শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

স্বপ্নের নীড়

আ ব্দু স সা লা ম | প্রকাশের সময় : ২৫ অক্টোবর, ২০১৮, ১০:৩৯ পিএম

আরশাদ সাহেব দরিদ্র ঘরের সন্তান। বাবা ছোটখাট একটি সরকারি চাকুরে ছিলেন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে তার বাবা আলিমুদ্দিন খুব কষ্ট করে জীবনযাপন করতেন। ছেলেমেয়েদের কোন শখ তিনি পূরণ করতে পারতেন না বললেই চলে। আরশাদ সাহেব ভাইবোনদের মধ্যে বড় ছিলেন। বাবার খুব ইচ্ছা ছিল অন্তত একটা ছেলেকে হলেও তিনি মানুষের মতো মানুষ করবেন। বাবার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ছেলের কাছে যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি। আরশাদ সাহেবের ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এবং ভর্তি হওয়ার পরও কয়েক বছর বাবা খুব কষ্ট করে তার পড়াশুনার খরচ জোগাতেন। পরবর্তীতে আলিমুদ্দিনের শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকা এবং চাকরি হতে অবসরে যাওয়ায় তিনি অর্থ সংকটে পড়েছিলেন। তাই তিনি সংসারের সব প্রয়োজন মেটাতে পারতেন না। পড়াশুনা শেষ করে কবে চাকরি করবে সেই প্রত্যাশায় তিনি বড় সন্তান আরশাদের মুখ পানে চেয়ে থাকতেন।
ভার্সিটি হতে বের হওয়ার পর আরশাদ সাহেব ঢাকাতে একটি বেসরকারী একটি ব্যাংকে ভালো একটি পদে চাকরি পেয়েছিলেন। ছেলের চাকরি পাওয়ার খবর শুনে বাবা এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, প্রতিবেশির সকল বাড়িতে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন। বাবার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন সেদিন অনেকাংশে পূরণ হয়েছিল। ছেলের চাকরি পাওয়ার পর মা-বাবার যে সুখের জীবন শুরু হয়েছিল তার প্রমাণ আরশাদ সাহেব দিয়েছিলেন। তার ভাই-বোনরাও মনে মনে খুশি হয়েছিল। বড় ভাই গ্রামের বাড়িতে আসার সময় সবার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসত। এতে ভাই-বোনরা খুব খুশি হতো। বাবার অন্য একটি স্বপ্ন ছিল। আর তা হলো- তাঁর ছোটবেলার বন্ধু গ্রামের মেম্বার মাহিদুলের কন্যার সঙ্গে আরশাদের বিবাহ দেওয়া। ভবিষ্যতে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনায় দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়েছিল। মেম্বার সাহেবের মেয়ে আকলিমাও মনে মনে আরশাদকে নিয়ে কল্পনায় সুখ স্বপ্নের জাল বুনেছিল। মা-বাবা আরশাদের সামনে বিবাহের প্রসঙ্গ টানলেই আর কয়টা দিন ধৈর্যধারণ করার কথা বলে তিনি মা-বাবাকে আশ্বস্ত করতেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত আরশাদ সাহেব তার এক সহকর্মীকে পছন্দ করে একা একাই বিয়ে করে ফেলেন। বিয়ে করার পরও বেশ কিছুদিন তিনি বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। হঠাৎ যেদিন বাবা ছেলের বিবাহের কথা শুনলেন তখন তা বাবার কানে বজ্রাঘাতের মতো প্রবেশ করেছিল। তিনি কোনভাবেই এ কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি যখন নিজেই ছেলের মুখ থেকে তার বিয়ে করার কথা শুনলেন তখন তিন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বুকের কষ্টগুলো বুকেই চেপে রেখেছিলেন। কারোর সঙ্গে শেয়ার করতে পারেননি। আকলিমার সুখ স্বপ্নগুলো বালুকাবেলায় তৈরি হওয়া বালির বাঁধের মতো প্রচন্ড এক সুনামির ঢেউয়ে লক্ষ কোটি বালুকণার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে যায়।
কিছুদিন পরেই আলিমুদ্দিন বুঝতে পারছিলেন আরশাদ আর আগের মতো নেই। সে অনেক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। নানান রকম অজুহাত দেখিয়ে সে বাড়িতে ঠিকমতো টাকা দিতে চাইতো না। একপর্যায়ে সে টাকা দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিল। তার শখ ছিল ঢাকাতে একটা জায়গা কিনে বাড়ি বানাবে। এর জন্য তার অনেক টাকার দরকার হয়। নানানরকম দুঃচিন্তায় আলিমুদ্দিনের শারীরিক অবস্থা হঠাৎ করেই ভেঙে পড়ে। আগের মতো শরীরটা ভালো যায় না। দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে তিনি রীতিমতো কাহিল হয়ে যান। এতে পেনশনের টাকার প্রায় অর্ধেকটা খরচ হয়ে যায়। অবশিষ্ট টাকা তিনি দুই মেয়ের বিবাহে খরচ করেছিলেন। টাকার চিন্তায় একদিন হঠাৎ তিনি স্ট্রোক করে বসেন। এতে তার একসাইড প্যারালাইসড হয়ে যায়। চিকিৎসার জন্য তার অনেক টাকার দরকার হয়েছিল। সে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে আরশাদের মাকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছিল। সামান্য চাষের জমিটুকুও তিনি সস্তায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তারপরও আরশাদের বাবাকে বাঁচানো যায়নি। বাবার অনুপস্থিতে সংসার সামলানো দায়িত্ব পড়ে আরশাদের মায়ের উপর। সংসার চালাতে গিয়ে তাকে মেয়ে জামাইদের কাছে হাত পাততে হয়েছিল। নানান ধরণের চিন্তায় তার মায়ের শারীরিক অবস্থাও দিন দিন খারাপ হতে থাকে। তার মা যেন পাতা ঝরা শুকনা মৃত বৃক্ষের মতো সংসারে ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিল কোন এক ঝড়ে মাটিয়ে ভেঙ্গে পড়ার অপেক্ষায়। তারপরও এসবের দিকে আরশাদের মোটেও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সে তার সুখের নীড় গড়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল। নামমাত্র কখনও সখনও মায়ের হাতে কিছু টাকা-পয়সা দিয়েছে।
একদিন সত্যি সত্যিই আরশাদের মা ধরার মায়া ত্যাগ করে মধ্যরাতে পরপারে পাড়ি জমান। সেই সময় আরশাদ তার স্ত্রীকে নিয়ে আনন্দভ্রমনে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিল। বাড়ির লোকজনরা বার বার চেষ্টা করেও আরশাদকে মায়ের মৃত্যুর সংবাদটি জানাতে পারেনি। কারণ সে মোবাইলটা অফ করে ঘুমিয়ে ছিল। পরেরদিন বেশখানিকটা বেলা হলে সে মোবাইলটা অন করে। মায়ের মৃত্যুর সংবাদটি যখন পায় তাৎক্ষণিকভাবে সে আসতে পারেনি। তাই সে মোবাইলে জানিয়ে দিয়েছিল তার জন্য যেন অপেক্ষা না করা হয়। তার আসতে সময় লাগবে। মৃত্যুর পর মায়ের মুখটা শেষবারের মতো দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর আরশাদের মাথা থেকে যেন চিরতরে একটা বড় বোঝা নেমে যায়। মা-বাবার সংসারের দায়-দায়িত্ব থেকে সে মুক্ত হয়ে যায়। ওই সংসার নিয়ে তাকে আর ভাবতে হয়নি। এভাবে একদিন ভাই-বোনরাও পর হয়ে যায়। ভাই-বোনদের সাথে দেখা করতে তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না বললেই চলে। আর ভাই-বোনরাও সুযোগ পায় না ঢাকাতে গিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবে।
ওদিকে আরশাদের স্বপ্ন সুখের অঙ্কুরিত নীড় একদিন বড় বৃক্ষে পরিণত হয়। স্বপ্নের বাড়ি এখন দৃশ্যমান। ছোট্ট বাড়িটা নির্মাণ শেষে আরশাদ এর নাম দেন স্বপ্নের নীড়। জীবনের সকল সঞ্চয় সে এর পিছনে ব্যয় করেছেন। ক’দিন পরেই তারা নতুন বাড়িতে উঠবেন। ঘর গোছানোর কাজে স্বামী-স্ত্রী দুজনা বেশ ব্যস্ত ছিলেন। একদিন সত্যি সত্যিই আরশাদ সাহেব স্ত্রী-সন্তানাদি নিয়ে নিজের বাড়ি স্বপ্নের নীড়ে উঠে পড়লেন। এখন সময় স্বপ্নের নীড়ে সুখের আবেশে গা ভাসিয়ে দেওয়া। নতুন বাড়িতে ওঠার কিছুদিন পর থেকে আরশাদ সাহেবের শরীরটা খুব একটা ভালো যায় না। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। যতদিন যায় ততই যেন তার শরীরটা খারাপ হতে থাকে। অনেক টেষ্ট করার পরও চিকিৎসকরা তার রোগ নির্ণয় করতে পারছিল না। অবশেষে তার ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। অবশ্য ক্যানসারের সমস্যাটা যে পর্যায়ে ধরা পড়েছে তা উন্নত চিকিৎসায় নিরাময় করা সম্ভব। এখন তার অনেক টাকার প্রয়োজন। এত টাকা সে কোথায় পাবে? স্বপ্নের নীড় গড়তে গিয়ে সে যে এখন নিঃস্ব। বাড়ি নির্মাণে তার স্ত্রীকেও ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে তাদের বছর দশেক সময় লাগবে! চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে হলে তাকে ওই স্বপ্নের নীড়টাই বিক্রয় করতে হবে। কিন্তু সে বাড়িটাও যে তার নামে নেই। স্ত্রীর অধিক ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বাড়ির জায়গাটা তার নামেই কিনেছিলেন। অর্থাৎ বাড়িতে এখন যা কিছু আছে তার সবটাই স্ত্রীর। তাই বাড়ি বিক্রি করার ক্ষমতা স্ত্রীর রয়েছে, আরশাদের নেই।
ওদিকে স্ত্রী অফিসের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে অসুস্থ স্বামীর দেখা শুনা করার মতো সময় সে পায় না। ছেলেমেয়েরা বয়সে অনেক ছোট। তারা স্কুল ও পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। অসুস্থ বাবার প্রতি তাদের কোন নজর নেই। তাই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে আরশাদ সাহেব বিছানায় ছটফট করতে থাকে। যে স্বপ্নের নীড়ের জন্য তিনি এত টাকা খরচ করেছেন সেই স্বপ্নের নীড়ই তার যন্ত্রণাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে, তার উন্নত চিকিৎসার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। সে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে বাবা-মায়ের কথা স্মরণ করে তাদের দুঃখ কষ্টগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে। বাবা সামান্য ক’টা টাকার জন্য কতই না কষ্ট করেছে। তিনবেলা ঠিকমতো ভাত জোগাড় করতেও পারেনি। চিকিৎসার অভাবে শেষপর্যন্ত তারা মৃত্যুর কাছে পরাজয় স্বীকার করেছে। অথচ সে তখন দিব্যি মা-বাবাকে আর্থিক সাহায্য করতে পারত। কিন্তু করেনি। শুধু নিজের সুখ-শান্তির জন্যই চিন্তা করেছে। এসব স্মৃতি এখন শুধুই বেদনার।
আরশাদ আরও কিছুদিন বাঁচতে চায়। চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার বিষয়ে স্ত্রীর তেমন কোন আগ্রহ নেই বললেই চলে। শুধু তাকে সান্ত¡না দেওয়ার জন্য নামমাত্র চিকিৎসা করানো হচ্ছে। স্ত্রীকে তিনি কোনভাবেই বাড়ি বিক্রি করানোর জন্য রাজী করাতে পারছে না। পক্ষান্তরে তার স্ত্রী তার মুখের সামনে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে-ক্যানসার কখনও ভালো হয় না। মরতে যখন হবেই তখন অত টাকা খরচ করে কী লাভ? যে স্ত্রীকে সে এত ভালোবেসেছে। সেই স্ত্রীর মুখ থেকেই শেষপর্যন্ত এসব কথা শুনতে হলো তাকে! তার পরিশ্রমের অর্থে গড়ে তোলা স্বপ্নের নীড় এখন স্ত্রী ও সন্তানদের ভোগ দখলে। এসব কথা ভাবতেই তার নয়নের গভীর থেকে বেদনা মিশ্রিত তপ্ত অশ্রুতে বুকের বসন ভিজে যায়। যতদিন যাচ্ছে তার শরীরিক অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে। পাশাপাশি দু’নয়নের আলোও নিভে যাচ্ছে। বাবা-মা, সহদর ভাই-বোন এবং আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি সে যে অবহেলা করেছে সেসব কথা মনে হলেই তার বুকের গভীরে জমে থাকা কষ্টটা অগ্ন্যুৎপাতের মতো বের হয়ে আসতে চায়। সে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতাও সে হারিয়ে ফেলে। তার স্ত্রী তার সাথে এক বিছানায় তো দূরের কথা এক ঘরেও থাকে না। সঙ্গী ব্যতীত রাতের আঁধার তার কাছে ভয়ংকর মনে হয়। একদিন হঠাৎ অশুভক্ষণ তার প্রাণবায়ুটা ছিনিয়ে নেয়। নিথর দেহটা বিছানায় পড়ে থাকে। অবশেষে দেহের উৎকট গন্ধই প্রিয়জনদের মনে করিয়ে দেয় অনেক আগেই সে ধরা থেকে বিদায় নিয়েছে

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন