ভক্ত, অনুসারী, রাজনীতিক সহযোদ্ধা, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লাখো মুসল্লির উপস্থিতিতে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমানের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে । গতকাল (শুক্রবার) বিকাল সাড়ে ৩টায় সিলেটের ঐতিহাসিক আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় এই নামাজে জানাযা। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে১২টায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।
নামাজের পূর্বে মরহুমের জীবনী নিয়ে দেশ বরেণ্যে রাজনীতিবিদ, আলেম-উলামারা বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তারা বলেন, প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান ছিলেন একজন সংগ্রামী আলেমে দ্বীন ও বহুগুণে গুণান্বিত শ্রদ্ধাভাজন মানুষ। দ্বীনি শিক্ষার প্রচার-প্রসার ও জাতি গঠনের নেতৃত্ব ও বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার মৃত্যুতে ইসলামী রাজনৈতিক অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। এরপর লাখো জনতার উপস্থিতিতে নামাযে জানাযায় ইমামতি করে তার ২য় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন হাবিব। জানাযার নামাজ শেষে জীবনের চিরচেনা হাতে গড়া কর্মস্থল জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল কার্যালয় সংলগ্ন বাগানে তাকে দাফন করা হয়।
এদিকে প্রিন্সিপাল হাবিবের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকসমাগম ঘটতে থাকে আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে। কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে গোটা আলীয় ময়দান। জানাযায় অংশগ্রহনকারী মানুষের শহর অভিমুখে ভিড় ছিল অভাবনীয়। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। মানুষের পদভারে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট দেখা দেয়। শোকে স্তব্ধ মানুষের কান্না ভারাক্রান্ত মন ছুটে চলছিল আলিয়া মাঠের পথে। হাজারো আলেম উলামার উস্তাদ ছিলেন প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান। দ্বীনের খেদমতে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তার তুলনা তিনি নিজেই। ধর্মদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে তার আওয়াজ ছিল বলিষ্ট। সেই আওয়াজ সমীহ করতো সকলে।
সব শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে খাপ খাইয়ে চলার যোগ্যতায় তিনি ছিলেন অনন্য। বিচক্ষণ ও মেধাবীও ছিলেন তিনি। সেকারনে তার পরিচয়, পরিচিতি সর্বমহলে প্রশংসিত ও সমাদৃত ছিল। সভা সমাবেশে তার বক্তব্যর ভাষা ছিল তেজদ্বীপ্ত। বাতিলের রক্তচক্ষু পরোয়া করতেন না। সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিতেন তিনি। তিনি ছিলেন আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথের এক অলংকার। সেকারনে রাজপথ সিংহপুরুষ বলা হতো থাকে। আন্দোলন সংগ্রামের কারণে একাধিকবার কারাবরণ করেছেন দ্বীনের এই রাহবার। আলেম দেশের সমাজের অহংকার প্রিন্সিপাল হাবিবের রয়েছে বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন। তিলে তিলে সময়ের স্রোতে তিনি হয়েছিলেন সিলেটের শক্তিমান এক চরিত্রে। আমৃত্য সিলেটের ঐতিহাসিক জামেয়া মাদানিয়ার কাজির বাজার মাদ্রাসার প্রিন্সিপালও ছিলেন তিনি।
১৯৯৪ সালে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়ে সারা দেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হন প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান। তার সংগঠন সাহাবা সৈনিক পরিষদের ব্যানারে সিলেটে অসংখ্য সভা-সমাবেশ করেন। এছাড়াও দেশের নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলনের সবসময়ই তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
১৯৭৪ সালের জুনে দেশের শীর্ষ আলেমদের তত্ত্ববধানে সিলেটের কাজির বাজার এলাকায় সুরমা নদীর তীরে প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহ্যবাহী জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার মাদ্রাসা। দারুল উলুম দেওবন্দের নীতিতে পরিচালিত এই মাদ্রাসা শুরু থেকেই সিলেবাসে বাংলা, ইংরেজিসহ জাগতিক বিষয় যুক্ত করে নতুন ধারার সূচনা করে। অভিভক্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের রাজনীতি থেকে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ খেলাফত মজসিলের আমির নির্বাচিত হন প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান। ২০১২ সালে ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশে খেলাফত মজলিসের আমির শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক মৃত্যুবরণ বরণ করার পরে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্তে দলের আমির নিযুক্ত হন মাওলানা হাবিবুর রহমান।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক স্ত্রী, চার ছেলে ও তিন কন্যা সন্তানের জনক। তার বড় ছেলে মাওলানা মুসা বিন হাবীব জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল। দ্বিতীয় ছেলে ইংল্যান্ড প্রবাসী। তৃতীয় ছেলে তারেক বিন হাবীব সিলেট মহানগর ছাত্র মজলিসের সভাপতি, চতুর্থ ছেলে তায়েফ বিন হাবীব ইংল্যান্ড প্রবাসী। তার বড় জামাতা মাওলানা তাজুল ইসলাম, দ্বিতীয় জামাতা মাওলানা আতাউর রহমান ইংল্যান্ড প্রবাসী, ছোট জামাতা মাওলানা সহল আল রাজি ব্যবসায়ী ও সিলেট জেলা পরিষদের সদস্য। কওমি মাদরাসার প্রধানের পরিচয় মুহতামিম হলেও, তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন প্রিন্সিপাল হিসেবে। তিনি দেশের প্রাচীনতম আলিয়া গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ি মাদ্রাসায় ফাজিল পর্যন্ত পড়েছেন। কামিল দিয়েছেন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে।
দীর্ঘদিন থেকে ডায়েবেটিস ও হাই প্রেশারসহ শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছিলেন বাংলাদেশ প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান। গত ৭ অক্টোবর তিনি চিকিৎসার জন্য ভারত গিয়েছিলেন। সেখান থেকে দু’দিন আগে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু চিকিৎসার মধ্যেই বৃহস্পতিবার দিনগত রাত সাড়ে ১২ টায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। ১৯৪৫ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জে তার জন্ম। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, চার ছেলে, তিন মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন। প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমানের গ্রামের বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের ঘনশ্যাম গ্রামে।
গতকাল তার জানাযায় পূর্ব সভায় বক্তব্য প্রদান করেন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত আমীর শায়খূল হাদীস আল্লামা ইসমাইল নূরপুরী, নায়েবে আমীর মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, নায়বে আমীর জুবায়ের আহমদ আনসারী, মহাসচিব মুফতি মাওলানা মাহফুজুল হক, যুগ্ন-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা জালাল উদ্দিন, মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম সিরাজী, মুফতি মাওলানা রশিদুর রহমান ফারুকী। এছাড়া অন্যদের মধ্যে মরহুমের দ্বীনের এই পরীক্ষিত রাহবারের কর্মবহুল জীবনের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন বাংলাদশে আনজুমানে আল ইসলাহ সভাপতি আল্লামা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী, সিলেট সিটি করপোরেশন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, এমপি ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়া, বিএনপি চেয়ারপার্সন উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন প্রমুখ।
আল্লামা হাবীবুর রহমানের ইন্তেকালে বিকে মজলিসের শোক
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী জামিআ মাদানিয়া কাজিরবাজার এর প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমানের ইন্তেকালে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন দলের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা ইসমাঈল নূরপুরী ও মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক। তারা শোক জানিয়ে বলেন, আল্লামা হাবীবুর রহমান খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। হাফেজ্জী হুজুর ও শায়খুল হাদীস রহ.-এর ডাকে আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন অকুতোভয়। নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। দেশবিরোধী যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় তিনি রেখেছেন সাহসী ভূমিকা। তিনি ইসলামী শিক্ষা স¤প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। দেশ ও বিদেশে তার অসংখ্য ছাত্র ভক্ত ও খেলাফত প্রতিষ্ঠার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী রয়েছে। তার ইন্তেকালে দেশ ও দলীয় নেতা কর্মীরা একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদকে হারালো যা অপূরণীয়। নেতৃবৃন্দ তার রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এছাড়া মরহুমের ইন্তেকালে আরো গভীর শোক প্রকাশ করেছেন, খেলাফত মজলিসের আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, ইসলামী আন্দোলন ঢাকা উত্তর সভাপতি প্রিন্সিপাল শেখ ফজলে বারী মাসউদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন