বাংলাদেশ : ৪৮.৩ ওভারে ২২২
ভারত : ৫০ ওভারে ২২৩
ফল : ভারত ৩ উইকেটে জয়ী
আরো একটি ফাইনাল, প্রতিপক্ষও সেই ভারত। রোমাঞ্চের চূড়ায় পৌঁছে দিন শেষে আবারো সেই স্বপ্নভঙ্গের নীল বেদনা। ‘রোমাঞ্চ’ নামক ক্ষুদ্র শব্দের জালে যে ধরনের ম্যাচকে বাধা যায় না, ক্রিকেট বিশ্বকে আবারো তেমনি এক ম্যাচ উপহার দিয়েছে বাংলাদেশ। মাত্র ২২২ রানের পুঁজি নিয়েও প্রতাপশালী ভারতের সঙ্গে মাশরাফিরা লড়েছে পুরো ৫০ ওভার। কিন্তু সেই লড়াইয়ের পরও যে ৩ উইকেটের পরাজয় আটকানো যায়নি। টানা দ্বিতীয়বারের মত বাংলাদেশকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ৭ম শিরোপা জিতে নিয়েছে ভারত।
১৬৭ রানে পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে মাহেন্দ্র সিং ধোনি আউট হওয়ার পর থেকেই কাঁপুনি শুরু হয় ভারতীয় ড্রেসিংরুমে। সাজঘরে রোহিত-রবি শাত্রীদের চিন্তিত পায়চারি বলে দিচ্ছিল কতটা চাপে ভারত। শেষ দিকে তো মাশরাফি-রুবেল-মুস্তাফিজদের বল মনে হচ্ছিল একেকটা বারুদের গোলা। ভারতও জানত তিন পেসারের কোটা শেষ হলেই দিতে হবে চূড়ান্ত ছোঁবল। সেই ছোঁবল দিতেও মাহমুদউল্লাহর করা শেষ ওভারে ৬ রানের হিসাব মেলাতে শেষ বল পর্যন্ত খেলতে হয়েছে রোহিত শর্মার দলকে। বলতে গেলে ‘দশে মিলে’ ব্যাটিং করেই জিতেছে ভারত।
কি বলবেন এমনকে? রোমাঞ্চকর? নাকি হৃদয়বিদারক? সে যাই বলুন না কেন ম্যাচের ফলকে ছাপিয়ে আলোচনায় কিন্তু ঘুরেফিরে আসছে লিটন দাসের ওই আউট। টিভি আম্পায়েরর দেয়া সিদ্ধান্তের পর থেকেই এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে আইসিসি তথা আন্তর্জাকিত ক্রিকেট কাউন্সিলের মুÐুপাত। শুধু লক্ষ-কোটি টাইগার ক্রিকেট প্রেমীদের মধ্যেই নয়, ভারতীয় অনেক ক্রিকেট বোদ্ধাও প্রশ্ন তুলেছেনÑ আসলেই কি এটা আউট ছিল?
প্রভাবশালী ভারতের বিপক্ষে যখনই সুবিধাজনক অবস্থানে তখনই আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বলি হয়েছে বাংলাদেশ। যার সর্বশেষ সংযোজন লিটনের এই আউট। যে আউট মেলবোর্নে অনুষ্ঠেয় গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের সেই বেদনাদায়ক স্মৃতি আরো একবার মনে করিয়ে দেয়। সেই ম্যাচে এই ভারতের বিপক্ষেই দুটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বলি হয় বাংলাদেশ। প্রথমে রুবেল হোসেনের বলে রোহিত শর্মার সেই ক্যাচ আউট, যে বলকে ‘নো’ ঘোষণা করেন আম্পায়ার আলিম দার। এরপর বাউন্ডারি লাইন থেকে শেখর ধাওয়ানের নেয়া মাহমুদউল্লাহর সেই বিতর্কিত ক্যাচ। দুটি সিদ্ধান্তই যায় বাংলাদেশের বিপক্ষে। আম্পায়ারের এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জল গড়ায় অনেক দূর। পুরো বাংলাদেশ তো ক্ষোভে ফেটে পড়েই একই সঙ্গে এই ঘটনার জের ধরে আইসিসির প্রেসিডেন্টের পদ থেকে তখন সরে দাঁড়ান বাংলাদেশের সনামধন্য ক্রীড়া সংগঠক আ.হ.ম মুস্তফা কামাল। সেই ভারতের বিপক্ষেই আবার বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বলি হলেন লিটন।
অথচ দুর্দান্ত শুরুর পর হঠাৎ যখন বাংলাদেশ পথহারা তখন এই লিটনের ব্যাটেই বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ। ঘটনাটি দলীয় ৪১ ও কুলদীপ জাদবের করা শেষ ওভারের শেষ বলে। এগিয়ে এসে মারতে গিয়ে ডান হাতি স্পিনারের গুগলিতে লাইন মিস করেন লিটন। ক্রিজ ছেড়ে আসায় পিছন থেকে স্ট্যাম ভেঙে দেন এমএস ধোনি। এসময় ধোনির অঙ্গভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল আউট হয়নি। কিন্তু অজি টিভি আম্পায়ার রোড টাকার অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে আউট ঘোষণা করেন। অথচ রিপ্লেতে দেখা যায় সময় মতই ক্রিজে পৌঁছে গেছেন লিটন। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীরা এই ঘটনায় বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন। কারণ, এ ধরণের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্র ধোঁয়াশার সৃষ্টি হলে সাধারণত বেনিফিট অব আউট ব্যাটসম্যানের পক্ষে যায়। কিন্তু টিভি আম্পায়ার সিদ্ধান্ত দেন ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে।
দুর্দান্ত শুরুর সব হারিয়ে বাংলাদেশ তখন লিটনের ব্যাটের দিকে তাকিয়ে। ১১৭ বলে ১২টি চার ও ২ ছক্কায় ১২১ রান করে লিটন আউট হওয়ার পর বাংলাদেশ আর ৩২ রান যোগ করতে পারে। শেষ পর্যন্ত ৪৮.৩ ওভারে গুটিয়ে ভারতকে ২২৩ রানের লক্ষ্য দেয় মাশরাফি বাহিনী। মামুলি এই লক্ষ্য নিয়েও বুক চিতিয়ে লড়ে যায় টাইগাররা।
অবশ্য লিটন ছাড়া এদিন আর কোন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানই নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। আট ব্যাটসম্যান দুই অঙ্ক ছুঁতে ব্যর্থ। ত্রিশের ইনিংস খেলেছেন মাত্র দুজনÑ মিরাজ ও সৌম্য। তিনজন হয়েছেন রান আউট, দুটি স্টাম্পিং। আত্মহত্যার মিছিলে ছিলেন দলের প্রধাণ দুই ভরসা মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহও।
লিটনের সঙ্গে ক্যারিয়ারে প্রথম ওপেন করতে নেমে ৩২ রান করে মিরাজ যখন কেদার যাবদকে উইকেট বিলিয়ে আসেন বাংলাদেশের রাত তখন ১২০ এবং সেটা ২০ ওভারেই। ভারতের বিপক্ষে যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। এরপরই নামে ধস। ৩১ রানের মধ্যে মিরাজ ছাড়াও ফেরেন ইমরুল (২), মুশফিক (৫), মিঠুন (২) ও মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু অপর প্রান্তে তখনও অবিচল লিটন। ৩৩ বলে করা ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফকে সেঞ্চুরিতে রূপ দেন ৮৭ বলে। ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে নিয়ে যাওয়া দ্বিতীয় বাংলাদেশি লিটন। টুর্নামেন্ট ফাইনালে সেঞ্চুুরি করা প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানও তিনি।
তার ব্যাটে শুরুটা ছিল স্বপ্নের। ১১ ইনিংস পর উদ্বোধনী জুটিতে ৫০ পেরোয় বাংলাদেশ। ২৬ ইনিংস পর ১০০। কিন্তু এত কিছু অর্জনও এদিন ¤øান হয়ে যায় রোহিত (৪৮), কার্তিক (৩৭), ধোনি (৩৬), জাদব (২৩*), জাদেজা (২৩), ভবনেশ্বরদের (২১) ছোট কিন্তু কার্যকরী অবদানে। এর মাঝেও একমাত্র প্রাপ্তি লিটনের ম্যাচ সেরার পুরস্কার। এই প্রথম কোন বাংলাদেশি ফাইনালে ম্যাচসেরা হলেন।
স্কোর কার্ড
এশিয়া কাপ ফাইনাল
বাংলাদেশ-ভারত, দুবাই
টস : ভারত
বাংলাদেশ ইনিংস রান বল ৪ ৬
লিটন স্ট্যাম্পড ব কুলদ্বীপ ১২১ ১১৭ ১২ ২
মিরাজ ক রাইডু ব যাধব ৩২ ৫৯ ৩ ০
ইমরুল এলবি ব চাহাল ২ ১২ ০ ০
মুশফিক ক বুমরাহ ব যাধব ৫ ৯ ১ ০
মিথুন রান আউট ২ ৪ ০ ০
মাহমুদউল্লাহ ক বুমরাহ ব কুলদ্বীপ ৪ ১৬ ০ ০
সৌম্য রান আউট ৩৩ ৪৫ ১ ১
মাশরাফি স্ট্যাম্পড ব কুলদ্বীপ ৭ ৯ ০ ১
নাজমুল রান আউট ৭ ১৩ ০ ০
মুস্তাফিজ অপরাজিত ২ ৫ ০ ০
রুবেল বোল্ড বুমরাহ ০ ২ ০ ০
অতিরিক্ত (লেবা ২, ও ৫) ৭
মোট (অলআউট, ৪৮.৩ ওভারে) ২২২
উইকেট পতন : ১-১২০ (মিরাজ), ২-১২৮ (ইমরুল), ৩-১৩৭ (মুশফিক), ৪-১৩৯ (মিথুন), ৫-১৫১ (মাহমুদউল্লাহ), ৬-১৮৮ (লিটন), ৭-১৯৬ (মাশরাফি), ৮-২১৩ (নাজমুল), ৯-২২২ (সৌম্য), ১০-২২২ (রুবেল)।
বোলিং : ভুবনেশ্বর ৭-০-৩৩-০, বুমরাহ ৮.৩-০-৩৯-১, চাহাল ৮-১-৩১-১, কুলদ্বীপ ১০-০-৪৫-৩, জাদেজা ৬-০-৩১-০, যাধব ৯-০-৪১-২।
ভারত ইনিংস রান বল ৪ ৬
রোহিত ক নাজমুল ব রুবেল ৪৮ ৫৫ ৩ ৩
ধাওয়ান ক সৌম্য ব নাজমুল ১৫ ১৪ ৩ ০
রাইডু ক মুশফিক ব মাশরাফি ২ ৭ ০ ০
কার্তিক এলবি ব মাহমুদউল্লাহ ৩৭ ৬১ ১ ১
ধোনি ক মুশফিক ব মুস্তাফিজ ৩৬ ৬৭ ৩ ০
যাধব অপরাজিত ২৩ ৩৩ ১ ০
জাদেজা ক মুশফিক ব রুবেল ২৩ ৩৩ ১ ০
ভুবনেশ্বর ক মুশফিক ব মুস্তাফিজ ২১ ৩১ ১ ১
কুলদ্বীপ অপরাজিত ৫ ৫ ০ ০
অতিরিক্ত (বা ১, লেবা ৭, ও ৫) ১৩
মোট (৭ উইকেট, ৫০ ওভারে) ২২৩
উইকেট পতন : ১-৩৫ (ধাওয়ান), ২-৪৬ (রাইডু), ৩-৮৩ (রোহিত), ৪-১৩৭ (কার্তিক), ৫-১৬০ (ধোনি), ৬-২১২ (জাদেজা), ৭-২১৪ (ভুবনেশ্বর)।
বোলিং : মিরাজ ৪-০-২৭-০, মুস্তাফিজ ১০-০-৩৮-২, নাজমুল ১০-০-৫৬-১, মাশরাফি ১০-০.৩৫-১, রুবেল ১০-২-২৬-২, মাহমুদউল্লাহ ৬-০-৩৩-১।
ফল : বাংলাদেশ ৩ উইকেটে পরাজিত।
ম্যান অব দ্য ফাইনাল : লিটন দাস (বাংলাদেশ)।
ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট : শিখর ধাওয়ান (ভারত)।
আসরের সেরা ৫
ব্যাটসম্যান ম্যাচ রান সর্বোচ্চ গড় স্ট্রাইক ১০০/৫০
ধাওয়ান (ভারত) ৫ ৩৪২ ১২৭ ৬৮.৪০ ১০২.০৮ ২/১
রোহিত (ভারত) ৫ ৩১৭ ১১১* ১০৫.৬৬ ৯৩.৫১ ১/২
মুশফিক (বাংলাদেশ) ৫ ৩০২ ১৪৪ ৬০.৪০ ৮১.১৮ ১/১
শেহজাদ (আফগানিস্তান) ৫ ২৬৮ ১২৪ ৫৩.৬০ ৮৩.২২ ১/১
হাশমতউল্লাহ (আফগানিস্তান) ৫ ২৬৩ ৯৭* ৫৬.৭৫ ৭২.২৫ ০/৩
বোলার ম্যাচ উইকেট সেরা গড় ইকো. ৪/৫
রশিদ (আফগানিস্তান) ৫ ১০ ৩/৪৬ ১৭.২০ ৩.৭২ ০/০
কুলদ্বীপ (ভারত) ৬ ১০ ৩/৪৫ ২৩.৭০ ৪.০৮ ০/০
মুস্তাফিজ (বাংলাদেশ) ৫ ৮ ৪/৪৩ ২০.৬২ ৪.৫৮ ১/০
বুমরাহ (ভারত) ৪ ৮ ৩/৩৭ ১৬.০০ ৩.৬৭ ০/০
জাদেজা (ভারত) ৪ ৭ ৪/২৯ ২২.২৮ ৪.৪৫ ১/০
রোল অব অনার
আসর স্বাগতিক চ্যাম্পিয়ন রানার্সআপ
১৯৮৪ ইউএই ভারত শ্রীলঙ্কা
১৯৮৬ শ্রীলঙ্কা শ্রীলঙ্কা পাকিস্তান
১৯৮৮ বাংলাদেশ ভারত শ্রীলঙ্কা
১৯৯০/৯১ ভারত ভারত শ্রীলঙ্কা
১৯৯৫ ইউএই ভারত শ্রীলঙ্কা
১৯৯৭ শ্রীলঙ্কা শ্রীলঙ্কা ভারত
২০০০ বাংলাদেশ পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা
২০০৪ শ্রীলঙ্কা শ্রীলঙ্কা ভারত
২০০৮ পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা ভারত
২০১০ শ্রীলঙ্কা ভারত শ্রীলঙ্কা
২০১২ বাংলাদেশ পাকিস্তান বাংলাদেশ
২০১৪ বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা পাকিস্তান
২০১৬* বাংলাদেশ ভারত বাংলাদেশ
২০১৮ ইউএই ভারত বাংলাদেশ
*আসরটি ছিল টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন