শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ফেসবুকের অপব্যবহার

মো. ওসমান গনি | প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ফেসবুক। শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অ্যাপ ফেসবুক। অ্যাপটির জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। কে ব্যবহার করছে না এটি! আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই বুঁদ হয়ে আছে ফেসবুকের মায়াবী রাজ্যে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ফেসবুকের মাসিক সক্রিয় সদস্য দুই বিলিয়ন অর্থাৎ ২০০ কোটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুক আমাদের জীবনের বড় একটি সময় কেড়ে নিচ্ছে। বিজনেস ইনসাইডারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে মানুষ গড়ে প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করছে প্রতিদিন ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট, ছবি আপলোড, চ্যাটিং বা হোমপেজ ব্রাউজিং করতে। আর টিনএজরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও বেশি জড়িয়ে পড়ছে। নাওয়া-খাওয়া, ঘুমের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছে ফেসবুকে। ফেসবুক আসক্তি এখন একটা মারাত্মক নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি ‘ডিজিটাল কোকেন’ অ্যাডিকশনের মতো হয়ে গেছে। আজকাল তরুণ প্রজন্ম একবার ফেসবুকের মধ্যে ঢুকলে আর বের হতে চায় না। একথা অনস্বীকার্য, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সবার হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করায় বাস্তবে ইয়ং জেনারেশনে খুব একটা ক্রিয়েটিভ হচ্ছে না। ইয়ং জেনারেশনের ভেতরে ম্যাক্সিমাম ব্যবহার করে ফেসবুক চ্যাটিং করার জন্য। এটি ক্রিয়েটিভ ইউজ না। তরুণদের ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা থেকে শুরু করে ঘুম কম হওয়াসহ নানা অসুস্থতার জন্যও একে দায়ী করা হচ্ছে। কাজেই ফেসবুক ব্যবহারে প্রয়োজন সচেতনতা। আর শিশু কিংবা উঠতি বয়সীদের ফেসবুক ব্যবহারে প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা।
গত বছরের এক হিসাব অনুযায়ী, দেশের অনলাইন ব্যবহারকারী ৭০ শতাংশ নারীই কোনো না কোনো ধরনের হয়রানির শিকার। শুধু দেশই নয়, বিশ্বজুড়ে অনলাইনে নারী হয়রানির এমন ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার নিরাপত্তা শাখার তথ্যমতে, তথ্যপ্রযুক্তি অবাধ বিচরণের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ভূমিকা রাখছে আবার এসব মাধ্যমে নারী হয়রানির ঘটনাও বাড়ছে। পুলিশের দাবি, অভিযোগকারীদের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই সাইবার নিরাপত্তা ইউনিট থেকে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রতিকার করা সম্ভব হচ্ছে।
অনলাইনে ব্যবহারকারীর প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হওয়া খুবই জরুরি। প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত করা হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের হয়রানি কমবে। পাশাপাশি ব্যবহারকারীদেরও নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছে টিনএজ নারীরা। এ বয়সের একটি আবেগ থাকে। এ কারণে তারা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিও তুলছে। বন্ধুরা সেসব ছবি ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে তাকে হয়রানি বা ব্লাকমেইল করছে। এজন্য বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রে নারীদের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। হয়রানির শিকার নারীদের আইনি সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
ফেসবুকের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এখন থেকে ছড়ানো হচ্ছে ধর্মীয়বিদ্বেষ আর বিভিন্ন গুজব। এখন পর্যন্ত দেশে ধর্মকে কেন্দ্র করে যতগুলো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সবই ফেসবুক থেকে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ফেসবুকের গুজবের সূত্র ধরে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে। এর আগে ২০১২ সালের শেষ দিকে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননা করে ছবি সংযুক্ত করায় রামু উপজেলার বৌদ্ধবসতি এলাকায় চালানো হয় তাণ্ডব। এসময় ১২টি বৌদ্ধমন্দির এবং বৌদ্ধদের ৩০টি বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। শতাধিক ঘরবাড়ি এবং দোকানপাটে হামলা ও লুটপাট চালায় সুযোগসন্ধানীরা। এছাড়াও কুমিল্লার হোমনা, পাবনার সাঁথিয়া, সাতক্ষীরার ফতেহপুরে এমন গুজব থেকেই ধর্মীবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে টানা সাত দিনব্যাপী সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে আন্দোলনকে ঘিরে নানা ধরনের গুজবও উঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন পোস্টে গুজব ছড়ানো হয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও ছাত্রী ধর্ষণের। পরে পুলিশ অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতার আনে।
নির্বাচনের আগে ফেসবুক ও সাইবার স্পেস ব্যবহার করে গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা। পুলিশ প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা সাইবার অপরাধকে বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন। এসময় একটি চক্র অনলাইনে মিথ্যা তথ্য ও গুজব রটাতে পারে। এজন্য পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট সজাগ রয়েছে। রাষ্ট্র ও ব্যক্তিবিরোধী বা কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে আপত্তিকর কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার আগেই অপরাধীকে আইনের আওতায় নেয়ার মতো সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা চলছে। সাইবার স্পেসে আপত্তিকর কিছু দেখলে মানুষ যাতে সঙ্গে সঙ্গে তা পুলিশের নজরে আনে সেজন্য জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে সাইবার অপরাধ করে সহজে আর পার পাওয়া যাবে না।
তাছাড়া ফেসবুক ব্যবহার করে প্রতি বছর অসাধু মহল, অভিনব কায়দায় মেডিকেলসহ বিভিন্ন পাবলিক ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন, এসএসসি, এইচএসসি এমনকি জেডিসি বা জেএসসি পরীক্ষারও প্রশ্নফাঁস করে আসছে। আগ্রহীরা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন পেজে পোস্ট বা ভুয়া প্রোফাইল থেকে এ ধরনের অসাধু কাজ সম্পাদন করে থাকে। অনেক সময় প্রশ্নপত্র মিললেও বেশিরভাগ সময় ভুয়া প্রশ্নপত্র দিয়ে হাজার হাজার টাকা লুটে নেয় চক্রটি। ফেসবুকে কোনো নির্দিষ্ট আইডি থেকে ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে মূলত উত্তরসহ প্রশ্নপত্র দেয়া হয়। চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের (ঢাবি) সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠে। পরে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে ঢাবি কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এবার পরীক্ষা শুরুর অন্তত পৌনে ১ ঘণ্টা আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উত্তরসহ হাতে লেখা প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে। এবারও প্রশ্নপত্র প্রথমবার ছড়ানো হয় ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে চলছে বিকৃত যৌন চর্চা। অনেক সময় গ্রুপ পাবলিক রেখে বা ক্লোজড করে দিয়ে একটা সংঘবদ্ধ চক্র যৌনাচার করছেন। এসব গ্রুপে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মেয়ের নোংরা-নগ্ন ছবি পোস্ট করে নানারকম মন্তব্য করতে বলা হয়। অনেক সময় গোপনে ধারণ করা ছবিও পোস্ট করা হয়। এরকম কয়েকটি গ্রুপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাতের গভীরতা বাড়লেই এসব গ্রুপের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনেক সময় প্রকাশ্যেই বলা হয়, এখন কি কেউ জেগে আছেন? সেক্স চ্যাট করতে চাই। অনেক সময় বিভিন্ন মেয়ের আইডি থেকে উত্তেজক ছবি পোস্ট করে ফোন নাম্বার দিয়ে দেয়া হয়। অনেকে আবার প্রতি ঘণ্টা বা রাতের হিসাব করে যৌন কাজের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। গ্রুপগুলোতে এক ধরনের পোস্ট প্রায়ই দেখা যায়। যেমন- একটি স্বল্প বসনা নারীর ছবি দিয়ে বলা হয়, জামাটি খুব সুন্দর। আবার বিভিন্ন রাস্তাঘাট, শপিংমলে ঘুরতে বের হওয়া অপ্রস্তুত অবস্থায় ধারণ করা মেয়েদের ছবি পোস্ট করে বলা হয় ‘কার কার লাগবে এমন জিনিস’। এভাবে ওই মেয়ে বা মহিলার অজান্তেই ছড়িয়ে পড়ছে ওই মেয়ের ছবি। অনেকে আবার সেক্স চ্যাট করার জন্য প্রকাশ্যেই পার্টনার খুঁজছে। ফেসবুকে ইংরেজি বা বাংলা দু’ভাবেই সার্চ দিলে এরকম অসংখ্য গ্রুপ বা প্রোফাইল খুঁজে পাওয়া যাবে।
এদিকে ফেসবুকের এসব অপরাধ দমন করার জন্য পুলিশ সদর দফতর হতে দেশব্যাপী পুলিশের পৃথক ১০০টি সাইবার টিম গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি টিমে পাঁচজন করে সদস্য রয়েছেন। পুলিশ সদর দফতরের একজন সহকারী উপমহাপরিদর্শকের (এআইজি) নেতৃত্বে এ টিমকে পরিবীক্ষণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সাইবার অপরাধ ঠেকাতে বেশকিছু উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। আরও কিছু প্রযুক্তি আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা প্রচার ও গুজব ছড়াচ্ছে এমন শতাধিক ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের অ্যাডমিনদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নেয়ার চেষ্টা চলছে। এছাড়া বিভ্রান্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে উসকানি দেয়া হচ্ছে এমন বেশকিছু ইউটিউব চ্যানেল চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের বাইরে অবস্থান নিয়ে অনেক ভুয়া আইডি থেকেও অপপ্রচার করা হচ্ছে। এতে জনমনে নানা শঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য এগুলো বন্ধের চেষ্টা চলছে।সাইবার পুলিশ প্রতিনিয়তই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সাইবার টহল দিচ্ছে। রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর কিছু পাওয়া গেলে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাইবার দমন ইউনিটগুলো আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। অপরাধী শনাক্তে নানা ধরনের উন্নতমানের ডিভাইস ও সফটওয়্যার যুক্ত করা হচ্ছে। স¤প্রতি সাইবার অপরাধ দমন, ঘটনার তদন্ত ও তদারকি করতে ‘সাইবার পুলিশ সেন্টার’ নামে সিআইডির নতুন একটি ইউনিটের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ ইউনিটে একজন ডিআইজির নেতৃত্বে দু’জন অতিরিক্ত ডিআইজিসহ ৩৪২ জনের নতুন জনবল সৃষ্টি করা হয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন