চীনের এক শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি নির্বাহীকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের জন্য কানাডার পুলিশের গ্রেফতার চীনের ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ ও শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। এটা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর জন্য একটি সূক্ষ রাজনৈতিক পরীক্ষাও বটে। কিছু চীনার আমেরিকান পণ্য বর্জনের দাবি এবং অন্যদের যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বিনিয়োগ বিষয়ে উদ্বেগ- এ পরস্পর বিরোধী মনোভাবের প্রকাশ চীনের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব লাভের অভিযাত্রার প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের অস্বাভাবিক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত স্বভাবকে তুলে ধরেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়ে-র প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মেং ওয়াংঝুর আটকের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার ক্রমেই প্রবল হয়ে ওঠা প্রতিদ্ব›িদ্বতাকে পাক খাওয়া পন্থায় চীনা এস্টাবলিশমেন্টের জন্য ঘরে নিয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে এবং তা শি জিনপিংকে ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে একটি কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারে। এর আংশিক কারণ হচ্ছে ৪৬ বছর বয়স্কা মেং নিজে এ এস্টাবলিশমেন্টের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
মেং চীনের সবচেয়ে বড় মহিলা ব্যবসায়ী। তিনি বহু দেশ সফর করেছেন, ভালো ইংরেজি জানেন, তিনি এমন এক বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত মালিক যেটি সাধারণ চীনা ও শাসক কম্যুনিস্ট পার্টি উভয়েরই গর্বের উৎস। তিনি কোম্পানির কিংদবদন্তির প্রতিষ্ঠাতা রেন জেংফেইর কন্যা যিনি পিপলস লিবারেশন আর্মিতে ছিলেন ও পরে এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এটা তাকে চীনে কর্পোরেট রয়্যালটি বানিয়েছে যার তুলনা করা যায় শেরিল স্যান্ডবার্গের মত কারো সাথে যিনি আমেরিকার প্রযুক্তি অগ্রনায়ক স্টিভ জবসের কন্যা। শনিবার ভ্যাংকুভারে বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতিকালে আটকের পর থেকে মেং পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন। এ গোলযোগ চীনা নেতৃত্বকে ঘটনাস্থলে টেনে নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট শি শক্তি প্রদর্শনের জন্য, সম্ভবত আমেরিকার বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার চাপের মুখে রয়েছেন। সে সাথে চীনের শাসক শ্রেণির উপর ওয়াশিংটনের সাথে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও বাণিজ্য যুদ্ধজনিত ক্ষতি সীমিত করার চাপও তার উপর আছে।
বেইজিংয়ের এক কর্পোরেট আইনজীবী তাও জিংঝু বলেন, মেং-এর গ্রেফতারে চীনে বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া হবে। ধনী সমাজ আমেরিকায় তাদের নিরাপত্তা ও সম্পদ বিষয়ে দীর্ঘ উদ্বেগের মধ্যে পড়েছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি দুর্নীতি ও রাষ্ট্রবহির্ভূত আইনের সন্ধানে নামে তাহলে তা আরো বৃদ্ধি পাবে।
চীনের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে শি’র অবস্থান যদিও চ্যালেঞ্জহীন, মেং-এর গ্রেফতারের আগেই তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। কেউ কেউ তাকে অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী নীতির জন্য তাকে দায়ী করেছেন যা ট্রাম্প প্রশাসনকে ক্ষেপিয়েছে ও বাণিজ্য যুদ্ধে উস্কানি দিয়েছে। মেং-এর আটকের সময়টির মানে শি জিনপিং-এর উপর আরো চাপ সৃষ্টিও হতে পারে। তিনি ও ট্রাম্প যখন বুয়েনোস আয়ার্সে ডিনারকালে বাণিজ্যযুদ্ধ বিরতি বিষয়ে আলোচনা করছিলেন তখনি এ আটকের ঘটনা ঘটে। সে সময় ট্রাম্প এ গ্রেফতার সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন, কিন্তু কিছু চীনা ইতিমধ্যেই বলে ফেলেছেন যে শীর্ষ বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপনে মার্কিনি পক্ষের ব্যর্থতা শি জিনপিং-এর মর্যাদাহানির সমতুল্য এবং সম্ভবত তা ওয়াশিংটনের বাজপাখিদের চীনকে হয়রানি করার একটি ইচ্ছাকৃত চেষ্টা। অন্যরা বলেন, মেং-এর গ্রেফতার তাদেরকেই শক্তিশালী করবে যারা দীর্ঘদিন থেকে সন্দেহ করে আসছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের উত্থানকে প্রতিহত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পার্টি নেতৃত্বের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক থাকা পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী বলেন, এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে প্রত্যেকের খারাপ সন্দেহকে দৃঢ় করবে।
বেইজিংয়ের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক দেং ইউয়েন বলেন, চীন সরকার ও সমাজের রক্ষণশীল শক্তি মেং-এর গ্রেফতারকে আগামী মাসগুলোতে শুরু হওয়া বাণিজ্য আলোচনায় প্রদেয় সুবিধা প্রদান বন্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি হুয়াওয়ে-র ক্ষেত্রে নজির স্থাপন করে তাহলে চীনের রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী শক্তি ও সামরিক বাহিনীও অখুশি হবে এবং তা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো সমঝোতা করাকে আরো কঠিন করে তুলবে।
দেং আরো বলেন, স্বল্প মেয়াদে এ কার্ড খেলে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তারা লাভবান হবে না। এটা সংস্কারবাদীদের জন্য কথা বলাকে কঠিন করে তুলবে। শি জিনপিং মেং-এর গ্রেফতার বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি, কিন্তু চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলিষ্ঠভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে ও তার মুক্তি দাবি করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র গেং শুয়াং বলেন, মেংকে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে ওয়াশিংটনকে তার ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন এবং তিনি মেং-এর অধিকার লঙ্ঘনের জন্য কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেন।
মার্কিন বিচার বিভাগ ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য লঙ্ঘনের বিষয়টি তদন্ত করছে, কিন্তু তারা বিশদ কিছু বলেনি বা মেং-এর বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে কিছু বলেনি। তার সুষ্ঠু বিচারের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে মেং-এর অনুরোধের ব্যাপারেও কানাডা কর্তৃপক্ষ নীরব রয়েছে। এদিকে চীনা সামাজিক মাধ্যম যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা বিষয়ে মন্তব্যে সরব হয়ে উঠেছে। বহু ফেসবুক ব্যবহারকারী বলেছেন যে, মেংকে যুক্তরাষ্ট্র অপহরণ করেছে। তারা বলেছেন যে, চীনারা কোথাও আর নিরাপদ নন। অন্যরা যুক্তরাষ্ট্রকে সীমালঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছেন। তাদের প্রশ্ন, ইরানে হুয়াওয়ের কর্মকান্ড কেন মার্কিন আইনের মধ্যে পড়বে? একটি ব্যাপক প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায়, চেন সোউহুয়া নামের একজন বিনিয়োগ কনসালট্যান্ট মেঝেতে তার আইফোন ফেলে দিয়েছেন এবং একটি হাতুড়ি দিয়ে তা ভেঙে ফেলছেন। তিনি এক নিবন্ধে দেশব্যাপী অ্যাপল কোম্পানির পণ্য বর্জনের আহবান জানান। আরেকজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী লিখেন, চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের সময়ে আমরা যেন কোনো আমেরিকান পণ্য না কিনি এবং যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে না যাই।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আংশিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে হুয়াওয়ের জাতীয় গর্বে। চীনে হুয়াওয়েকে দেশে সৃষ্ট কর্পোরেট সাফল্যের কাহিনী হিসেবে দেখা হয়। এই স্থানীয় প্রতিষ্ঠানটি বিদেশী প্রতিদ্ব›দ্বীদের টেক্কা দিয়ে বিশ্বের অন্যতম একটি প্রধান টেলিকম হার্ডওয়্যার ও অন্যান্য শীর্ষ প্রযুক্তির নির্মাতায় পরিণত হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় শেনঝেন শহরভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটিতে বিশ্বব্যাপী ১ লাখ ৮০ হাজার লোক কর্মরত। হুয়াওয়ে ফোন চীনে আইফোন বিক্রিকে ছাড়িয়ে গিয়ে কোটি কোটি চীনার কাছে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বস্তুতে পরিণত হয়েছে। চীনা সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ য়ু ইয়ংডিং বলেন, মেং ‘চীনা জনগণের জন্য’ লেখা পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করছিলেন কিনা তা নিয়ে বিদেশীরা হয়ত আগ্রহী হতে পারেন, তবে তা কোনো বিষয় নয়। আমরা জানি তিনি রেন জেংফেইর কন্যা। এটাই যথেষ্ট। এটা চীনের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি। ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের প্রফেসর উ জিনবো বলেন, মেং-এর গ্রেফতারকে বহু চীনাই চীনকে নিম্নমানের ভোগ্যপণ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং আরো উন্নত ও মূল্যবান পণ্য উৎপাদনে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার মার্কিন চেষ্টা হিসেবে দেখবে।
চীনের মানুষ সচেতন যে, ওয়াশিংটন হুয়াওয়েকে চীনের গোয়েন্দা সংস্থার একটি শাখা হিসেবে গণ্য করে এবং তাকে নিরাপত্তা ঝুঁকি উল্লেখ করে বিশ্বব্যাপী তার মিত্রদের এর সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকার আহবান জানাচ্ছে। চীনারা এটাকে অপ্রমাণিত ও অন্যায্য মনে করে। রেনমিন বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের প্রফেসর চেং জিয়াওহে বলেন, হুয়াওয়েকে খতম করা আবশ্যক নয়। হুয়াওয়েকে খতম করা বোয়িংকে খতম করার মতই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ বিনিয়োগকারী বলেন, ওয়াশিংটন বুঝতে পারেনি যে, হুয়াওয়ের পিছনে লাগার ঘটনাকে বহু চীনা অপমান হিসেবে দেখবে। তিনি ইঙ্গিত করেন যে, চীনা এলিটের বহু মানুষ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতিতে উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, মেং-এর গ্রেফতারের পর তার বন্ধুরা রসিকতা করে বলেছেন যে, তারা আর তাদের সন্তানদের আমেরিকার বোর্ডিং স্কুলগুলোতে পাঠাতে সক্ষম হবে না, তার পরিবর্তে চীনা শিক্ষা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করবেন। চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চীনা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া সংযম প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী পূর্ণমাত্রার প্রচারণা চালানো থেকে বিরত থাকে। কিন্তু মেং-এর গ্রেফতারের পর আর সে অবস্থা থাকেনি। চীনের সর্বাপেক্ষা জাতীয়তাবাদী পত্রিকার একটি দি গ্লোবাল টাইমস-এর সম্পাদক হু শিজিন লিখেন যে, এ গ্রেফতার চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, আমরা হুয়াওয়ের প্রতি নৈতিক সমর্থন প্রদানের জন্য চীন সরকার ও চীনা সমাজের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। আমরা হুয়াওয়েকে তার নির্দোষিতা প্রমাণের আইনি লড়াই এবং কোম্পানিকে তার পথ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার আমেরিকান চক্রান্ত প্রতিহত করতে সমর্থন জানাচ্ছি।
একজন কম্যুনিস্ট যুবলীগ গবেষক ও প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী লেখক ওয়াং জিয়াওডং সরকারকে আরো এগিয়ে যেতে ও আমেরিকানদের আটক করে প্রতিশোধ নেয়ার পরামর্শ দেন। তিনি একটি সামাজিক মাধ্যমে লিখেন, তারা যদি মেংকে গ্রেফতারের জন্য তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনতে পারে তাহলে চীনে সকল আমেরিকানকে যাতে গ্রেফতার করা যায় সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে কিছু অপরাধের অভিযোগ আমরা আনতে পারব না কেন? তার এ উত্তপ্ত মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই ধরনের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ প্রশ্নাতীত নয়। সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের টেকনোলজি প্রোগ্রামের পরিচালক জেমস এ. লুইস বলেন, আমি যদি একজন মার্কিন প্রযুক্তি নির্বাহী হতাম, আমি কিছুদিনের জন্য চীনে যাওয়া বন্ধ রাখতাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন