সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ ও এডুকেশন সেন্টার একটি ব্যতিক্রমী ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যা আলো ছড়াচ্ছে ব্রিটেনে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলামি শিক্ষার বিস্তার, ইসলামি ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, সংস্কৃতির বিকাশ ও বৃহৎ মসজিদ হিসাবে এর সুনাম ও পরিচিতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নামাজের জন্য বৃহৎ মসজিদ। পুরুষ ও মহিলাদের জন্য নামাজের আলাদা জায়গা, একাডেমিক শিক্ষা কোর্স, গবেষণার জন্য লাইব্রেরী, অতিথিশালা, গেস্ট রুম, কনফারেন্স হলসহ ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সেকেন্ড সিটি বলে খ্যাত বার্মিংহামের কভেন্ট্রি সড়কের ইয়াডলি আজদা শপিং মলের নিকট গেলে এক দৃষ্টিনন্দন ইমারত চোখে পড়বে। এটি কোন শপিংমল, যাদুঘর কিংবা খ্রিস্টান মিশনারীর প্রেয়ার হল নয়। এটি একটি ইসলামি মারকাজ। সুরম্য প্রাসাদ ও নান্দনিক কারুকাজে সুসজ্জিত প্রতিষ্ঠানটির নাম সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ ও এডুকেশন সেন্টার। ব্রিটেনে অবস্থানরত প্রবাসী সিলেটি বাঙালিরা এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন। ইসলামের বহুমুখি খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। প্রায় ৩০ হাজার স্কয়ার ফুট বিশিষ্ট দ্বিতল এই ভবনটি দেখলে যে কারো চোখ জুড়িয়ে যাবে। খ্রিষ্টানের দেশ বলে খ্যাত ব্রিটেনে এমন প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কথা চোখে না দেখলে কল্পনা করা যাবে না। এই প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৫ সালে। ২০১৭ সালের ২১ মে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। জিকির (খানকা) ও মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলিয়ে কামিল আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাউন্ড ফ্লোরে সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ। এই মসজিদে প্রায় ৫ হাজার মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন। উদ্বোধনের পর থেকেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা বিশ্বাসে এটি পরিচালিত হয়ে আসছে। তরিকত তাসাউফপন্থী লোকদের পছন্দের একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইতোমধ্যেই এটি ব্রিটেনে সমাদৃত হয়ে উঠছে।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল সিরায়ান বংশোদ্ভুত হাফিজুল হাদিস সাইয়্যিদ শায়খ আহমদ ফাদি। শায়খ ফাদি আহলে বায়তের বংশধর ও ইসলামি জ্ঞানে পণ্ডিত। ফাদির চার মাজহাবের উপর আলাদা আলাদা ডিপ্লোমা রয়েছে। একজন হাফিজে কুরআন। হাফিজুল হাদিস হিসেবে তার প্রায় ১০ হাজার সহিহ হাদিস মুখস্থ। গতানুগতিক ইসলামি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সিরাজাম মুনিরাকে তিনি আলাদাভাবে সাজাতে চান। এজন্য সকাল সন্ধ্যা এমনকি শুক্রবারকেও শিক্ষার জন্য বেছে নিয়েছেন। ইসলামের মৌলিক সকল বিষয়ে সব বয়সের মুসলমানদের জন্য ক্লাসের ব্যবস্থা রেখেছেন। আলেম, উলামা, ছাত্রশিক্ষক, পেশাজীবী, কর্মজীবী, সাধারণ মুসল্লি এমনকি ইউনিভার্সিটির ছাত্ররাও তার দরসে উপস্থিত হচ্ছেন।
জুমার নামাজের পূর্বে দারুল কিরাতের সিলেবাস অনুযায়ী আমভাবে কুরআন শিক্ষা দেওয়া হয়। এরপর কুরআনের তাফসির পেশ করেন শায়খ ফাদি। তিনি জুমায় মুসল্লিদের উদ্দেশে ইংরেজিতে বক্তব্য রাখেন। প্রতি রোববার সারাদিন হাদিস শরিফের দরস প্রদান করা হয় ও ইসলামি বিষয়ের উপর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়। প্রতি মঙ্গলবার পবিত্র কোরআন শরীফ তারতিলের সহিত তেলাওয়াত শিক্ষা দেন। সপ্তাহের ৫ দিন (রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহঃ) বিকালে শিক্ষার্থীদের আরবী ভাষা শিক্ষা ও মক্তব পড়ান। এই প্রতিষ্ঠানের খেদমতে নিয়মিত নিয়োজিত আছেন বিশিষ্ট ক্বারী আহমদ আলী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন তাকবীর টিভির নাশিদ অনুষ্ঠানের পরিচালক ক্বারী গোলাম মাহফুজ। খানকার মাহফিল করেন সূফি ক্বারী আব্দুল মুনতাকিম। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে মেহমান হয়ে আসেন ব্রিকলেন জামে মসজিদের খতিব মুহাদ্দিস মাওলানা নজরুল ইসলাম।
এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ডা. কুতুব উদ্দিন এডুকেশন ট্রাস্ট ইউকের পরিচালক, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ হাফিয মাওলানা করিমুল ইসলাম বলেন, মসজিদের বারান্দা থেকে যে শিক্ষা শুরু হয়েছিল তাই ইসলামের মূল শিক্ষা। পরবর্তীতে এর কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। ইসলামে শিক্ষা হচ্ছে নূর বা আলো। এই আলোয় আলোকিত হতে হলে পবিত্রতা ও সহিত নিয়্যত প্রয়োজন। সিরাজাম মুনিরা যেভাবে তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে সেটি আমাদের আশান্বিত করে। তিনি প্রতিষ্ঠানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এর সিলেবাসকে আরো সমৃদ্ধ করারও পরামর্শ দেন।
সুমী মহসীনা এডুকেশন ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আলহাজ মো. চন্দন মিয়া বলেন, স্কটল্যান্ড থেকে এই মসজিদে নামাজ পড়তে মাঝে মধ্যে আসি। মসজিদটি খুব বৃহৎ। জুমার খুতবা শুনতেই মূলত এখানে আসি।
সিরাজাম মুনিরার ফাউন্ডার ডাইরেক্টর পাঁচজন। এরা হলেন আলহাজ মো. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, আলহাজ কাজী মো. নানু মিয়া, আলহাজ মো. জসিম উদ্দিন, আলহাজ মাওলানা আবুল হাসান ও আলহাজ হাফিয সাব্বির আহমদ।
সবাই এই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানের উন্নতির সাথে নিজেদের সম্পদ, সময় ও মেধা ব্যয় করছেন। জন্মসূত্রে এই ৫ জনই বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের লোক। আকিদাগত দিক থেকে তারা আহলে সুন্নাত
ওয়াল জামায়াতের অনুসারী। তরীকা তাসাওফে জৈনপুরী সিলসিলার প্রখ্যাত বুযুর্গ মরহুম আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেবর মুরিদ। সারাবিশ্বে ইসলামের শিক্ষা, ইসলামি চেতনা ও সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিতে তারা বদ্ধপরিকর। এজন্য বিশ্বের সকল তরিকত, তাসাওফপন্থী লোকদের সাথে আন্তঃসম্পর্ক গড়ে তুলতে তারা আগ্রহী।
প্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডার ডাইরেক্টর আলহাজ মো. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘একজন মুসলমান হিসেবে ইসলামের বার্তা, ইসলামের সৌন্দর্য্য সকলের কাছে পৌঁছে দিতে এই প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। পাশাপাশি হক সিলসিলার তাসাউপপন্থী লোকদের প্লাটফর্ম এটি। ক্রমান্বয়ে একে ব্রিটেনের প্রথম সারির একটি ইসলামি মারকাজে পরিণত করা হবে।’
সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ ও এডুকেশন সেন্টারের ডাইরেক্টর আলহাজ কাজী মো. নানু মিয়া জানান, এই প্রতিষ্ঠানটি যে উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল আল্লাহর রহমতে তার বাস্তবায়ন চলছে। বর্তমানে একাডেমিক শিক্ষা কোর্সের
পাশাপাশি বিভিন্ন কোর্স চালু রয়েছে। শিগগিরই আবাসিক কলেজের কাজ শুরু হবে। যার পাঠ্যসূচিতে থাকবে ব্রিটিশ কারিকুলাম ও ইসলামিয়াত সাবজেক্ট। কলেজের জন্য নির্ধারিত লাইব্রেরি আরো সমৃদ্ধ করা হবে। সর্বোপরি আহলে সুন্নাত
ওয়াল জামায়াতের আকিদা-বিশ্বাস ও তরিকা-তাসাউফপন্থী লোকদের দ্বারা এ প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ডাইরেক্টর আলহাজ মো. জসিম উদ্দিন বলেন, সিরাজাম মুনিরা প্রতিষ্ঠানটি আমাদের অনেক কাক্সিক্ষত একটি প্রতিষ্ঠান। ব্রিটেনে ইসলামি শিক্ষাকে গতিশীল করার উদ্দেশ্য নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা প্রতিষ্ঠানটিতে একজন যোগ্য প্রিন্সিপাল নিয়োগ দিতে পেরেছি। যিনি ইসলামের সর্ববিষয়ে বিশদ জ্ঞান রাখেন। এখন পরবর্তী সকল কাজ ধীরে ধীরে সম্পন্ন হবে।
প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ডাইরেক্টর আলহাজ হাফিয সাব্বির আহমদ বলেন, যুক্তরাজ্যে এরকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা খুব সহজ ছিলো না। কিন্তু এর খুব প্রয়োজন ছিল। আল্লাহর হুকুমে আমরা তা করতে পেরেছি। এখন এই প্রতিষ্ঠানকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়াই আমাদের বড় কাজ। ব্রিটেনের মুসলমানদের ইসলামি শিক্ষা ও তাহযীব তামাদ্দুন বিকাশে এই প্রতিষ্ঠানটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
ডাইরেক্টর মাওলানা আবুল হাসান বলেন, শিগগিরই নাশিদ (ইসলামি সংগীত) কোর্স, ইমামে আযম ইমাম আবু হানিফা (র.) এর উপর বিশেষ ক্লাস শুরু হবে। মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে ইসলামি সংগীত, কুইজ ও সীরাত বিষয়ক প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান করা হবে।
এই প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময় অতিথি হয়েছেন জেদ্দার সাইয়্যিদ হাবিব ওমর, মক্কা শরীফের সাইয়্যিদ আল হাবিব আব্দুল্লাহ আল আয়দারুছ, মুসলিম হ্যান্ডসের চেয়ারম্যান সাইয়্যিদ লখতে হাসানাইন, আরব আমিরাতের সাবেক বিচারপতি শায়খুল হাদিস আল্লামা হবিবুর রহমান, মাওলানা কমর উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, আনজুমানে আল ইসলাহর সভাপতি মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী, জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীন, মিসরের বিশ্বকারী ইয়াসির আব্দুল বাছিত, দৈনিক ইনকিলাবের নির্বাহী সম্পাদক কবি রূহুল আমিন খান, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও বক্তা ড. মাওলানা কাফীলুদ্দীন সালেহী, ইয়াকুবি ছাহেবের খলিফা শায়খ ইয়াছিন, ইসলামিক স্কলার শায়খ আমের, মরক্কোর ক্বারী আব্দুর রহমান তাক্বওয়ান, মালয়েশিয়ার শায়খ আহমদ, ইয়ামেনের শায়খ মারওয়ানসহ লিবিয়া, সুমালিয়া, ইরাক, তার্কি, মিসর, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের অতিথিববৃন্দ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন