গ্রাহকদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
প্রতি মিনিট কলচার্জ ১০ পয়সা করার দাবি সিটিজেন রাইটস মুভমেন্টের
গ্রাহক নয় অপারেটরদের স্বার্থ বিবেচনা করা হয়েছে : মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন
সব অপারেটরে অভিন্ন কলরেট চালু করার কথা বলে মোবাইল ফোন গ্রাহকদের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। গত ১৩ আগস্ট মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে কলরেট বাড়ানোর নির্দেশনা দেয় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ি অননেটে (একই অপারেটরের নম্বরে) পূর্বের ২৫ পয়সা থেকে ২০ পয়সা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ৪৫ পয়সা। অন্যদিকে অফনেটে (ভিন্ন অপারেটরের নম্বরে) কথা বলার জন্য ১৫ পয়সা কমিয়ে প্রতি মিনিট নির্ধারণ করা হয় ৪৫ পয়সা। এর আগে একই অপারেটরে ফোন করলে এই চার্জ ছিল মিনিট প্রতি ২৫ পয়সা। আর অন্য অপারেটরে সর্বনিম্ন কলচার্জ ছিল মিনিট প্রতি ৬০ পয়সা। দৃশ্যত অননেটে কথা বলার খরচ বেড়ে যাওয়া এবং অফনেটে কমে যাওয়ার হিসেব দেয়া হলেও গ্রাহকদের কাছে বাড়তি খরচ হিসেবে দেখা দিয়েছে নতুন কলরেট।
যে সব গ্রাহক সাধারণত একই অপারেটরে ফোন করে থাকেন তাদের কারো কারো ফোন বিল ৮০ শতাংশের মতো বেশি বেড়ে গেছে। তাই অনেকের মতে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর দেওয়া নির্দেশনাটি গ্রাহকদের পক্ষে যায়নি। এমনকি, কারো অভিমত- সরকারি সংস্থার এমন সিদ্ধান্ত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার যে লক্ষ্য এর বিরুদ্ধেও গিয়েছে। নতুন কলরেট বাস্তবায়নের ঘোষণার পর থেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন গ্রাহকরা। অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, রাজপথে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন সব জায়গায় এই কলরেট বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন গ্রাহকরা। সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নিয়ামুল আজিজ সাদেক নামে এক ফেইসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন ‘১ মিনিটে দুই টাকায় কি পোষায় আপনাদের? আরো দাম বাড়ান গ্রামীণফোনের ১০ টাকার যুগে ফিরে যাই। বিটিআরসিকে অসংখ্য ধন্যবাদ সাহসী উদ্যোগ নিয়েছেন। এটাই তো আপনাদের প্রধানতম কাজ হওয়ার কথা ছিল,গ্ধকলরেট বাড়ানোগ্ধ। ইমান উদ্দিন ইমন লিখেছেন, সর্বনিম্ন কলরেট বিটিআরসির বেধে দেয়ার দরকার কী? এটা কোম্পানীগুলোর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা ছাড়া আর কিছুনা। কেউ কেউ লিখছেন স্যাটেলাইট পাঠানোর প্রথম সুফল হিসেবে কলরেট বেড়েছে, এটাই হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। আবার অনেকেই কলরেট বাড়ানোর প্রতিবাদে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে প্রতিবাদ জানানোর ম্যাসেজ দিচ্ছেন।
রাজধানীর পূর্ব কাজীপাড়ার গৃহকর্ত্রী রিফাত জাহান আগে ১০ মিনিটের টকটাইম কিনতেন ৩ টাকা ৮৫ পয়সায়। কিন্তু, গত ১৩ আগস্টের পর থেকে তাকে তা কিনতে হচ্ছে ৫ টাকা ৭০ পয়সায়। তিনি বলেন, “হঠাৎ আমার ফোন কলের খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বিটিআরসির কলরেট নির্ধারণকে ‘হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেছেন সিটিজেন রাইটস মুভমেন্টের মহাসচিব তুষার রেহমান। তিনি বলেন, কলরেট বিষয়ে বিটিআরসির ভাষ্য শুনলে মনে হয়, তারা মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাণিজ্যের অংশীদার বৈ কিছু নয়।
দেশের মানুষ সাধারণত অননেটে কথা বলার ক্ষেত্রেই বেশি অভ্যস্ত। খরচ কমানোর জন্য পরিবারের সদস্যদের একই অপারেটরের ফোন ব্যবহার করে থাকেন এবং ওই অপারেটরের দেয়া সর্বনিম্ন কলরেট ২৫ পয়সা, ফ্রেন্ডস এন্ড ফ্যামিলি প্যাকেজের মাধ্যমে সুবিধা নিতেন তারা। অভিন্ন কলরেট পদ্ধতি চালু হওয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এসব গ্রাহকরা। এখন একটি কলের সর্বনিম্ন চার্জ যদি ৪৫ পয়সা হয় তাহলে তা ভ্যাট, সম্প‚রক শুল্ক ও সাজচার্জসহ গিয়ে দাঁড়ায় ৫৫ পয়সায়।
বিটিআরসির এই সিদ্ধান্তের ফলে অনেকে এখন মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে ইন্টারনেট কলের মাধ্যমে কথা সেরে নিচ্ছেন। গ্রাহক সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন। সেই অপারেটরের গ্রাহকরা এই সিদ্ধান্তের অসুবিধা বেশি ভোগ করায় এখন দেখা যাচ্ছে প্রায় ৯০ শতাংশ ফোন কল তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে দিচ্ছেন। তবে অপেক্ষাকৃত ছোট অপারেটররা অভিন্ন সর্বনিম্ন কলরেট থেকে সুবিধা পাবেন বলে বিটিআরসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তার অভিমত। সংস্থাটির মতে, অভিন্ন কলরেটের লক্ষ্য হচ্ছে সব অপারেটরদের জন্যে সমান প্রতিযোগিতাম‚লক বাজার সৃষ্টি করা। এর ফলে গ্রাহকরাও ভুতুড়ে বিলের হাত থেকে রক্ষা পাবেন।
এছাড়াও, সব ধরনের ফোন কলের মধ্যে সমতা আনার জন্যেই অভিন্ন সর্বনিম্ন কলরেটের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান সংস্থাটির কর্তাব্যক্তিরা। তাদের দাবি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফোন কলের খরচ কমে যাবে। বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জহুরুল হক বলেন, “এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃত প্রতিযোগিতা শুরু হবে। তবে এর ফলে যদি গ্রাহকদের খরচ বেড়ে যায় তাহলে যে কোনো সময় সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা যাবে।”
এদিকে কলরেট বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে গ্রাহকদের সংগঠনগুলো। দেশের সব মোবাইল ফোন অপারেটরের মিনিট প্রতি কলচার্জ ১০ পয়সা করার দাবি জানিয়েছে সিটিজেন রাইটস মুভমেন্ট। বিটিআরসি সব মোবাইলের জন্য প্রতি মিনিট সর্বোচ্চ ২ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৪৫ পয়সা ট্যারিফ নির্ধারণের পর গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানায় গ্রাহকদের সংগঠনটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান সিটিজেন রাইটস মুভমেন্টের মহাসচিব তুষার রেহমান। বিটিআরসির সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদও এতে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, কখনও কলরেট বাড়িয়ে, কখনও নানা প্যাকেজের ‘ফাঁদে’, কখনো বা ভিওআইপি ব্যবসার ফাঁকে মোবাইল ফোন অপারেটররা বিদেশে ‘প্রায় ৫ লাখ কোটি’ টাকা পাচার করেছে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার অভিযোগ তুলে তা তদন্তের দাবিও জানায় সংগঠনটি। মোবাইল ফোনের কল চার্জ বিষয়ক গবেষণার জন্য বিটিআরসি একসময় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রাইস ওয়াটার হাউজ কুপার্সকে দায়িত্ব দিয়েছিল।
তবে হাউজ কুপার্সের ‘সঠিক প্রতিবেদন’ প্রকাশিত হয়নি বলে জানিয়ে মার্গুব মোর্শেদ বলেন, আমাদের দেশের ন্যাশনাল অডিট হাউজই এই কাজ করতে পারবে। তারাই বের করতে পারবে কত টাকা ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে, কত টাকাই বা দেশ থেকে বেরিয়ে গেছে। দরকার নেই হাউজ কুপার্সের। সংবাদ সম্মেলনে তুষার রেহমান দুই দশকে মোবাইল ফোন অপারেটটরা কত টাকা বিদেশে নিয়েছে, তা নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানান।
এদিকে কলরেট বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক দাবি করে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে সংগঠটির সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন গ্রাহকদের স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে শুধুমাত্র অপারেটরদের স্বার্থ বিবেচনা করে ভয়েস কলের ফ্লোর রেটের কল রেট ২৫ পয়সা থেকে বৃদ্ধি করে ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করেছে। এ ধরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার পূর্বে গ্রাহকদের মতামত নেয়া উচিৎ ছিল। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ফলে গ্রাহকদের ব্যায় বৃদ্ধি পাবে বৈ কমবে না। তিনি বলেন, বর্তমান রেটে অপারেটর, আইসিএক্স, আইজডব্লিউ, এনটিটিএন এর ভ্যাট যোগ করলে কলরেট দাঁড়াবে প্রায় ৫২ পয়সা যা পূর্বের অফনেটের ফ্লোররেটের সমান। এই কলরেট বৃদ্ধির ফলে অপারেটররা সাময়িকভাবে লাভবান হলেও ভবিষ্যতে গ্রাহকরা বিকল্প পথে কথা বলা শুরু করলে অপারেটরা ব্যবসায় বিনিয়োগ হারাতে পারে।
সিপিবি’র সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, শুধুমাত্র অপারেটরদের আবেদনের প্রেক্ষিতে লোকচক্ষুর অন্তরালে এই মূল্যবৃদ্ধি মেনে নেওয়া যায় না। অতিদ্রুত মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করে জনগণের কাছ থেকে নেয়া অতিরিক্ত অর্থ জনগণকে ফেরত প্রদান করার দাবি জানান।
বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, নতুন এই কলরেটের ফলে গ্রাহকের পকেট থেকে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হবে। তাই মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে সরকারকে দ্রুত নতুন কলরেট বাতিল করা আহ্বান জানান।
বিটিআরসির হিসাবে দেখা যায়, গত জুন পর্যন্ত দেশে সচল ফোন সংযোগ রয়েছে ১৫ কোটি নয় লাখ। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের রয়েছে ছয় কোটি ৯২ লাখ, রবির চার কোটি ৪৭ লাখ, বাংলালিংকের তিন কোটি ৩৩ লাখ এবং টেলিটকের ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার। মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গ্রামীণফোন থেকে ৯০ শতাংশ কল হয় অননেটে, ১০ শতাংশ কল অফনেটে হয়। অন্যদিকে, সরকারের মালিকানাধীন অপারেটর টেলিটকের ১০ শতাংশ কল অননেটে ও ৯০ শতাংশ কল অফনেটে হচ্ছে। রবি ও বাংলালিংকের অননেট-অফনেট কলের পরিমাণ ৭০ ও ৩০ শতাংশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন