শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

অর্জন

প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাফি উল্লাহ্
চাকরিটাও চলে গেল। ওটাতে কোনরকম মাসের খরচ চালাতে পারতাম। তবে আমি বসে থাকার ছেলে নই। পোস্টার লাগালাম টিউশনীর বিজ্ঞাপন দিয়ে। স্কুলে স্কুলে গিয়ে লিফলেট বিতরণ করলাম। ভোরে ইস্টার্ন মল্লিকার সামনে হকারদের টাকা দিয়ে পেপারের মধ্যে লিফলেট দিলাম। ফোনের অপেক্ষায় থাকলাম। চারদিন পর ফোন এল। মেয়ের কণ্ঠ শুনে নিজেকে গুছিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করলাম। বোধহয় বেশি গোছানো হয়ে গিয়েছিল। সামান্য ভূমিকার পরেই বলে বসল- আমার সাথে প্রেম করবেন?
আমার উত্তর জানা নেই। অভাবে পড়লে উত্তর ভুলে যেতে হয়। ফোন কেটে দিলাম দু’টি আক্ষেপ নিয়ে। টিউশনীর আশা ছিল, পেলাম না আর দ্বিতীয়টি হল- দিন চলে যাওয়ার মত টাকা থাকলেও মেয়েটার সাথে ভাব জমাতে পারতাম। টাকার জন্যে সব সুযোগগুলি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
ফোনে রিং বাজছে। আব্বা কল দিয়েছে। রিংটোন টা আলাদা করে সেট করা। খুব ক্লান্তির সময়েও একটি ফোন রিসিভ করতেই হয়। সেই মানুষটা হল- বাবা।
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
- কিরম আছ?
- ভাল।
-তুমার সাইকেল টা বিক্কিরি করি দিনু। আটশ টাকা দিছে। পুনে পাঁচ বছর চড়ার পরেও ঐ দামই আছে। একটুও কমেনি।
আব্বার কণ্ঠে খুশি আর সন্তুষ্টির একটা আমেজ আছে। রেখে দিলাম। বললাম না কিছুই। বাসায় জানে- দিব্যি আমার দিন চলে যাচ্ছে।
সারাদিন হাঁটলাম। অনেক অফিসে গিয়েছিলাম। কোথাও খালি পোস্ট নেই। দারোয়ানও নিবে না। শুধু ভিখারী কমিটির সাথে যোগাযোগ বাকি ছিল।
বিকেলের দিকে ক্লান্ত হওয়ায় পান্থকুঞ্জে ঢুকে বসলাম। পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম চার টাকা আছে। মানিব্যাগ চেক করছি, তিনটি ভিজিটিঙ কার্ড ছাড়া কিছু নেই। ভয় ভয় লাগল- যদি খালি মানিব্যাগ কেউ দেখে ফেলে, নিশ্চয় ‘পকেটমার’ বলে চিৎকার করে উঠবে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গণপিটুনি শুরু হবে। দ্রুত পকেটে রেখে দিলাম। দামি কিছু নেই যেহেতু নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দেয়া যায়। দিলাম। জেগে দেখি- সবকিছুই আগের মত আছে। চোরেরা পার্কে বসে না বোধহয়। ওরা তো শপিংমল বা বাসে ওঠার মত ভিড়ের জায়গাগুলোতে ঘুরঘুর করে।
সিআরদত্ত রোড হয়ে স্কুল স্ট্রিট, তারপর সেন্ট্রাল রোড হয়ে ল্যাবএইডের কাছে পৌঁছানোর পর লোকের জট দেখতে পাই। পাগলু মামা লেগুনা থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেছে। পেছনের কারের চাকা উঠে গেছে পায়ে। মামা বলতে শহুরে মামা। গেঞ্জিতে পাগলু লেখা ছিল। শুনতে পেলাম কে যেন ডাকছে।
- হাসু!
আমার নামের সর্বশেষ পরিস্থিতি হল এটা। ব্যাকরণ ঠিকই আছে। ফাইয়াজ হয়ে যায় ফাইয়ু, সাফিউল্লাহ হয়ে যায় সাফু, সাজদার হয়ে যায় সাজু। তাহলে নিয়ম অনুযায়ী হাসনাত কবির থেকে হাসু হয়েছে। হাসমত কারো নাম হলেও ডাকনাম টা আমার মতই হয়ে যাবে।
ব্যাকরণের শুদ্ধতা যাচাই করে তাকালাম- দেখি সুসমিতা। হাসপাতালে এসেছে। ওর বড় ভাবিকে ভর্তি করার জন্যে। গ্রীনরোডে ওদের বাসা।
- মাকে ফোন দাও তো। আশপাশে কোথাও ফ্লেক্সিলোডের দোকান পাচ্ছি না।
পকেটে হাত দিই। মোবাইল নেই। মনে পড়ে পান্থকুঞ্জে শুয়ে ছিলাম। ওখানে চুরি হয়েছে নিশ্চিত। কী উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছি না।
ফোনে টাকা নেই বললে একশ টাকা ধরিয়ে ওর টায় পঞ্চাশ আর আমারটায় পঞ্চাশ দিতে বলবে। তাই, বলে ফেললাম। ওটা দিয়ে রাতের খাবারটা সেরে ফেলতে পারব। মনে হয়, কথাটা বিশ^াস হয়নি। মোবাইলটা দেখতে চাইল। শুধু মিসকল দেবে। কিন্তু কী দেব? মোবাইল তো খোয়া গেছে। এটা বলে আবার কোন বিপদে পড়ি, এ ভয়ে অজুহাত খুঁজলাম।
‘আসছি’ বলে পালিয়ে এসেছি। জানি অন্যায়। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। বাসায় জানালে আরেক ঝামেলায় পড়তে হবে।
কোথাও টিউশনী বা কাজ ম্যানেজ করতে না পেরে ফার্মগেট লেগুনা স্ট্যান্ডে গেলাম।
- মামা, হেল্পারী করতাম...।
নিজের কণ্ঠে হেল্পারী ভাষা উচ্চারণ করতে পেরে গর্ব করতে ইচ্ছা হল। কিন্তু, লেকু নামের ঐ ড্রাইভারটা বলেছিল- আমাগোর প্যাটোত ভাত নাই, তোরে কি দিতাম। ফিরি কাম করবি? খালি খাইতে দিমু।
গত সপ্তাহেও লেগুনায় ওঠার সময় ‘স্যার’ বলেছিল। আজ ‘তুই’ এ নেমে এসেছে। একটুও অবাক হলাম না। আমিও তো তখন- তুই তোকারি করে বলেছিলাম। একবার মনে হয়েছিল- সেটার প্রতিশোধ নিয়েছে। কিন্তু, শতকরা হিসেব যে কখনো কমে না- এটা মনে হওয়ায় ভাল লাগে। পঞ্চাশ ভাগ নম্রতা মিশিয়ে কথা বললে বাকি পঞ্চাশ ভাগ ওদের ঝাঁঝমেশানো উত্তর পাওয়া যাবে। আমি যদি আশি ভাগ অভদ্র আর বিশ ভাগ ভদ্র হয়ে যায়, ওদের ক্ষেত্রে উল্টা ঘটবে। আশি ভাগ ভদ্র আর বিশভাগ অভদ্র হবে। আজ পুরো ভাগই ছিল আমার নমনীয়তা, তাই ওদের ছিল পুরো ভাগই রুক্ষতা। এটাই বাস্তব অংক।
ফিরে এলাম। কেউ তো আর ফোন দেয় না। আমার তো নাম্বারই নেই আর। রুমমেটের নাম্বারও কেউ জানে না। বোকার হদ্দ মনে হয়েছিল। বাড়িতে তো টেনশন করতে পারে। খুব দ্রুত খাইরুল ভাইয়ের মোবাইল থেকে কল দিলাম। ভাবছিলাম- খুব আগ্রহ আর অভিমান নিয়ে ওরা কথা বলবে, সান্ত¡না দেব আমাকে। বাস্তবে যেটা ঘটল- তা হল, ফোন হারানোর জন্যে ফাঁপড়ে পড়তে হল।
এত্তবড় ধাড়ি ছেলি, নিজের জিনিস গুছি রাইকতে পারিস নি বা সবাই এরম করিই মুখে মুতবে না টাইপের কথা। মুখে প্রেশাব করার কথাটা একটু জঘন্য লেগেছে। মুখটা কেমন যেন নোনতা নোনতা লেগেছিল। বমিবমি ভাব তো ছিলই। গ্রামের মেয়েরা ঝগড়া শুরু করলে মুখে পেশাব করে দেওয়ার মাধ্যমে অনুগ্রহ করা বোঝায়। কেউ এ কাজটাও করতে না চাইলে বুঝতে হবে- পৃথিবী থেকে ওর জন্য মমতা কিংবা সহযোগিতা উঠে গেছে।
মন খারাপ হওয়ায় শুয়ে আছি। দারোয়ান বলে গেল- আপনের চিটি আসচে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। যাক, শেষ পর্যন্ত উপরওয়ালা মুখ তুলে তাকালেন। কিন্তু তাকাননি। চিঠিতে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছে। পত্রিকাতেও কোন লেখা ছাপা হচ্ছে না। হলেও বা কি হত? একটা টাকাও তো পেতাম না।
ঘুম আসছে না। মেয়েটির কথা মনে পড়ছে। ওর সাথে প্রেম করতে চাইলেই ভাল হত। কিছু টাকা ধার নিতে পারতাম। এ যুগে পেছনে ঘুরঘুর করেও মেয়েদের সিরিয়াল পাওয়া যায় না, আর ও নিজ থেকেই বলেছিল। মিথ্যা বলে হলেও কিছুদিন চুটিয়ে প্রেম করা যেত।
উপায় না পেয়ে চিন্তা করলাম- অন্য পথে গেলে কেমন হয়। কিন্তু সাহসে কুলায় না। হঠাৎ কলিংবেল বাঁজল। আমাকেই খুলতে হল দরজা। আমার সাবেক অফিসের চারজন কর্মকর্তা- আসগর বাড়ৈ, মোছাদ্দারুল আহসান, আলিফ তালুকদার আর মমিন তরফদার সাহেব। সবাই আমার সিনিয়র। হাতে ফুলের তোড়া- ফুলে মুখ প্রায়ই ঢেকে ছিল আসমা পারভিন ম্যাডামের।
মুখ খুললেন তরফদার সাহেব- আমরা ভুল শুনে তোমার ক্যারিয়ারটা শেষ করে দিয়েছি। আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আসলে তোমার সাথে তো আমার কোন রাগারাগি নেই।
‘হু’ বললে তিনি আবার শুরু করলেন- ডাইনিংরুমে একটি মেয়ের গোঙ্গানী শুনে মাথায় কাজ করেনি। কান পেতে লক্ষ করি- ‘হাসনাত, ছাড় বলছি। ছাড়’ বলে নিজেকে এড়ানোর চেষ্টা করছে। স্পষ্ট না শুনে আমি বাড়ৈ ভাইকে ডেকে আনি। এসে ওদের কাউকে পাইনি। দ্রুত এমডি স্যারকে জানালে কোন খোঁজ না নিয়েই তোমাকে বরখাস্ত করে। কিন্তু তদন্ত করলে মেয়েটি জানায়- এ ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। পরবর্তীতে চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখালে জানায়- আসমত নামের ফরেন সেক্টরের অফিসার তাকে হ্যাস্তন্যাস্ত করার চেষ্টা করেছে।
এমডি স্যার আমাদের পাঠিয়েছেন- বললেন তালুকদার সাহেব।
হাসতে হাসতে বলেই ফেললাম- তা তো আসলেন কিন্তু আমি তো আমাকে চিনে ফেলছি। অনেক কিছু অর্জন হল এই কদিনে।
খুশিতে দু’টি লাফ দেয়ার জন্যে দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়লাম। চাকরি ফিরে পাওয়ায় এ আনন্দ না বরং কাল থেকে আবার ‘স্যার’ বলবে ব্যাটা ড্রাইভার- এ কারণে।
স্যারকে ফোন দিলাম। রিসিভ করেই বললেন- কাল থেকে আসমতের চেয়ারে তুমি বসবে।  তোমার বেতন আগের চেয়ে তিনগুণ হল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন