আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনের ধকল স্থলভাগে শুধুই নয়, সমুদ্রের প্রাকৃতিক পরিবেশে আরও তীব্রভাবে গিয়ে পড়ছে। বঙ্গোপসাগরে মাছের শারীরিকতন্ত্র তথা অস্তিত্ব, প্রজনন ও বংশ বিস্তার ব্যাহত হচ্ছে। কমছে ন্যুনতম মজুদ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের পানিতে লবণাক্ততার হার ও তাপমাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর হ্রাস পাচ্ছে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। যেসব মৎস্য প্রজাতি তাপমাত্রা ও অক্সিজেনের মাত্রায় অস্বাভাবিক হেরফেরে সহ্যক্ষমতা কম বা দুর্বল সেসব মাছ বাঁচার তাগিদে অন্যত্র চলে যেতে পারে। সমুদ্রের উপরিভাগে তাপমাত্রা বেশী ও গভীরের দিকে তুলনামূলক কমে যাচ্ছে। এতে করে সামুদ্রিক জলরাশির স্বাভাবিক সার্কুলেশন উপর-নিচ ঘূর্ণন কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এরফলে মাছসহ প্রাণিজগতের চলাচলের উপযোগী জায়গা ছোট হয়ে আসছে। মাছেরা সীমিত জায়গায় আটকে গিয়ে বৈরী পরিস্থিতির মুখে পড়ছে। অব্যাহত দূষণে পানির গুনাগুণ ও মৎস্যরাজির খাদ্যের উৎসগুলো বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বঙ্গোপসাগরের মৎস্যসম্পদ বিপন্ন হওয়ার মুখে রয়েছে।
উপরোক্ত অভিমত ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স এন্ড ফিশারিজের অধ্যাপক ড. হোসেন জামাল। বঙ্গোপসাগরের মৎস্যসম্পদের ওপর আবহাওয়া-জলবায়ুর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, সাগরের মৎস্য ও প্রাণিজগতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব অবশ্যই রয়েছে। সামুদ্রিক মাছ প্রাকৃতিক উৎস থেকে খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সেই খাদ্য-শৃঙ্খল বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাছের পুরো খাদ্যচক্রের ওপর পড়ছে প্রভাব। এতে করে মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সাগরে মাছের স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধির জন্য যে মজুদ দরকার তা কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে বঙ্গোপসাগরের পানিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্রবীভূত হচ্ছে বেশি মাত্রায়। আর এতে ক্ষতিকর কার্বলিক অ্যাসিড তৈরি হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বিচরণ ও খাদ্য প্রক্রিয়া বিঘিত হয়।
সাগরে অব্যাহত দূষণের প্রভাব প্রসঙ্গে ড. হোসেন জামাল বলেন, রাসায়নিক সার, কীটনাশক দ্রব্য ও বিভিন্ন অর্গানিক দূষণের কারণে সমুদ্রে ক্ষতিকর নতুন নতুন সব ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। সেগুলো সাগরতলের অক্সিজেন খেয়ে সাবাড় করে ফেলছে। অন্যদিকে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের স্বাভাবিক মাত্রা কমে যাচ্ছে। তিনি জানান, জ্বালানি তেল বা পোড়া তেল, প্লাস্টিক ও পলিথিন জাতীয় দ্রব্য প্রভৃতি সাগরের পানিতে গিয়ে দূষণ বৃদ্ধি করছে। ভাসমান তেলের কারণে সাগরের উপরিভাগে বাতাস থেকে অক্সিজেন মিশতে গিয়ে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। তাছাড়া টুনা জাতীয় সাগরতলের অনেক জাতের মাছ বৈরী পরিবেশে টিকতে না পেয়ে অন্যত্র সাগর-মহাসাগরের দিকে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে।
এদিকে ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের সীমানায় মৎস্যসম্পদের মজুদ বা স্থিতি, প্রজাতি, প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র নিরূপনের লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে জরিপ ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) জরিপে বঙ্গোপসাগরকে ‘মৎস্য খনি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের পানিসীমা প্রসারিত হয়ে এখন আয়তন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার। যা মূল্যবান মৎস্য, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার। তবে জলবায়ুর নেতিবাচক ধারায় পরিবর্তন এবং নানামুখী দূষণের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের অর্থকরী মাছসহ প্রাণিজগত বিপন্ন হতে চলেছে। সমুদ্র উপকূলীয় জেলেদের জালে আগের তুলনায় মাছ শিকার হয়না। সাগরে দেশীয় ট্রলার নৌযান দশ বছর আগেও ৪/৫ দিনের ট্রিপে গিয়ে যেখানে ৮ থেকে ১০/১২ মণ মাছ আহরণ করতো আজকাল এক সপ্তাহের ট্রিপে গিয়েও তার অর্ধেক পরিমাণে মাছ পেতে হিমশিম খেতে হয়। অগণিত জেলে মাঝি-মাল্লা বেকার অথবা অর্ধ-বেকার হয়ে দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছে। অনেকেই পিতৃপুরুষের পেশা ছেড়ে দিয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের কিনারে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেই বর্তমানে সামুদ্রিক মাছের মাছের যোগান বাজারে কমে গেছে।
বঙ্গোপসাগরে জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণে বিরূপতার পাশাপাশি ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ফিলিপাইন থেকে চোরা শিকারী ট্রলার-নৌযানে বিভিন্ন জাতের মাছ চুরি ও লোপাট হচ্ছে। অপরিকল্পিত মাছ শিকারের ফলে বংশ বিস্তার, বিচরণ, প্রজনন অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সাগরে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের টহল তৎপরতা বৃদ্ধি ও এরজন্য আধুনিক প্রযুক্তির জাহাজ সংগ্রহের ফলে বিদেশী ট্রলারের অনুপ্রবেশ ও মাছ চুরি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
‘মৎস্য খনি’ বঙ্গোপসাগরে ৩৬ প্রজাতির চিংড়িসহ ৪শ’ ৭৫ প্রজাতির অর্থকরী মাছের বিচরণশীলতা এবং ক্ষেত্র খুঁজে পায় বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ বিভিন্ন জরিপ-গবেষণায়। সাগরে মাছের মূল তিনটি বিচরণ অঞ্চল হচ্ছে ‘সাউথ প্যাসেচ’, ‘মিডলিং’ বা ‘মিডল গ্রাউন্ড’ এবং ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন