শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

কবি কাজী কাদের নওয়াজ : জীবন ও সাহিত্যকর্ম

মু সা ফি র ন জ রু ল | প্রকাশের সময় : ১৮ জানুয়ারি, ২০১৯, ২:০২ এএম

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ (নির্বাচিতদের অন্যতম) খ্যাত মুঘল ঐতিহ্যের কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯০৯ সালের ১৫ জানুয়ারী অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী আল্লাহ নওয়াজ, পিতামহ কাজী নওয়াজ খোদা, মাতার নাম ফাতেমাতুন্নেছা, মাতামহ ছিলেন ভারতের অন্যতম প্রতাপশালী জমিদার সৈয়দ জিল্লুুর রহমান। তিনি রাজা মিয়া নামেই সমধিত পরিচিত ছিলেন। পৈর্তৃক নিবাস বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোর্ট গ্রামে। পিতা কাজী আল্লাহ নওয়াজ ছিলেন মঙ্গলকোর্টের সম্ভ্রান্ত ও বনেদী জমিদার পরিবারের সন্তান এবং মাতা ফাতেমাতুন্নেছা ছিলেন মুর্শিদাবাদের জমিদার পরিবারের মেয়ে। পিতা-মাতার এগার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের বড়। নিঃসন্তান এ কবির স্ত্রীর নাম নাসেরা বিবি। তাঁর পিতা আল্লাহ নওয়াজ বাংলা, ইংরেজি, আরবী, ফারসী, উর্দু ভাষার সুপণ্ডিত ও লেখক ছিলেন। মা ফাতেমাতুনেচ্ছাও ছিলেন একজন সুশিক্ষিতা বিদূষী নারী।
কাজী কাদের নওয়াজ ১৯১৮ সালে বর্ধমান জেলার মাথরুন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯২৩ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৯২৫ সালে বহরমপুর কলেজ থেকে আইএসসি এবং ১৯২৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ (অনার্স) পাশ করেন। ১৯৩২ সালে তিনি বি.টি পাশ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও পরীক্ষা দেননি বলে বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ আছে।
শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষাবিদ কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯৩৩ সালে স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর পদে যোগদান করেন। চাকুরী জীবনের শুরুতে কিছুদিন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। ১৯৪৬ সালে সহকারি প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং প্রথমে নবকুমার ইন্সটিটিউশনে ও পরে নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ১৯৫১ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি দিনাজপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিযুুক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি এ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর ঢাকার বিখ্যাত সংবাদপত্র ও রেডিওতে বড় পদে চাকুরির ডাক পান। সে ডাকে সাড়া না দিয়ে তিনি ইতোপূর্বে ১৯৪৮ সালে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামের প্রখ্যাত হিন্দু জমিদার বাবু উপেন্দ্রনাথ জোয়ার্দার ওরফে নগেন জোয়ার্দার-এর সঙ্গে বিনিময় সূত্রে প্রাপ্ত প্রাসাদতুল্য দ্বিতল বাড়িতে আমৃত্যু স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সরকারি স্কুল থেকে অবসরের পর ১৯৬৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মহেশচন্দ্র পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
কবি কাজী কাদের নওয়াজ অনর্গল লিখেছিলেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, আরবী, ফারসী, উর্দু, সংস্কৃতি প্রভৃতি ভাষার সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল প্রখর। তাঁর প্রায় দশ হাজারের মত কবিতা তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে ‘মাসিক মোহাম্মদী’, ‘মাসিক শিশুসাথী’, ‘মাসিক মাহেনও’ ‘মাসিক খেলাঘর’, ‘মাসিক নবারুণ’, ‘মাসিক সবুজ পাতা’, ‘বিকাশ’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বসুমতি’, ‘শুকতারা’, ‘পাঠশালা’, ‘রামধনু’, ‘শীশমহল’, ‘মৌচাক’, ‘প্রবাসী’, ‘সপ্তডিঙ্গা’, ‘আলাপনী’, ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘রংমশাল’, ‘পাকিস্তানী খবর’, ‘পাক জমহুরিয়াত’, ‘পাকসমাচার’, ‘মাসিক কৃষিকথা’, ‘ধলেশ্বরী’, ‘শিশু সওগাত’, ‘গণদাবী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
‘মরাল’ (কাব্য-১৩৪১), ‘নীল কুমুদী’ (কাব্য-১৯৬০), ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’ (উপন্যাস-১৩৭৩), ‘উতলা সন্ধ্যা’, ‘দস্যু লাল মোহন’ (গোয়েন্দা কাহিনী), ‘দাদুর বৈঠক’ (স্মৃতিচারণমূলক গল্প কাহিনী-১৮৪৭) প্রভৃতি। ‘ওস্তাদের কদর’ (শিক্ষাগুরুর মর্যাদা), ‘মা’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘চাঁদদিঘি’, ‘হারানো টুপি’, ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত কবিতা।
কবি কাজী কাদের নওয়াজের কবিতায় মাতৃভক্তি, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ, দেশপ্রেম ও প্রকৃতির নিঃসর্গের প্রতি ভালোবাসা সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। ছাত্রজীবনে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকার প্রকাশিত তাঁর ‘মা’ কবিতায় মায়ের প্রতি গভীর ভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ‘মা’ কবিতায় লিখেছেন :
“মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই,
ইহার চেয়ে নাম যে মধূর তিন ভ‚বনে নাই।
সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক, মাথার পরে আজি,
অন্তরে ‘মা’ থাকুক মম, ঝরুক স্নেহরাজী।”
তাঁর এ কবিতা পড়ে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভ‚য়সী প্রসংশা করে লিখেছিলেন, “কবিতা লেখার স্বাভাবিক শক্তি তোমার আছে। ....তুমি কাব্য সাধনার ধারাতেই জন্মভ‚মির মঙ্গল করছ।”
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মরাল’ বহুল সমাদৃত গ্রন্থ। কাদের নওয়াজ রবীন্দ্র-নজরুল যুগের একজন কবি হয়েও ভাব-ভাষা ও ছন্দের জাদুতে বাংলা কাব্য সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছেন। কাব্য সাহিত্যে তাঁর ব্যাপক পদচারণা ত্রিশের দশকে। এ সময় ‘কল্লোল গোষ্ঠী’র লেখকেরা রবীন্দ্র বলয় থেকে বেড়িয়ে এসে একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য ধারার সৃষ্টির মানসে দেদীপ্যমান। তাঁরা ইউরোপীয় ভাবধারার প্রভাব বাংলা সাহিত্যে এনে একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য ধারার সৃষ্টি করলেন। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ কবিগণ সার্থকভাবে বাংলা কবিতায় এক নবতর আবহ সৃষ্টি করলেন। ঠিক এ সময়কালেই কাজী কাদের নওয়াজ সগৌরবে নিজেকে বাংলা কবিতায় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
কাজী কাদের নওয়াজের ‘হারানো টুপি’ কবিতা প্রকাশের পর সে সময়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর এ কবিতা পড়ে ভ‚য়সী প্রশংসা করেছিলেন। তিনি তাঁর ‘হারানো টুপি’ কবিতায় কবি লিখেছেন : “টুপি আমার হারিয়ে গেছে/হারিয়ে গেছে ভাইরে/ বিহনে তার এ জীবনে/কতই ব্যথা পাইরে ;”
প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষে কবির ‘ঘুমপাড়ানীয়া গান’ মাসিক ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ কবিতায় কবির কাব্য প্রতিভার দ্যুতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কবি একজন আদর্শবান ও অনুকরণীয় শিক্ষক ছিলেন। তিনি শিক্ষাকেই জীবনে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। দিয়েছেন শিক্ষাগুরুর সম্মান। এ কারণে তিনি মুঘল হেরেমের বিভিন্ন চরিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন শিক্ষকের সম্মান ও মর্যাদার কথা। ওস্তাদের কদর (শিক্ষাগুরুর মর্যাদা) কবিতায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে :
“বাদশা আলমগীর
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লির।
উচ্ছাস ভরে শিক্ষক তবে দাঁড়ায়ে সগৌরবে,
কুর্ণিশ করি বাদশাহর তরে কহেন উচ্চরবে-
‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’’
কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নীল কুমুদী’ কাব্যে চটুল ভাষারীতি ব্যবহৃত হয়েছে। কবি এ কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় পল্লী বাংলার শ্যামল প্রকৃতির অন্তরালে রূপকের মাধ্যমে ব্যক্তি হৃদয়ের স্মৃতি-বিস্মৃতি, হৃদয় বেদনা ও হৃদয়ানুভ‚তি মন্থন করেছেন। যেমন :
চাঁদ ডুবে যায় দূর নীলিমায়
শুকতারা শুধু জাগে
রজনীর শেষে, নীল কুমুদী সে
কাঁদিয়া বিদায় মাগে।”
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দুটি পাখি, দুটি তীরে’। এ উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার চরিত্রের মাধ্যমে লেখক নিজের বিরহী জীবনের প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করেছেন।
কবি কাজী কাদের নওয়াজ ছিলেন একজন উঁচুদরের শক্তিমান কবি। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। বলেছেন দেশের পক্ষে-ভাষার পক্ষে। বিজয়ীর বেশে ফিরেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে আবুল ফজলের একটি স্মৃতিচারণ তুলে ধরা হল : “একবার আইয়ুব খানের সময় বাবায়ে অনুষ্ঠিত হয় উর্দু মহাসম্মেলন। উভয় পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত জ্ঞানীগুণীই সেখানে ছিলেন উপস্থিত। উর্দু হরফে বাংলা লিখতে হবে। বাংলাদেশের অনেকেই বই লিখে ছাপিয়ে নিয়েছেন। আবার অনেকে মনে মনে বিপক্ষে ; কিন্তু মুখে বলতে সাহস নেই। অল্প কিছু সংখ্যক লেখক ছোটখাট বক্তৃতা পড়লেন তাও ‘না’-‘হ্যা’র উপর। আর তিনি একমাত্র ঘোর বিরোধিতা করে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিলেন। তাঁর বক্তৃতার সময় বহুবার করতালি পড়েছিল। তিনি পৃথিবীর দশ বারাটা দেশের বিখ্যাত কবিদের মাতৃভাষার উপর লিখিত কবিতা সেই ভাষায় পাঠ করে তার অনুবাদ শুনিয়ে বক্তৃতা শেষ করেন। অনেকেই পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তার মধ্যে ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ (নির্বাচিতদের অন্যতম) পদবীসহ সোনার মেডেল ওনাকে দেওয়া হল।” (উদ্ধৃত : আবুল ফজল ; সূত্র : ভুল নাই ভুলব না স্মৃতি, ইবনে আজিজ, পৃষ্ঠা-৪২)।
কবি কাজী কাদের নওয়াজ সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ পদক ছাড়াও ১৯৬৩ সালে শিশু সাহিত্যে ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’, মাদার বকস্ পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রীয় ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’ লাভ করেন।
১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারী য়েশার সদর হাসপাতালে এ মহৎ কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন