বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয়

মো. ওসমান গনি | প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

আমাদের সড়ক-মহাসড়কের সর্বত্রই চলছে বিশৃঙ্খলার মহোৎসব। এতে প্রাণ যাচ্ছে একের পর এক। এভাবেই কি দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে মানুষের মৃত্যুর বিভীষিকা চলতে থাকবে? দেশে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে যে, দুর্ঘটনা রোধে হালে বিশেষ বাহিনী গঠনের দাবি উঠছে। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি র‌্যাব বাহিনী গঠন করা যায়, দুর্ঘটনা রোধে এ-জাতীয় বাহিনী নয় কেন? কোনভাবেই তা রোধ করা যাচ্ছে না। সরকারি ও বেসরকারিভাবে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবে কার্যকর করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশের গাড়ি চালকের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা, অতি দ্রæত গতিতে গাড়ী চালানো, ওভারটেক করাসহ বিভিন্ন কারনে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়ে যাচ্ছে। আর এই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আমাদের দেশে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দিক থেকে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বিশ্বের মধ্যে ১৩ তম। বাংলাদেশের উপরে আছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। কিন্তু দেশগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য ১ হাজার ১৩৩ যানবাহন রয়েছে, চীনে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে ১৮ হাজার, ভারতে প্রায় ১৩ হাজার আর পাকিস্তানে পাঁচ হাজার। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি দুজনে একটি করে যানবাহন রয়েছে। অথচ এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা বেশি।
এই প্রেক্ষাপটে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হয়েছে ‘ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মহাসড়কে ২৬০টির বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক আজও সরলীকরণ হয়নি। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয়নি। ৩২লাখ রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত গাড়ির বিপরীতে অবৈধ চালকের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। সড়ক-মহাসড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান রাজনৈতিক কারণে করা সম্ভব হয় না। বিচার হয় না দুর্ঘটনার জন্য দোষী চালকের। এই প্রেক্ষাপটে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে সত্যিই কঠিন তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত তিন কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। ওভারস্পিড, ওভারটেকিং, যান্ত্রিক ও রাস্তার ত্রুটি। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস না পাওয়ার পেছনে রয়েছে নানা কারণ। চালকের লাইসেন্স প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে যানবাহনের ফিটনেস সনদ, গাড়ির অনুমোদন, সড়কের ত্রুটি, সঠিক তদারকির অভাবসহ সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে গলদ।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন সময়ে নানামুখী পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবায়ন গতি খুবই কম। এ নিয়ে প্রতি বৈঠকে হইচই হয়। কিন্তু কাজ হয় না। এটি এখন আনুষ্ঠানিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করলে কখনই সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে না।
মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া গতি। এদিকে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে জাতিসংঘ ঘোষিত ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
উন্নত দেশগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তা খুবই সুনির্দিষ্ট হয়। কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দায়সারা গোছের। কত বছরে কি পরিমাণ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমানো হবে। কীভাবে তা অর্জিত হবে, কারা তা সফল করবে সেটাও ভেবে দেখা দরকার।
স্বল্প ব্যয়ে ফুটপাথ, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, ওভারপাস নির্মাণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া গতি। গতি নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে ছোট যানবাহন বন্ধ ও বেপরোয়া যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরি।
এছাড়া এখনও দেশের সড়ক-মহাসড়কে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে ১০ লাখ নছিমন-করিমন-ইজিবাইক। অবাধে আমদানি হচ্ছে অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা, ইজিবাইক। দেশব্যাপী ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, কভার্ডভ্যান, হিউম্যান হলার অবাধে চলছে। নিবন্ধনবিহীন ৪ লাখ অটোরিক্সা ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে সড়ক-মহাসড়কে। এসব যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান উৎস।
আইন প্রয়োগের দুর্বলতা সড়ক দুর্ঘটনা না কমার একটি বড় কারণ। সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা। চালক-মালিকদের বেপরোয়া মনোভাব এই সেক্টরকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে। সরকার সড়ক নিরাপত্তায় জনবান্ধব যে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে তারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সড়ক নিরাপত্তা আজ মারাত্মক হুমকির মুখে।
অ্যাকশন প্ল্যানের ভূমিকায় বলা হয়, প্রতিবছর দেশে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। পুলিশের পাঁচ বছরের হিসাব অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার ২৮০ জনের মৃত্যু হয়। সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো ওভারস্পীড, ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং। আবার একই সড়কে ছোট-বড়, ধীরগতি ও অতি গতি এবং অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচলের কারণেও সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অসচেতনতা ও প্রয়োগের দুর্বলতাও দুর্ঘটনার কারণ। এছাড়া সড়কে দুর্ঘটনার প্রকৃত তথ্য নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরনের তথ্য প্রকাশ করে।
বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ৯টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, সড়ক-মহাসড়কে মোটর সাইকেলসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বৃদ্ধি, স্থানীয়ভাবে তৈরি দেশীয় ইঞ্জিনচালিত ক্ষুদ্রযানে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, বিধি লঙ্ঘন করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং, জনবহুল এলাকাসহ দূরপাল্লার সড়কে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, দীর্ঘক্ষণ বিরামহীন গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও বেহাল সড়ক, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ।সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করতে হলে সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গাড়ির চালক, মালিক পক্ষসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।যতক্ষন পর্যন্ত দেশের মানুষ সচেতন না হবে ততক্ষন সড়ক দুর্ঘটনা আইন করে রোধ করা যাবে না।সবার আগে আমাদের সকলের মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দুর্ঘটনার কারনে একদিকে চলে যায় মানুষের প্রাণ আর অপরদিকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় গাড়ির মালিক। নষ্ট হয় দেশের সম্পদ।
গত ২৩ জুন দেশের সাত জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ নিহতের ঘটনা ঘটেছে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে। সেখানে বাস উল্টে ১৮ জন নিহত হয়েছে। এ ছাড়া রংপুর, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, নাটোর, গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা ও সাভারের আমিনবাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এর দুই দিন আগে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে পাঁচজন নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো ৩০ জন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও সরব হয়ে উঠেছে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে অনেকেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি তুলেছেন।
একাধিক পরিবহন শ্রমিক বলেছেন, সড়ক-মহাসড়কে এখন প্রচÐ ভিড়। ঈদের ছুটি শেষে মানুষ কর্মস্থলে ফিরছেন। সে কারণে পরিবহনের ওপর চাপ বেড়েছে। ব্যস্ত সময় পার করছেন পরিবহন শ্রমিকেরাও। ঈদের আগে যেসব চালক দিন-রাত গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত হয়েছেন তাদের অনেকেই এখন বিশ্রামে আছেন; যে কারণে অনেক যানবাহন চালাচ্ছেন অদক্ষ শ্রমিকেরা। যাদের অনেকের লাইসেন্স পর্যন্ত নেই। ফলে রাস্তায় দুর্ঘটনাও বেড়েছে।
এ দিকে রাস্তায় একের পর এক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিলের জন্য বিশেষজ্ঞরা অদক্ষ শ্রমিকদেরই দায়ী করলেন। দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে। যাদের দায়িত্ব শ্রমিক তৈরি করা তারা তা করছেন না। সরকারের দক্ষ চালক তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই। সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো সেখানে ব্যর্থ হয়েছে। এ সুযোগে অদক্ষ শ্রমিকেরা গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনা ঘটছে।
লেখক: সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন