রাজধানীর মূল সড়ক কিংবা গলি পথে উপরের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে বিদ্যুতের পিলারে বট গাছের ঝুরির মতো ঝুলছে তার। সড়কগুলো ছেয়ে গেছে বিপজ্জনক ঝুলন্ত তারে। সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতা ও যথাযথ আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার কারণে বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে সরানো যায়নি তারের জট। এখনও রাজধানীর সড়কগুলোয় বিপজ্জনক অবস্থায় ঝুলছে স্যাটেলাইট ক্যাবল অপারেটরদের ডিশলাইন ও ইন্টারনেটের শতশত তার। এই তার ছিঁড়ে মাঝেমধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা। যদিও রাজধানীর সড়কগুলোতে ঝুলন্ত তার (ক্যাবল) অপসারণে গত আট বছর ধরে নানা পদক্ষেপের কথা শুনাচ্ছে সরকার। কিন্তু কার্যকর কোন ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নিতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি)। তাদের দুটি পৃথক কমিটি তার অপসারণে কাজ করলেও এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয়। দায় সারাভাবে মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও তার কাটলেও ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই সড়কটি ফিরে পায় পুরোনো চিত্র। ভুক্তভোগিরা অভিযোগ করে বলেন, হয় ক্যাবল অপারেটর ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের কাছে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিটিআরসি অসহায়। অথবা তাদেরকে বাধ্য করা এবং কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করার বিপরীতে কোন স্বার্থ জড়িত আছে। নাহলে দিনের পর দিন কিভাবে এ অবস্থা চলছে?
বরাবরের মতো আবারও ব্যবস্থা গ্রহণের কথাই জানিয়েছে বিটিআরসি। সংস্থাটির ইঞ্জিনিয়ারিং ও অপারেশন্স বিভাগের কমিশনার মোঃ রেজাউল কাদের জানান, আগে একটি কমিটি ছিল যারা ঝুলন্ত তার অপসারণে কাজ করতো। এখন কিছুটা নিষ্ক্রিয়। তবে নতুন একটি কমিটি কাজ শুরু করবে। যারা আইন অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, নগরীর সৌন্দর্য বাড়াতে এবং কম খরচে নিরবচ্ছিন্ন দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা দিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঞ্জরুল আলম ২০০৮ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ভূগর্ভস্থ কমন নেটওয়ার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশনস ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) গাইডলাইন তৈরি করেন। ওই গাইডলাইন অনুযায়ী, ফাইবার অ্যাট হোম এবং সামিট কমিউনিকেশন রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় ভূগর্ভস্থ অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কাজ শেষ করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ এলাকায়ই ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও ক্যাবল টিভি অপারেটররা অভিন্ন এই নেটওয়ার্কে যুক্ত না হয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ক্যাবল টেনেছেন। এই ক্যাবল অপসারণ করতে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪, ১৫ ও ১৬ সালে এনটিটিএন অপারেটর, ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান (আইএসপি), ক্যাবল অপারেটরদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিটিআরসি। ওইসব বৈঠকে ক্যাবল অপারেটর ও আইএসপিদের সতর্ক করে দেয়া হয় তার সরানোর জন্য এবং অভিযানের পর যেন আর তা উঠানো না হয়। কিন্তু এই তারের জঞ্জাল সরেনি। ওই সময়ে ভিআইপি সড়কে এই তারের জঞ্জাল অপসারণে অভিযানও চালানো হয়েছিল। কিন্ত পরবর্তীতে আর কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিটিআরসি। ফলে আবারও বিপজ্জনক তারের জঞ্জাল রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের বৈদ্যুতিক খুঁটি দখল করে ফেলছে। যদিও ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ ওই কমন নেটওয়ার্কে ঢুকতে মাশুল বেশি ধরছে সংশ্লিষ্ট দুই কোম্পানি। প্রতি মিটারের জন্য ২টা থেকে বাড়িয়ে এখন ৭টাকা করা হয়েছে। যে কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতির কথা চিন্তা করে কোনও-কোনও ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ওই নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ হারাচ্ছে।
বাংলাদেশ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার এসোসিয়েশনের (আইএসপিএবি) সাধারণ সম্পাদক মোঃ এমদাদুল হক বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় অধিক আইএসপি লাইসেন্স দেয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একটি করে তার নিয়ে গেলে জটের সৃষ্টি হবে। সবমিলিয়ে প্রায় ১১শ’ প্রতিষ্ঠানকে আইএসপি লাইসেন্স দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। এমদাদুল হক বলেন, এনটিটিএনে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়ায় তারা পুরো ব্যবসাকে মনোপলি করেছে। এনটিটিএনের মূল্য কমানো এবং সরকারের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান হবে না।
ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন ফাইবার অ্যাট হোমের গভর্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্স ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান আব্বাস ফারুক। তিনি বলেন, প্রতি মিটারের জন্য ২টাকাই আছে, বাড়ানো হয়নি। এরপরও আমরা বিটিআরসিকে বারবারই বলেছি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য। কমিশন যে মূল্য নির্ধারণ করে দেবে সেটিতে সেবা দিতে আমরা বাধ্য। আর আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো যে দুটি এনটিটিএনের কথা বলেছে সেটি ঠিক নয়, লাইসেন্সধারী ৫টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, গ্যাস, বিদ্যুতের যদি একটি লাইন থাকতে পারে তাহলে ভূগর্ভস্থ একটি নেটওয়ার্কের সমস্যা কোথায়?
এর আগে বারবারই ঝুলন্ত তার নামিয়ে ফেলতে সময় বেধে দেয় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। ওইসব নির্দেশনায় বলা হয় ক্যাবল অপারেটর এবং ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার অপসারণ করবে। তবে তারা ব্যর্থ হলে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে। তার অপসারণে ব্যর্থ হলে ডিপিডিসি এবং ডেসকোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে বাস্তবতা বলছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনা কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। কেননা এখনো রাজধানীর সব সড়কেই ঝুলছে তার।
গত আট বছর ধরে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে। মাঝে মাঝে লোক দেখানো দু’একটি অভিযানও করে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিটিআরসি। কোন কোন সড়কে তার কেটে অপসারণ করার কয়েক ঘণ্টা পরই ফিরে তা ফিরে পায় আগের রূপ। প্রতিবারই ঝুলন্ত তার ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেই দায় সারিয়ে নেয় সংশ্লিষ্ট দুই প্রতিষ্ঠান। এর আগে তার অপসারণ কমিটিতে কাজ করেছেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ বজলুর রহমান ইনকিলাবকে জানান সরকারের কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না। অপসারণ কমিটি বিভিন্ন এলাকায় তার কেটে অপসারণ করছে কিন্তু কিছুদিন পরই আবার তার উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বিটিআরসি’র নীতিমালাতেই সমস্যা রয়েছে। যে পরিমাণ লাইসেন্স প্রয়োজন ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন