বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কারাগারে অমানবিক পরিস্থিতি

| প্রকাশের সময় : ৯ জুলাই, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

কারাগারে নিরাপদে রাখার ও আলোর পথ দেখানোর অঙ্গীকার রীতিমত পরিহাসে পরিণত হয়েছে। কারাগার না নিরাপদ, না সেখানে আলোর পথ দেখানোর কোনো ব্যবস্থা আছে। কারাগার, সন্দেহ নেই, কোনো ভালো জায়গা নয়। তবে যেখানে বন্দীদের মানবিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থাকবে না, সেটা মেনে নেয়া যায় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তো বটেই, এমন কি অটোক্রেটিক রাষ্ট্রেও কারাগারে বন্দীদের মানবিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা দিতে কার্পণ্য করা হয়না। ব্যতিক্রম যেন আমাদের দেশ। বলা হয়, গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়, অথচ এখানে কারাগারের বাইরে যেমন মানবাধিকার লংঘনের নির্বিচার তান্ডব চলছে তেমনি কারাগারেও মানবাধিকার উপেক্ষিত এবং অত্যন্ত নাজুক। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় কারাগারে চরম অবস্থা দেখা দিয়েছে। কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়েছে, ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশী বন্দী কারাগারে মারাত্মক সংকটে পতিত হয়েছে। বন্দীর অতিরিক্ত চাপে অধিকাংশ কারাগারে খাওয়া, শোয়া, চিকিৎসা, পানি ও পয়:নিকাষের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশের ৭০টি কারাগারে বন্দীর ধারণক্ষমতা আছে প্রায় ২৭ হাজার। এর বিপরীতে কারাগারগুলোতে এখন আছে প্রায় ৭০ হাজার বন্দী। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত এত বন্দীর খাওয়া-শোয়া ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া যে কত কঠিন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, একজনের শোয়ার জায়গায় আছে পাঁচ-সাত জন। অনেক সেলে বন্দীদের রাত কাটে না ঘুমিয়ে। এছাড়া মশার উপদ্রব চরম আকার ধারণ করেছে।
কারা প্রশাসন, যে কোনো কারণেই হোক, কারাগারে বন্দীদের সমস্যা-সংকট ও বিপর্যয়কর অবস্থার কথা স্বীকার করতে না চাইলেও কারা অধিদফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, কারাগারগুলোতে বন্দীর সংখ্যা অনেক বেশী হওয়ায় কিছু সমস্যা রয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে কিছু নতুন কারাগার তৈরি করা হয়েছে। তারপরও বন্দীর সংখ্যা বেড়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় অনেকটাই হিমশিম খেতে হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে। বলা বাহুল্য, এই ইশারাই কাফী। এটা ঠিক, দেশে সব ধরনের অপরাধই বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বন্দীর সংখ্যা বাড়া অস্বাভাবিক নয়। তবে এই সময় রাজনৈতিক কারণে বন্দীর সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। দÐপ্রাপ্ত এবং বিচারাধীন বন্দীদের মধ্যে কার সংখ্যা কত, তার স্পষ্ট পরিসংখ্যানে এ মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। তবে ধারণা করি, বিচারাধীন বন্দীর সংখ্যাই বেশি হবে। আবার বিচারাধীন বন্দীদের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে আটক বন্দীর সংখ্যাই বেশী হওয়ার কথা। বর্তমান সরকারের আমলে বিরোধীদল দমন-দলনে হাজার হাজার মামলা হয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীরা অনেকেই এসব মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেছে। বিএনপির অভিযোগ তার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ৭৮ হাজার মামলা হয়েছে এবং এসব মামলায় হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। রাজনৈতিক বন্দীদের সংখ্যা বাড়ার কারণেই যে কারাগারে বন্দীসংখ্যা এত বেড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কারাগারে এখন যে পরিস্থিতি সেটা স্বাভাবিকভাবে বা স্বাভাবিক কারণে সৃষ্টি হয়নি, একথা জোর দিয়েই বলা যায়। এও বলা যায়, এটা সৃষ্টি করা হয়েছে রাজনৈতিক বিরোধীদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করার মাধ্যমে। এটাও স্বীকার করতে হবে, আমাদের বিচার ব্যবস্থা অত্যন্ত ধীরগতির। একবার কেউ মামলায় জড়িয়ে আটক হলে কবে বিচার সম্পন্ন হবে, কেউ বলতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে আবার জামিনযোগ্য মামলায়ও জামিন দেয়া হয়না বা জামিন বিলম্বিত করা হয়। এসব নানাকারণে কারাগারে বন্দীর কমছে না বরং ক্রমাগত বাড়ছে।
যে কারণে হোক, কেউ আটক হলে, কারাগারে বন্দী থাকলে তার মানবিক অধিকার ও মানবিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার খর্ব হয় না। বন্দী থাকা অবস্থায় তার খাওয়া-দাওয়া, নিরাপদে শোয়া, পানি ও পয়:নিকাষের ব্যবস্থা, খেলাধুলা, বিনোদন ইত্যাদির বন্দোবস্ত থাকা অত্যাবশ্যক। বিশ্বের সব দেশেই কারাগারে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে এবং বন্দীদের সুযোগ-সুবিধা গুরুত্বের সঙ্গেই নিশ্চিত করা হয়। কারাগারে কোনোভাবেই যাতে বন্দীদের মানবাধিকার ক্ষুন্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। কারাগারের আদি কনসেপ্ট পাল্টে দেয়ার চেষ্টাও দেশে দেশে চলছে। কারাগারকে মূল্যবোধের শিক্ষালয়, উৎপাদনের কৃৎকৌশলের শিক্ষাকেন্দ্র, এবং উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সঙ্গে বন্দীরা যাতে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ, বিশেষ করে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাৎ করতে বা মিলিত হতে পারে তার সব রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এমন কি কারাগার থেকেও শর্ত সাপেক্ষে বন্দীদের ছুটি দেয়ার বিষয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশে বন্দীরা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। কারাগারে বন্দীদের মানবিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা দেয়ার দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষের হলেও মূলত দায়িত্ব সরকারের। বন্দীরা মানুষ, এই হিসাবেই তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এ দায়িত্বে অবহেলা করতে পারে না। মনে রাখতে হবে, ভালো নজির যেমন ভবিষতে অনুসৃত হতে পারে, তেমনি খারাপ নজিরও। কারাগারে এখন যা হচ্ছে, ভবিষতে হতে পারে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী। আমরা মানবাধিকার সংস্থার ভূমিকায় বিস্মিত। তারা ছোটখাটো অনেক ব্যাপারেই সোচ্চার, অথচ কারাগারে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চুপ। তাদের উচিৎ কারাগারে সরেজমিনে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা এবং এ নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হওয়া। এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের দায়িত্বশীলতা বাড়তে পারে। পরিশেষে আমরা আশা করতে চাই, কারাগারে বন্দীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে অনুসরণীয় নজির সৃষ্টি করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন