রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলছেই

| প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ট্রাফিক সপ্তাহসহ নানা উদ্যোগের পরও দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল চলছেই। দেখা যাচ্ছে, কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনই ঘটেনি। অবস্থা যথা পূর্বং তথা পরং। ঈদের ছুটির মধ্যেই গত শনিবার নাটোরে একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২৭ জন। নিহতরা সবাই লেগুনার যাত্রী। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দুর্ঘটনায় চালকও নিহত হয়েছে। নাটোরের পৃথক দুর্ঘটনায় আরো একজন নিহত হয়েছে। এছাড়া একই দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় আরো কয়েকজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক। গত সোমবার ভৈরব থেকে ঢাকাগামী একটি যাত্রীবাহী বাসের সাথে নরসিংদীতে একটি লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয় ১৩ জন। তারাও সবাই লেগুনার যাত্রী। লক্ষ্য করার বিষয়, সড়ক-মহাসড়কে ঘটা দুর্ঘটনা একটা বড় অংশের সাথেই জড়িত ছোট আকারের যানবাহন। এদের মধ্যে রয়েছে, মাইক্রোবাস, ব্যক্তিগত গাড়ি, তিন চাকার যানবাহন, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, রিকশা, নসিমন, করিমন, ভটভটি ইত্যাদি। এদের সাথে ঘটা দুর্ঘটনায় যারা হতাহত হয়েছে তাদের প্রায় সবাই এদের যাত্রী। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত সাত দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১০৯ জন, যাদের মধ্যে ৬৮ জনই ছোট আকারের যানবাহনের যাত্রী বা চালক। আর ৩৩টি দুর্ঘটনার সঙ্গেই এসব যানবাহন জড়িত। সড়ক-মহাসড়কে দ্রুতগতিসম্পন্ন বাস-ট্রাকের সাথে ছোট আকারের যানবাহনের সংঘর্ষ হলে ছোট আকারের যানবাহনের আসলে কোনো অস্তিত্বই থাকে না- ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায় এবং এদের যাত্রীরাই মূলত হতাহতের শিকার হয়। মহাসড়কে চলা হিউম্যান হলারগুলোকে ‘মুভিং কফিন’ বলে অভিহিত করেছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তার এ কথার সত্যতা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রমাণিত।
একথা ঠিক, ঈদের সময় সাময়িক জনস্থানান্তর ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। এসময় সড়ক-মহাসড়কগুলোতে যানবাহেনর সংখ্যাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। ফলে অন্যান্য সময়ের চেয়ে এ সময় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানিও বেড়ে যায়। কিন্তু সেই বাড়া কি এত বেশি? সাত দিনে ৫২ দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি ১০৯ জন? স্মরণ করা যেতে পারে, গত ঈদের সময় ১৩ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় চার শতাধিক লোক প্রাণ হারায়। এ তথ্য যাত্রী কল্যাণ সমিতির। যদিও এ তথ্য অতিরঞ্জিত বলে দাবি করে সরকার। সংখ্যার সামান্য হেরফের হতে পারে বটে তবে নির্দিষ্ট কয়েক দিনে এত লোকের প্রাণহানি কোনো বিবেচনাতেই মেনে নেয়া যায় না। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ ও সমীক্ষায় দেখা গেছে, অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য চালকই দায়ী। এ ছাড়া ভাঙাচোরা সড়ক, অপরিকল্পিত সড়ক, সড়কে একের পর এক বাঁক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়ক দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা ও বাজার-হাট নির্মাণ, অসম গতির যানবাহনের একই সঙ্গে চলাচল ইত্যাদিও দুর্ঘটনার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর দেশজুড়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে তাতে স্বভাবতই আশা করা হয় যে, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি অতঃপর কমবে। চালকদের মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে এ আন্দোলন কোনো ফলপ্রসূ ভ‚মিকাই রাখতে পারেনি। ঈদের আগে-পরে সংঘটিত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানিই তার প্রমাণ বহন করে। সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর দেয়া তথ্য মতে, দেশে গাড়ি আছে ৩৫ লাখ। আর চালক আছে ১৮ লাখ ৭০ হাজার। অর্থাৎ চালকের ঘাটতি রয়েছে ১৬ লাখ ৩০ হাজার। অথচ ৩৫ লাখ গাড়িই সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করছে। নিশ্চয়ই চালক ছাড়া গাড়ি চলছে না। এ থেকে বোঝা যায়, বিপুল সংখ্যক গাড়ি চলছে অদক্ষ ও আধাদক্ষ চলকদের দ্বারা। অদক্ষ ও আধাদক্ষ চালকদের দ্বারা দুর্ঘটনা ঘটানো মোটেই অস্বাভাবিক নয়। চালক মাত্রেরই দক্ষতা ও পূর্ণাঙ্গ ট্রাফিক আইন জানা থাকা দরকার। যতদিন সেটা নিশ্চিত করা না যাচ্ছে ততদিন দুর্ঘটনা কমার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। দুর্ঘটনার জন্য যাত্রী বা পথচারীদের অসতর্কতা ও অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। দেখা গেছে, তারা অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। কখনো অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে তারা ঝুঁকি নেয়, কখনো পথ চলতে গিয়ে অসতর্কতা প্রদর্শন করে। ন্যূনতম ট্রাফিক বিধিও অনেকে মানতে চায় না। দুর্ঘটনা হ্রাসে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যাবশ্যক হলেও তার ঘাটতি রয়েছে।
যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ অসম গতির যানবাহনের একই সড়ক-মহাসড়কে চলাচল, সুতরাং যতদিন এই ব্যবস্থা চালু থাকবে ততদিন দুর্ঘটনার সংখ্যা কমানো যাবে না। জানা যায়, সারাদেশে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশার সংখ্যা ১০ লাখের ওপর। এই সঙ্গে রয়েছে নছিমন, করিমন, ভটভটি ইত্যাদি নামের আরো যানবাহন। এগুলো সড়ক-মহাসড়কে বিনা বাধায় চলাচল করছে এবং যখন তখন দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে বা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। ২০১৫ সালে দেশের ২২টি মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে সরকার। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও আছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, এই নিষেধাজ্ঞা ও নির্দেশনা আজো কার্যকর হয়নি। তিন চাকার যানবাহনসহ অসংখ্য ধীরগতির যানবাহন দাপটের সঙ্গেই সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করছে। চলছে আর দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে এবং মানুষ মারা যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে অবশ্যই সড়ক- মহাসড়ক থেকে ধীরগতির যানবাহন সম্পূর্ণ বিদায় করে দিতে হবে। একই সঙ্গে সড়ক-মহাসড়কে লেন বাড়িয়ে কোন ধরনের যানবাহন কোন লেন দিয়ে চলাচল করবে তা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ট্রাফিক বিধি অনুসরণে যানবাহন চালককের বাধ্য করতে হবে। দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমাতে পরিবহন ব্যবস্থপনা ও সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নত করার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প¦ নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন