দেয়া হয়।’ তাহলে বেপরোয়া গতি কমছে না কেন? সমস্যা কোথায়? বাস-ট্রাকের অনেক চালক বলেছেন, তাদের প্রায় সব চালকই ট্রিপ অনুযায়ী মালিকের কাছ থেকে টাকা পান। তারা মাসিক বেতনভুক্ত নন। এজন্য ট্রিপ বাড়ানোর জন্য পথে গতি বৃদ্ধি করে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো হয়। এতেই দুর্ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ ট্রিপ বাড়িয়ে বাড়তি রোজগারের জন্য তারা শুধু নিজের জীবনের ঝুঁকিই নিচ্ছেন না, যাত্রীদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। কোন সভ্য দেশে এ ধরনের আত্মঘাতি প্রতিযোগিতা চলে কিনা, আমাদের জানা নেই। চালকদের এ কথা থেকে বলার সুযোগ নেই দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই, এর পেছনে মানুষের হাত নেই।
চার.
শনাক্তকৃত কারণগুলেঅ দূর করতে এবং পরিবহন খাতে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিকল্প নেই। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রায় প্রতিদিনই রাস্তায় নামেন। গাড়ি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তাতে তো দুর্ঘটনার চিত্রের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। বরং তার এই মাঠে নামাটা অনেকটা লোক দেখানো হয়ে গেছে। মানুষ ভাবছে মন্ত্রী রাস্তায় নেমেও দুর্ঘটনা বন্ধ করতে পারছে না। তাহলে এই লোক দেখানো কাজের দরকার কি! এটা না করে, মূল জায়গায় হাত দেয়া দরকার। যেসব কারণে এগুলো হচ্ছে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামছে এবং চালকরা বেপরোয়া হয়ে যায়, সেগুলো কীভাবে বন্ধ করা যায়, এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানো বন্ধ এবং যেখান থেকে যেভাবে ভুয়া লাইসেন্স দেয়া হয়, তা স্থায়ীভাবে বন্ধের উদ্যোগ নেয়া দরকার। গোড়ায় গলদ রেখে শুধুমাত্র বিশেষ অভিযানে এর দূরপ্রসারী ফল পাওয়া যাবে না। আশার কথা, সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে এবং তা নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। গত সোমবার মন্ত্রীসভার বৈঠক চলাকালে তিনি এই নির্দেশনা দেন। এর মধ্যে রয়েছে, মহাসড়কে দূরপাল্লার গাড়িচালকরা একটানা পাঁচ ঘন্টার বেশি গাড়ি চালাতে পারবে না। এছাড়া সড়ক ও মহাসড়কের পাশে বিশ্রামাগার নির্মাণ, সিগন্যাল মেনে চলা, অনিয়মতান্ত্রিক রাস্তা পারাপার বন্ধ, সিটবেল্ট বাঁধা এবং চালক ও তার সহকারিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রধানমন্ত্রীর এই দিক নির্দেশনা খুবই ইতিবাচক এবং যত দ্রæত সম্ভব এগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার। দেখার বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এই দিক নির্দেশনা গণপরিবহন সংশ্লিষ্টরা কতটা মান্য করেন। অতীতে আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী ও উচ্চ আদালতের অনেক নির্দেশনাই বাস্তবায়ন হয়নি। কিছু সময় হলেও তা পুরোপুরি থেমে গেছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা যাতে বাস্তবায়ন হয়, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সচেতন ও সিরিয়াস হতে হবে। কোনো ধরনের গাফিলতি করা যাবে না। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করার জন্য আলাদা কমিটি গঠন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও আমলে নেয়া জরুরী। গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি গাড়ির একাধিক মালিকের পরিবর্তে বড় কোম্পানির অধীনে পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে আসা প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক দেশেই মালিকদের সমন্বয়ে বড় কোম্পানি গঠন করে পরিবহণ ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়। এতে চালক ও শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। পরিবহন খাতেও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। সারা দেশের চালকদের সমন্বিত ডাটাবেজ তৈরি করে, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। এতে চালকদের ত্রæটি-বিচ্যুতি দূর এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি সড়কের নিয়ম কানুন মেনে চলার জন্য চালক ও যাত্রীদের বাধ্য করতে হবে। বাংলাদেশে শতকরা ৭০ ভাগ যাত্রী সড়ক পরিবহনে যাতায়াত করে। সড়ক পরিবহনে এত যাত্রী খুব কম দেশেই দেখা যায়। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সড়ক পরিবহনের উপর থেকে চাপ কমাতে হবে। এজন্য রেল ও নৌপথকে আধুনিক ও গতিশীল করার উদ্যোগ নিতে হবে। রেলকে যাত্রীদের কাছে নিরাপদ, আরামদায়ক ও জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। বাংলাদেশে রেলের বিপুল সম্পত্তি ও বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এবং সেবার মান বৃদ্ধি করে যাত্রীদের রেল ভ্রমণে উৎসাহী করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে যাত্রীরা যেমন রেল ভ্রমণে আগ্রহী হয়ে উঠবে তেমনি এ খাতটি ব্যাপক লাভজনক হয়ে উঠবে। নৌপথেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত লঞ্চ ও জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আইনের কার্যকর প্রয়োগ সবসময়ের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। রেল ও নৌ এই দুই যাত্রী পরিবহণ উন্নত করলে সড়ক পথে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন