বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ব্যবসা বাণিজ্য

আইনে তামাক মাদক না হওয়ায় নিষিদ্ধ হচ্ছে না কুষ্টিয়ায় বছরে ৫০০ কোটি টাকার তামাক চাষ

প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কুষ্টিয়া থেকে স্টাফ রিপোর্টার : কুষ্টিয়া অঞ্চলে বছরে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার তামাক চাষ হচ্ছে। বর্তমানে বহুজাতিক ও দেশি কয়েকটি বড় সিগারেট কোম্পানি কুষ্টিয়ায় ব্যাপকভাবে এ তামাক চাষে সহায়তা করছে। স্থায়ীভাবে জমির উর্বরাশক্তি হারানো ও তামাক চাষির স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রবল আশঙ্কার ভেতর দিয়েই স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে এর আবাদ। এর দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক ক্ষতি ব্যাপক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারপরও ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে কুষ্টিয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কৃষি অর্থনীতি।
আশির দশকের আগে কুষ্টিয়ার প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল গম ও পাট। ক্রমে সে জায়গা দখলে নিয়েছে বিড়ি-সিগারেট তৈরির প্রধান উপকরণ তামাক। বর্তমানে জেলাজুড়ে বছরে প্রায় ৪০ হাজার টন তামাক উৎপাদিত হয়। বর্তমান দর অনুযায়ী যার মূল্য প্রায় ৫শ’ কোটি টাকারও বেশি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সর্বপ্রথম আশির দশকে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বারোইপাড়া ইউনিয়নের গোড়দহ এবং পূর্ব ও পশ্চিম চুনিয়াপাড়া গ্রামে চুক্তিভিত্তিক তামাক আবাদ শুরু করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)। এরপর ক্রমেই তামাক চাষ স¤প্রসারিত হয়েছে।
তামাক চাষের ক্ষেত
গত দুই দশকে কুষ্টিয়ার সব উপজেলা তামাক চাষের আওতায় আসে। সে হিসাবে জেলার প্রায় ৫০ হাজার একর জমি এখন তামাক চাষে ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে বহুজাতিক ও দেশি কয়েকটি বড় সিগারেট কোম্পানি কুষ্টিয়ায় তামাক চাষ করাচ্ছে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বিএটিবি, নাসির টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ, আবুল খায়ের টোব্যাকো লিমিটেড, আকিজ গ্রæপের ঢাকা টোব্যাকো লিমিটেড, বিআরবি গ্রæপের পারফেক্ট টোব্যাকো, গেøাব টোব্যাকো ইত্যাদি। এর বাইরে ৫০টিরও বেশি স্বল্পমূল্যের সিগারেট ও বিড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়ার চাষিদের দিয়ে তামাক চাষে সম্পৃক্ত।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক জানান, তামাক চাষে নেতিবাচক দিক থাকলেও সাময়িকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, তামাক চাষ কুষ্টিয়া অঞ্চলের দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখছে, বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে কুষ্টিয়ার দারিদ্র্য বিমোচনের পেছনে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগও কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কুষ্টিয়া কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্য অনুযায়ী, ৭৬ থেকে ১০১ টাকা দরে কৃষকরা তামাক বিক্রি করেন। এতে উৎপাদিত তামাক ও আনুষঙ্গিক মূল্য দাঁড়ায় বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত আছে কুষ্টিয়ার প্রায় এক লাখ কৃষক।
তার কথা থেকে আরও জানা যায়, প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। যেখানে গম চাষ হচ্ছে ৩০-৩২ হাজার একরে। আর পাট চাষ হচ্ছে প্রায় ৪২ হাজার একর। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তামাক উইংয়ের প্রধান কৃষিবিদ মোসলে উদ্দিন ফারুক বলেন, তামাক কোম্পানিগুলোর নানা ধরনের প্রণোদনার কারণে তামাক চাষ কৃষকের কাছে জনপ্রিয়। ক্ষতিকর জেনেও স্বল্প সময়ে তামাক চাষ করে নগদ অর্থ পান কৃষক, যা অনেক কৃষকের জীবনযাত্রা পাল্টে দিয়েছে। তারা মাটির ঘর থেকে পাকা ঘর তুলেছেন।
আপাতদৃষ্টিতে লাভজনক হলেও দীর্ঘমেয়াদে জমি ও স্বাস্থ্য দুটোই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বিষয়টি কৃষকদের জানানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু আইনে তামাককে মাদক শ্রেণীতে না ফেলায় সরকার এর চাষ নিষিদ্ধ করছে না। তামাক আবাদে কুষ্টিয়া জেলায় যেসব ফসলের আবাদ কমছে তার মধ্যে রয়েছে আলু, মসুর, রসুন, ধনিয়া, গম, সরিষা, মরিচ, রাই, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি, মুলা, গাজর, বেগুন, খেসারি, তিল, বোরো ধান, ভুট্টা, কচুর লতি শিম ইত্যাদি
অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, তামাক চাষের কারণে ভয়ঙ্কর গ্রিন টোব্যাকো সিকনেস দেখা দিতে পারে। মূলত তামাক প্রক্রিয়াকরণের সময় নিকোটিন চামড়ায় লেগে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। স্থানীয় ডিএই সূত্রে জানা গেছে, সিগারেট কোম্পানিগুলো কৃষকদের নগদ অর্থসহায়তা, উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক) সহায়তা, তামাক ক্রয়ের নিশ্চয়তা, মান নিয়ন্ত্রণে মাঠপর্যায়ে তদারকি, আইপিএম ক্লাবের মাধ্যমে তামাক চাষের উন্নতর প্রশিক্ষণ প্রদানের কারণে পণ্যটির চাষ লাভজনক হয়ে উঠেছে। এতে ধানে যেখানে বিঘাপ্রতি লাভ দেড় হাজার টাকা, গমে ৩ হাজার টাকা, আখে ৮-১০ হাজার টাকা। সেখানে তামাকে লাভ প্রায় ১৫ হাজার টাকা।
কুষ্টিয়া ডিএইর উপপরিচালক কিংকর চন্দ্র দাশ বলেন, সিগারেট কোম্পানিগুলোর সহায়তার কারণে তামাক চাষে অল্প সময়ের মধ্যে কৃষক ভালো অর্থ পাচ্ছেন। তবে তামাক মাটি থেকে খুব বেশি পুষ্টি উপাদান শুষে নেয়। ক্ষেতে প্রচুর সার ও কীটনাশক ব্যবহার করায় দীর্ঘমেয়াদে মাটির ক্ষতি হয়। বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের জানানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামাক চাষে আর্থসামাজিক, পরিবেশ, প্রতিবেশ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ নানাবিধ ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। এর কিছু খারাপ প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে বা স্বল্পমেয়াদে চোখে পড়ে আবার কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় লাগে। এতে জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট, খাদ্যনিরাপত্তায় হুমকি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মতো খারাপ দিক রয়েছে। বিশেষ করে তামাক চাষে মাটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। কারণ ধানের চেয়ে তামাক চাষে তিনগুণ বেশি পরিমাণ ইউরিয়া সার ও কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। তামাক চাষের জন্য একটি জমি দু-তিনবার ব্যবহার করা যায়। তারপর এ জমিতে আর ভালো তামাক হয় না। বেশি পরিমাণ সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ধীরে ধীরে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হতে থাকে।
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডসের বাংলাদেশ প্রোগ্রামের তাঈফুর রহমান বলেন, যে হারে দেশে তামাকের চাহিদা বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি হারে চাষ বাড়ছে। যা আগামি দিনের কৃষি অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। তামাকের ক্ষেতে কয়েক বছর পর অন্য ফসলের চাষও হয় না। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও মিরপুর উপজেলায় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেখা যাবে রাস্তার দু’পাড়ে দিগন্তজোড়া তামাকের ক্ষেত। অথচ ১০ বছর আগেও এসব এলাকার বেশির ভাগ জমিতে আবাদ হতো বিভিন্ন রকম সবজি ও ফসল। কিন্তু গত কয়েক বছরে তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর উৎসাহে তামাক আবাদকে বেছে নিচ্ছেন এ এলাকার প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষক।
উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) এক পর্যবেক্ষণেও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে। সংস্থাটির হিসাবে, তামাক আবাদে চার ধাপে প্রায় ৫২ ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকার কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এ প্রসঙ্গে উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বলেন, তামাক চাষ মাটি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনায় হুমকি নিয়ে আসছে। কৃষক ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও বাড়ছে। তামাক আবাদ বন্ধ করা গেলে কীটনাশক ব্যবহার অনেকাংশে কমে যাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন