শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথাযথ ব্যবহার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৯ এএম

এক

সরকারি পদ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথাযথ ব্যবহার একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উপাদান। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর রাষ্ট্র পরিচালনার ভার থাকে বিধায় তাদের মধ্যে স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মহানবী (সাঃ) সরকারি পদ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার শিক্ষা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তার নির্দেশিত শিক্ষা বর্ণনার উদ্দেশ্যে এ প্রবন্ধে সরকারি পদ বা মানসির এর পরিচয়, এ সম্পর্কে ইসলামের দর্শন, তার যুগে সরকারি পদ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সরকারি পদ ও সম্পদের দায়িত্ব অর্পণ করার শর্তাবলি, পদের অধিকার ও সম্পদের দায়িত্বশীলদের বৈশিষ্ট্য, সরকারি পদ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মৌলিক নীতি ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর শিক্ষার আলোকে প্রত্যেক সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে আল্লাহর আদালতে জবাবদিহিতা করতে হবে। এ অনুভুতি জাগ্রত করেই তিনি ঐসব সাহাবীর মধ্যে সরকারি পদ বণ্টন করেন, যাদের উক্ত পদ গ্রহণের প্রতি কোন আকাক্সক্ষা ছিলো না। ইসলামের আলোকে কাউকে সরকারি পদে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে তার মধ্যে অবশ্যই নির্ধারিত গুণাবলি থাকতে হবে এবং তাদেরকে অবশ্যই নির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে পরিচালিত হতে হবে। ইসলাম এ শিক্ষাও দিয়েছে যে, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সবসময় রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদকে নিজ মালিকানাধীন সম্পদের ন্যায় মনে করা ও নিজ প্রয়োজনে ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই।
মহান আল্লাহ তার রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে বলেন: নিশ্চয় তোমাদের জন্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) –এর জীবনে উত্তম আর্দম রয়েছে, এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ করে। মুফাসসিরগণের মতে, এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে পঞ্চম হিজরীতে আহযাব যুদ্ধের সময়। এর তাফসীরে হাফিয ইবনে কাছীর বলেন, আয়াতটি রাসূলে কারীম (সাঃ) এর উত্তম আর্দশ অনুসরণের মৌলিক নীতি। তার কথা ও কাজ সকল মানুষের জন্য উত্তম নমুনা। এ কারণেই মহান আল্লাহ আহযাব যুদ্ধ কালীন সময়ে রাসূলে কারীম (সাঃ) এর ধৈর্য্য ও অবিচলতা প্রদর্শন, জিহাদের প্রস্তুতি, কষ্ট স্বীকার এবং আল্লাহ তা‘আলার কাছে সাহায্য ও বিজয় প্রার্থনা ইত্যাদি বিষয়কে আমাদের জন্যে উত্তম আর্দমরুপে সাব্যস্ত করেছেন। মোটকথা, এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর শিক্ষা ও জীবন চরিতকে সকল মানুষের জন্য উত্তম আর্দশ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। জীবনের প্রতিটি শাখায় সীরাতে নবনীর মৌলিক নির্দেশনা বর্তমান রয়েছে। যা সকল যুগের দাবী ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যর্পূণ হওয়ার স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে সর্ব যুগে ও সকল সমাজে এর প্রয়োগ সম্ভব। মানব সমাজের উত্থান-পতন,পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মধ্যেও সীরাতে নববী মানব জীবনের প্রতিটি ও ক্ষেত্রে পরির্পূণ প্রতাপ ও প্রভাবের সাথে মানবতাকে তার আলোকময় নির্দেশনা পৌছে দিচ্ছে। এ প্রবন্ধে আমরা সরকারি পদ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের বন্টন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একান্ত অনুসরণীয় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর অনুপম শিক্ষা ও নির্দেশনাসমূহ আলোচনার প্রয়াস পাবো। সরকারি পদমর্যাদার আরবি প্রতিশব্দ মানসিব, এর বহুবচন মানাসিব, আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে শব্দটির অর্থ- পদ, পদমর্যাদা, অবস্থান, দায়িত্ব ও স্তর ইত্যাদি। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ উবংরমহধঃরড়হ অত্র প্রবন্ধে মানসিব ও উবংরমহধঃরড়হ দ্বারা সরকারি পদ ও দায়িত্ব উদ্দেশ্য।
রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দায়িত্ব, পদ ও চাকুরি সম্মান ও মর্যাদার উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব লাভ নাগরিকের অন্যতম অধিকার হিসেবেও গণ্য করা হয়। এ কারণে পদ অর্জনে লবিং, সুপারিশ, ঘুষ ও গিফট প্রদান ইত্যাদি বিষয়কে বৈধ মনে করা হয়। কিন্তু ইমলামে পদের চাহিদা প্রকাশ করাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয়েছে। আব্দুর রহমান ইবন সামুরা বলেন, মহানবী (সাঃ) আমাকে বললেন: হে আব্দুর রহমান, দায়িত্ব চেয়ো না। কেননা যদি তোমাকে তোমার চাওয়ার কারণে দায়িত্ব দেয়া হয়, তাহলে তোমাকে নিসঃঙ্গ ছেড়ে দেয়া হবে( দায়িত্ব পালনে তুমি আল্লাহর সাহায্য হতে বঞ্চিত হবে।)পক্ষান্তরে যদি তা না চাইতেই তোমাকে দেয়া হয় তুমি সে বিষয়ে ( আল্লাহর পক্ষ হতে) সাহায্যপ্রাপ্ত হবে । আবু মুসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, দু‘ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে এসে দায়িত্ব চাইলে তিনি তাদেরকে বললেন: আল্লাহর কসম, আমরা এমন কাউকে কর্মকর্তা নিযুক্ত করব না, যে দায়িত্ব চায় এবং এমন ব্যক্তিকেও নয়, যে দায়িত্ব লাভের আকাক্সক্ষা করে। এ কারণেই অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম ও সালাফ রাণ্ট্রীয় দায়িত্বকে এড়িয়ে চলতেন। ইসলাম কোন পদ চেয়ে নেয়াকে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি কেউ কোন পদ বা দায়িত্ব পেলে তা যথাযথভাবে পালনের নির্দেশ দিয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর শিক্ষা অনুসারে পদ ও সম্পদ আল্লাহ প্রদত্ত আমানত। এই বিষয়ে মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহী রহ. বলেন, “শুধু এমন নয় যে, ইসলাম এ দায়িত্ব ও পদকে সাধারণ আমানত হিসেবে বিবেচনা করেছে; বরং ইসলাম এগুলোকে আল্লাহ প্রদত্ত আমানত হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। সাধারণত আধুনিক শাসনব্যবস্থায় এগুলোকে মৌলিকভাবে আমানত জ্ঞান করাই হয় না। যদি কোথাও বিবেচনা করা হয়ও, তবে তা জাতীয় আমানত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে যেখানে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরবের বিষয়ে জোর দেয়া হয় অথবা জাতীয়ভাবে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হওয়ার ভয় থাকে, সেখানে বাহ্যিকভাবে একটা পর্যায় পর্যন্ত আমানতদারি বহাল থাকে। কিন্তু যেখানে এই মানসিকতা সজাগ নেই অথবা জবাবদিহিতার ঝামেলা নেই, সেখানে সব ধরনের খেয়ানতের জন্যে সর্ব অঙ্গ উন্মুক্ত থাকে এবং অন্তঃকরণ হয়ে পড়ে পুরোপুরি অনুভুতিশূন্য। বিপরীতে ইসলাম তাঁকে আল্লাহ প্রদত্ত আমানত সাব্যস্ত করে এর তদারকি করার জন্যে দু ধরনের দৃষ্টিকে নিযুক্ত করেছে। জাতির দৃষ্টি থেকে হয়ত নিজেকে আড়াল করা যায়, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টি থেকে তো কোন গোপন খেয়ানতও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই”।
সরকারি পদ ও জাতীয় সম্পদ আল্লাহ প্রদত্ত আমানত হওয়ার ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস রয়েছে। আবু যার গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (সাঃ) এর কাছে আবেদন করলাম, আমাকে রাষ্ট্রীয় কোন দায়িত্ব নিযুক্ত করুন। তিনি আমার কাঁধে তার পবিত্র হাত রেখে বললেন: হে আবু যার! তুমি (এ ব্যাপারে) দুর্বল। কেননা এাঁ আমানত এবং কেয়ামতের দিন তা অপমান ও অনুতাপের কারণ হবে। তবে যে তা ন্যায়ের সাথে গ্রহণ করবে এবং তার হক আদায় করবে তার বিষয়টি ভিন্ন। হাদীসে সরকারি পদ ও দায়িত্বের অধিকারীদের জন্যে ‘রায়িন’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অভিধানে এর অর্থ হলো, তদারককারী, তত্ত¡াবধায়ক, রাখাল, রক্ষক। সরকারি দায়িত্ব ও পদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণও দায়িত্বের বিচারে রক্ষক ও রাখাল। তদারককারী বা রাখালের দায়িত্ব হলো রক্ষা করা এবং মালিকের নির্দেমনা অনুসারে চলা। ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: শুনো, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। এজন্যেই নববী নির্দেশনার আলোকে সে সময় পর্যন্ত কেউ নিজ কর্তব্য পালনে সফল হবে না, যতক্ষণ না সংরক্ষক ও দায়িত্বশীলের ভুমিকায় সে পদ ও সম্পদের ব্যবহার না করে।
ইসলাম পদ ও সম্পদ সংক্রান্ত যে ধারণা পেশ করেছে তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, জবাবদিহিতা। রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যতম কর্তব্য হলো, নিজ দায়িত্বাধীনদের তদারকি করে তাদের ত্রæটি ও মন্দকর্মের জন্যে কৈফিয়ত তলব করা। অবশ্য ইসলামের প্রকৃত দাবি হলো, ব্যক্তি নিজ অবস্থা ও কর্ম সম্পর্কে নিজেই পরিপূর্ণ হিসাব করবে। এর মাধ্যমে সে মূলত মহান প্রভুর দরবারে উপস্থিত হয়ে হিসাব দেয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আল্লাহ বলেন: সাবধান! যাবতীয় কর্তৃত্ব কেবল তারই, আর তিনি দ্রæত হিসাব গ্রহণকারী। অতএব সরকারি দায়িত্বশীলদেরকে অবশ্যই এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, তাদেরকে আল্লাহর দরবারে হিসাবের মুখোমুখি হতে হবে।সাথে সাথে রাষ্ট্রপ্রধান এমনকি সাধারণ জনগণও এ ব্যাপারে জবাবদিহিতা গ্রহণ করতে পারে।তবে এর অর্থ যথেচ্ছা আচরণ করার অধিকার প্রদান নয়। আবু ফিরাস হারিছা(রাঃ) বর্ণনা করেন, একবার উমার(রাঃ) নিজ বক্তব্যে বলেন: আমি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এ জন্য নিযুক্ত করিনি যে, তারা বিনা কারণে তোমাদেরকে প্রহার করবে ও অন্যায়ভাবে তোমাদের সম্পদ নিয়ে যাবে।যার প্রতি এই জুলুম করা হবে, সে যেন এর সংবাদ নিয়ে আমার কাছে আসে, যাতে আমি ঐ পদাধিকারী বা বিচারক থেকে বদলা নেয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। আমর বিন আস (রাঃ) বলেন, যদি কোন কর্মকর্তা নিজের কতৃত্বাধীন কোন ব্যক্তিকে শিক্ষামূলক শাস্তি প্রদান করে তাহলেও কি আপনি তার কাছ থেকে বদলা নেয়ার ব্যবস্থা করবেন? তখন উমার (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! আমি অবশ্যই বদলা নেয়ার ব্যবস্থা করব। এর কারণ হলো আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে নিজের কাছ থেকে বদলা নিতে দেখেছি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগে বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য ছিলো না। উমার (রাঃ) এ দুই বিভগকে সর্ম্পূণ পৃথক করেন। যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারী সুচারুরুপে নিজ দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার ব্যাপারে আদালতের সামনে জবাব দিতে বাধ্য হন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন