শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

আতোভা

প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শাওন আসগর
শেষ পর্যন্ত শাহানা পারভীন স্বামীকে ডিভোর্স করে ছাড়লো। অতো বছরের সংসারে নিজের বেলাল্লাপনা, অসময়ে অনেক রাত করে ঘরে ফেরা এবং সন্দেহজনক মুভমেন্টকে প্রতিবাদ করায় ওদের আর চলছিল না। নিজের সব দোষ আড়াল করে উল্টো স্বামীর ওপর চাপিয়ে সংসারে সব বাঁধন ছিন্ন করে শাহানা পারভীন নিজের তিনসন্তান নিয়ে স্বামীর কেনা বাড়ি দখল করে স্বামীকেই বিতাড়িত করে ছাড়লো। এজন্য তার সহায়ক ভূমিকায় ছিল মাস্তান ভাইয়েরা এলাকার তিন-চারজন পে করা উঠতি বয়সের ছোকরা।
তানভীর হায়দার আসলে নিজেও খুব ফেডআপ ছিলো জীবন নিয়ে। অনেক চেষ্টা করেছে স্ত্রীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। এ নিয়ে পরিবারিক দেন-দরবার কম হয়নি। কোনো কাজ হয়নি, অশান্তির জট খুলতে সবাই ব্যর্থ হয়েছে বরং নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার কারণে তানভীর হায়দারের ওপরই দোষ চাপে বেশি।
নারীর স্বাধীনতা যদি স্বামীর অবাধ্য হয়ে অধিক রাতে ঘরে ফেরা হয়, নানারকম পুরুষের সাথে অবাধে চলাফেরা হয়, গান-বাজনার আড্ডায় নিজের সন্তানদের আধুনিক পোশাকের নামে যৌন আকর্ষণের গোপন বাসনা নিয়ে এখানে সেখানে গিয়ে তাদের পড়াশোনার ক্ষতি করা হয় তো ওই নারী স্বাধীনতাকে তানভীর হায়দার ঘৃণা করে বলে প্রতিবাদ করেছে সারাজীবন। অমনি সবাই হামলে পড়েছে তার ওপর।
সবার কথা নারীকে আরো স্বাধীনতা দিতে হবে। নারী এখন অনেক পথ চলতে শিখেছে। নারী এখন ফেসবুকে পুরুষাঙ্গ এবং অ-কোষ নিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছে এবং নারী তার শরীরের বিভিন্ন ছিদ্রপথ নিয়ে খোলামেলা মন্তব্য করছে- এই হলো নারী স্বাধীনতা। নারী এখন শরীরের যৌনাঙ্গ ও বিভিন্ন অঙ্গের বিবরণ তার মেয়ে, ননদ, জা, ভাবি এবং নিজের ছেলে স্বামী ও দেবর-ভাসুরদের কাছে খোলা আলোচনায় প্রশান্তি পায় ও পুলকিত হয়।
না। এসব ভালগারিটিকে তানভীর সাপোর্ট করতে পারেনি বলেই দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে এবং সকলের কথা মতোই নিজের কাঁধে দোষ নিয়ে মুক্ত হয় চৌদ্দ বছরের কারাবাস সংসার থেকে।

দুই।
জীবনের এ এক অস্থিরতা আর দুঃখময় সময় তার কাটে না। চৈত্রের প্রচ- দহন বা কালবোশেখির অপ্রতিরোধ্য ঝড় এসে মাঝে মাঝে জীবনকে এলোমেলো করে দেয় আবার কিছুটা শান্ত হলে জীবনের রুটিন পাল্টে সচল হয়। এক প্রচ- মানসিক শক্তির ওপর ভর করে তানভীর দাঁড়াতে চায়। ঝড়ের গতি জীবনের সব শেষ করে দিতে পারে না। রাতের আঁধার বেশি দীর্ঘস্থায়ী নয় সূর্য উঠবেই- এসব মনের ভেতর গেঁথে নিয়ে তানভীর জীবনের আরেক অধ্যায়ে ঢুকে পড়ে।
এক শারদীয় অনুষ্ঠানে পাবলিক লাইব্রেরিতে পরিচয় হয় মুমুর সাথে। গানে গানে সুরের মূর্চ্ছনায় পুরো লাইব্রেরি যখন পিনপতনে মগ্ন তখন বার বারই চোখ পড়ছিলো মুমুর ওপর। অনুষ্ঠানের পর বাইরে দাঁড়িয়ে পরিচয় হলে মনে হলো মুমু অতীব ভদ্র ও শিক্ষিত। কথায় কথায় লক্ষ্য করে ওপরের বৃক্ষের শাখা থেকে ওদের মাথায় পড়ে কটি ফুলের পাপড়ি। বিষয়টিকে দুজনেই শুভ মনে করে হেসে ওঠে।
অতো বছরের সংসার করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে এই মেয়েটির ভেতর কোনরূপ উগ্রতা-চটুলতা নেই, আভিজাত্যের বাড়াবাড়ি নেই। ছেলে পটানোর কোন টেক্নিকও তার চোখে ধরা পরেনি।
চলছে তানভীরের সাথে মুমুর মধুর ও সুন্দর সময় কাটানো-বেড়ানো। অথচ কেউ কাউকে বলেনি জীবনের পরবর্তী সময়ে কি ঘটতে পারে বা কী করা উচিত। মেয়েটি জানে তানভীরের সব ঘটনা। অন্তত এই কারণেই সে তানভীরের প্রতি বেশি দুর্বল যে তানভীর কিছু লুকায়নি তার কাছে। আসলে এটুকুন সততা তানভীর সারাজীবন মেনটেইন করে এসেছে। নিজের টাইমিং শ্রম আর কমিটমেন্ট সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দিয়ে দাঁড়িয়েছে এক উঁচু জায়গায়। সে নিজেকে যেমন সফিস্টিকেটেড ভাবে, সৎ ভাবে- তেমনি পাশাপাশি যে চলবে তার কাছ থেকেও এমনটি আশা করে। তার দরকার কথা, শালীনতা, সময়ের মূল্য এবং পরিশ্রমের যথাযথ মূল্যায়ণ। এভাবেই মুমুর সাথে সুখকর দিন যাচ্ছে।
মুমু একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
মুমু কোনদিনই হয়তো তার বাবা মাকে তানভীরের কথা বলেনি। কিন্তু হাসপাতালে সে না গিয়ে পারেনি। ওখানে সবার সাথে অপ্রত্যাশিত পরিচয় হলেও সবাই ওকে ভালোভাবেই অ্যাকসেপ্ট করে। প্রতিদিনই তানভীর হাসপাতালে গিয়ে মুমুর পরিচর্যা খোঁজখবর নেয়। তার কেয়ারিং এ কোন কার্পণ্যতা সে করেনি। মুমু ছাড়াও পরিবারের অন্যরাও তানভীরের কাছে এসে গেছে এমন পরিস্থিতিই ঘটে যাচ্ছে দিন দিন। তবে তানভীর জানে এটি কোন প্রেম নয় ¯্রফে ফ্রেন্ডশিপ রিলেশান।
কারণ ফেসবুকে ওর নিউ ফ্রেন্ড ঝুমুরের সাথে যেসব চ্যাট হচ্ছে তাতে ঝুমুরকে নিয়ে হয়তো কিছু প্রত্যাশা করা যায়। ঝুমুর ও বেশ পোলাইট এন্ড এডুকেডেট। ওর বয়সের বিষয়টিও অ্যাকসেপ্টেবল। চ্যাট করার সময় ওর মোবাইল নাম্বার থ্রো করলে পরবর্তী সময় মোবাইলেই কথা হয়। এসবই মুমুকে বলা হয়েছে। জানানো হয়েছে একজন আদর্শবান মানুষের জীবনে ভালোকিছু লুকানোর প্রয়োজন নেই। সংসার জীবনে সামাজিক জীবনের পরিম-লে অনেকের সাথে সম্পর্ক হতে পারে তবে তা হতে হবে শালীন পরিমিত এবং অবশ্যই বিশ্বস্ততাপূর্ণ।
মুমু ওসবে ভয় পায় না। কারণ সে বিশ্বাস করে নিয়েছে তানভীর অনেক ভালো মানুষ। অনেক বড়ো মনের না হলে জীবনের সবকিছু কেউ বলতে পারে না।
অথচ কী কারণে হুট করেই একদিন মুমু বিয়ের ডিসিশান নিয়ে ফেলে কিন্তু যেটি করেছে-সে এসব আপাতত পরিবারের কাউকে জানাবে না কারণ তানভীরের আগের জীবনের কথা শুনলে বাবা-মা আহত হবেন বা এই বয়সে সামাল দিতে কষ্ট হবে।
তবু বার বার তানভীর মুমুকে রিকোয়েস্ট করেছে আরো ঠা-া মাথায় বুঝে শুনে পা বাড়াতে। বলতে চেয়েছে- মুমু, আমি চুন খাওয়া মুখপোড়া মানুষ। আমার জীবনের দীর্ঘ পথ খুবই জটিল আর বিপত্তিতে ভরা।
-আমি সব বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বিশ্বাস অর্জন করেছি তোমাকে নিয়েই চলতে পারবো।
-মুমু, আমাদের বয়সে গ্যাপ অনেক।
-এটা কোন ফ্যাক্টর নয়। আর অতো বুঝাতে হবে না। আমি তো ছোট না। ভার্সিটি তো পার করেছি নাকি?

তিন।
ঝুমুরের চেহারা মনে হয়। ওর সাথে বলা কথোপকথন, গানের সুর, ওর মন খোলা হাসির রিনিঝিনি ধ্বনি সব মনে হয়। ওর বয়স এবং অন্যান্য সবকিছু মিলিয়ে তানভীর আশা করেছিল যদি বিয়ে করতে হয় তবে তাকেই করা যায়। কিন্তু ঝুমুর তো বলেনি কোনদিন যে সে তাকে ভালোবাসে। তানভীর আশা করেছিলো ঝুমুর তাকে অফার করুক। মনে মনে অনেকটা প্রস্তুতিও ছিলো তার।

চার।
কথামতো মুমুর সাথে টিএসসির ক্যাফেটেরিয়া দেখা হলো।  কফি গিলে মিনিটপাঁচেক এলোমেলো পায়চারী। পাশে রিকশার টুটাং শব্দ, অদূরে কজনের মিছিলের স্লোগান। অপরাজয়ের চারপাশে জড়ো হয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। ভিসির বাড়ির পাশের পুলিশের প্রহরা। ভিসির নিরাপত্তা জোরদার হলেও আর সব মানুষের জীবন অনিরাপদ দিন দিন। হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও গুমের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিদিন। ‘বন্ধু পুলিশ’ এখন ‘শত্রু’ নামে পরিচিত হচ্ছে জনগণের কাছে।
শেষ পর্যন্ত মুমুর সাথে যুক্তিতর্ক সব মিলিয়ে আরেকটি জীবনের অধ্যায় শুরু করতে ওরা কাজী অফিসে ঢুকে পড়ে। সাথে আরো দুজন বন্ধুকে নিয়েছিলো। বিয়ে পড়ানো শেষ হলে তানভীর কাগজে স্বাক্ষর করবে অমনি মোবাইলে একটি মেসেজ টোন বেজে ওঠে।
ঝুমুরের মেসেজ : হ্যালো ডিয়ার. উইল ইউ মেরি মি? আমি তোমাকে ভালোবাসি। আতোভা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন