বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান ব্যাপক। তিনিই প্রথম বাংলাকে আধুনিক উপযোগী করে তোলেন। এর পূর্বে বাংলা ভাষার ব্যবহার মধ্যযুগীয় ছিল। মূলত বাংলাকে সহজ করে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া তার অভিপ্রায় ছিল। তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক ও মানবদরদী। তার বিভিন্ন ধরণের লেখার ভেতর মানবতাবাদী বিষয় ফুটে উঠেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) বিপুল পান্ডিত্য ও অনমনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তার পান্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব ও বিপুল কর্মোদ্যমের উৎস ও চালিকাশক্তি ছিল তার মানবতাবোধ। জীবনব্যাপী সাহিত্য ও কর্মসাধনাকে তিনি নিয়োজিত করেছিলেন মানুষের কল্যাণে। তিনটি ধারায় তার সেই সাধনা পরিচালিত হয়েছে-সমাজ, শিক্ষা ও ভাষার সংস্কার ও উন্নতি সাধন।
মধ্যযুগীয় রীতি থেকে বেরিয়ে তিনি ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন। ভাষার ভেতর শৃঙ্খলাবোধ আনেন। পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূর করার জন্য তিনি লেখেন-বর্ণ পরিচয়, বোধোদয় (১৮৫১), কথামালা (১৮৫৬), আখ্যানমঞ্জরী, বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭) প্রভৃতি। গদ্যে শৃঙ্খলা, বিন্যাস ও সাহিত্যের বাহন করে তুলবার জন্য লেখেন--শকুন্তলা (১৮৫৪), সীতার বনবাস (১৮৬০), মহাভারত, ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯) প্রভৃতি। ঊনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান সমাজ সংস্কারকের ক্ষেত্রে অধিক হলেও ভাষা ও শিক্ষা সংস্কারেও তার ভূমিকা ব্যাপক। সমাজ তথা মানুষের উন্নতি বিধানের জন্য তিনি যে সমস্ত কাজ করেছেন, তার মূলে ছিল মানবতাবোধ। তার রচনাবলীর মধ্যে সেই মানবতাবোধের স্বাক্ষর মুদ্রিত। সে অর্থে তিনি একজন মানবতাবাদী সাহিত্যিক।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় বৃটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সে সময় সমাজ, শিক্ষা, ধর্ম, অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় উইলিয়াম বেন্টিংয়ের শাসনামলে ‘সতীদাহ প্রথা নিবারণ’ আইন পাশ হয় ১৮২৯ সালে। হিন্দু সমাজে তখনও বিধবা বিবাহে ধর্মীয় নিষেধ ছিল। সে সময় বাল্য বিবাহের প্রচলন ছিল। সতীদাহ প্রথা নিবারণের ফলে বহু অল্প বয়ষ্কা নারী বিধবা হল। তারা পরবর্তিতে অনেকে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করল, অনেকে অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হল। গুপ্ত ভ্রুণ হত্যা বৃত্তি পেল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ধর্মীয় শাস্ত্র ঘেটে প্রমাণ করলেন যে, বিধবা বিবাহ দেয়া যাবে। অল্প বয়সে যারা বিধবা হত, তাদের ওপর শ্বশুর বাড়ির, এমন কি নিজের মা-বাবাও নানা রকম অত্যাচার করত। অসামাজিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অবশেষে ‘বিধবা বিবাহ আইন’ পাশ হয় ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই। বিপুল অর্থ ব্যয় করে তিনি বহু বিধবাদের বিয়ে দেন। এটি একটি যুগান্তকারী প্রয়াস।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সকল লেখাই সমাজকল্যাণমূলক-মানবতাবাদী বিষয়ক। ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ (১৮৬৩) নামক শোক পুস্তিকা ছাড়া বাকী সব মৌলিক লেখাই মানবতাবাদের জয় গান করা হয়েছে। ‘আত্মচরিত’র (১৮৯১) ভেতরও কল্যাণময়, মানব প্রেমিক অন্তকরণটি আলো ছড়িয়েছে। তার মানবতাধর্মী ও সমাজ সংস্কারমূলক লেখার মধ্যে রয়েছে-বাল্য বিবাহের দোষ (১৮৫০), বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১৮৫৫), বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১৮৭১), অতি অল্প হইল (১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), ব্রজবিলাস (১৮৮৪), রত্ন পরীক্ষা (১৮৮৬)। শেষের চারটি গ্রন্থ ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত তাইপোষ্য’ ও ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য’ ছদ্ম নামে লিখিত ব্যাঙ্গাত্মক রচনা। তার সমস্ত রচনাতেই মনুষত্বের জয়গান করা হয়েছে। বাল্য বিবাহের কুফল, বহু বিবাহের কুফল, বিধবা বিবাহের প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি সম্পর্কে তিনি সমাজের সকলকে সাহিত্যের মাধ্যমে সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। অনেক আপন জনই বংশের গৌরবে তার বিরুদ্ধে ছিল। তিনি তাদের ছেড়ে দেননি। ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় যুক্তি সহকারে তিনি তাদের জবাব দিয়েছেন। এজন্য তাকে সমাজের প্রতিষ্ঠিত লোকদের কাছ থেকে অনেক নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে। তবু তিনি থেমে থাকেননি। তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘বিধবা জীবন কেবল দুঃখের ভার এবং এই বিচিত্র সংসার তাহার পক্ষে জনশূন্য অরণ্যাকার। পতির সঙ্গে সঙ্গেই তাহার সমস্ত সুখ সাঙ্গ হইয়া যায় এবং পতি বিয়োগ দুঃখের সহ সকল দুঃসহ দুঃখের সমাগম হয়।’ ‘বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘কুলীন ভগিনী ও কুলীন ভাগিনেয়ীদিগের বড় দুর্গতি। তাহাদিগকে পিত্রালয়ে অথবা মাতুলালয়ে থাকিয়া, পাচিকা ও পরিচারিকা উভয়ের কর্ম নির্বাহ করিয়াও তাহারা সুশীলা ভ্রাতৃভার্ষা দিগের নিকট প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারেন না। তাহারা সর্বদাই তাহাদের উপর খড়গহস্ত।’ ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষক প্রস্তাব’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘হা ভারতবর্ষীয় মানবগণ...হতভাগ্য বিধবাদিগের দূরবস্থা দর্শনে, তোমাদের চিরশুষ্ক নীরস হৃদয়ে কারুণ্য রসের সঞ্চার হওয়া কঠিন...। হায় কি পরিতাপের বিষয়! যে দেশে পুরুষ জাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায়-অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকতা রক্ষাই প্রধান ধর্ম ও পরম ধর্ম; আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে।’
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্যে ভাষার ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সুনিবীড় ও প্রাঞ্জল। জনাধারণকে বক্তব্য বুঝাবার জন্য সহজ ভাষার ব্যবহার প্রয়োজন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সে কাজটি সুন্দরভাবে করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্য সাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল। কিন্তু তিনিই সর্ব প্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন। ভাষা যে কেবল ভাবের একটি আধার মাত্র নহে, তাহার মধ্যে যেন তেন প্রকারের কতকগুলো বক্তব্য বিষয় পুরিয়া দিলেই যে কর্তব্য সমাপন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্ত দ্বারা তাহাই প্রমাণ করিয়া দিলেন। তিনি দেখাইয়া দিলেন যে, যতটুকু বক্তব্য তাহা সরল করিয়া, সুন্দর করিয়া এবং সুশৃঙ্খল করিয়া ব্যক্ত করিতে হইবে। আজিকার দিনে এ কাজটিকে তেমন বৃহৎ বলিয়া মনে হইবে না, কিন্তু সমাজবন্ধন যেমন মনুষ্যত্ব বিকাশের পক্ষে অত্যাবশ্যক, তেমনি ভাষাকে কলাবন্ধনের দ্বারা সংযমিত না করিলে, সে ভাষা হইতে কদাচ প্রকৃত সাহিত্যের উদ্ভব হইতে পারে না।...বাংলা ভাষাকে পূর্বপ্রচলিত অনাবশ্যক সমাসাড়ম্বর হইতে মুক্ত করিয়া, তাহার পদগুলোর মধ্যে অংশ যোজনার সুনিয়ম স্থাপন করিয়া বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে কেবল সর্ব প্রকার ব্যবহার যোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন, তাহা নহে, তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য ভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন-এখন তাহার দ্বারা অনেক সেনাপতি ভাব প্রকাশের কঠিন বাধাসকল পরাহত করিয়া সাহিত্যের নব নব ক্ষেত্র আবিষ্কার ও অধিকার করিয়া লইতে পারেন। কিন্ত যিনি এই সেনানীর রচনা কর্তা, যুদ্ধ জয় যশোভাগ সর্ব প্রথম তাহাকে দিতে হয়।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মানবিক গুণাবলির প্রশংসা করেছেন। মানবিক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই তিনি বাংলা ভাষার সংস্কার করেন। তার রচনার ভেতর মানবিক প্রেম উজ্জ্বল হয়ে আছে সর্বত্র। কোন বংশ বা গোত্র বড় হতে পারে না, বড় হওয়া উচিত নিজ ব্যক্তিত্বে-নিজ কার্যে, এ সত্যকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এজন্য তাকে বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে, বহু নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তবু তিনি জয়ী হয়েছেন কালান্তরে। আমাদের সকল শ্রদ্ধা তার প্রতি অর্পন করা হল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন যে, ‘আমরা বিদ্যাসাগরকে কেবল বিদ্যা ও দয়ার আধার বলিয়া জানি। দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাহার অজেয় পৌরুষ। তাহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব এবং যতই তাহা অনুভব করিব ততই আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ ও বিধাতার উদ্দেশ্য সফল হইবে এবং বিদ্যাসাগরের চরিত্র বাঙালির জাতীয় জীবনে চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন