আলাওল মধ্যযুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবি, মুসলিম কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ তাকে মধ্যযুগের রবীন্দ্রনাথ রুপে আখ্যায়িত করেন। ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে-“মধ্য যুগে বাঙালী কবিদের মধ্যে আলাওলের স্থান উচ্চে, তার সমকক্ষ বহুভাষাবিদ কবি সেই যুগে আর ছিলেন না। ড: দীনেশচন্দ্র সেন ও আলাওলের পাণ্ডিত্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
কবি আলাওলের জন্ম আনুমানিক ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রাচীন গৌড়ের অন্তর্গত ফতেহবাদ, যা বর্র্তমান মাদারিপুর জেলার জালালপুরে অবস্থিত। মৃত্যু ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। আলাওলের পিতা ফতেহাবাদ মজলিশ কুতুবের অমাত্য ছিলেন। তিনি তার পিতার সাথে জলপথে রোসাঙ্গ যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে পর্তুগীজ জলদস্যুরা তাদের উপর আক্রমণ করে। তার পিতা সহ অন্যরা মৃত্যুবরণ করলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আলাওল। ইতিহাস থেকে জানা যায় তখন শুধু চট্রগ্রামই নয় সমগ্র পূর্ববাংলার জলপথে পর্তুগীজ জলদস্যুদের হানা ছিল নিয়মিত। অত:পর রোসাঙ্গ রাজসভায় আশ্রয় লাভ করেন আলাওল। তৎকালীন সময়ে রোসাঙ্গ যা বর্তমান আরাকান, ভারতের পূর্বপ্রান্তে একটি স্বাধীন প্রবল পরাক্রান্ত বৌদ্ধ রাজ্য ছিল। রোসাঙ্গের দুর্দর্ষ প্রতাপ দিল্লীর মোগল সম্রাটগন ও ব্যতিব্যস্ত থাকত। আলাওল রোসাঙ্গের সীমা বর্ণনা করেছেন-
“উত্তরে পর্বত হীমা দক্ষিণে সাগর সীমা
মধ্যে যত পর্বত কানন।”
রোসাঙ্গ রাজসভায় অনেক বাঙালী অমাত্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করে ছিলেন। রোসাঙ্গ রাজসিংহাসনে তখন শ্রীচন্দ্র সুধর্ম্মা নামে নরপতি আরোহন করেন। আলাওলের বর্ণনা হতে জানা যায়, তিনি অত্যন্ত ধার্মিক, গুনগ্রাহী ও পরম কাব্যকলা বিদগ্ধ ছিলেন। আলাওল প্রতি কাব্যেই তাঁর ভ‚য়সী প্রশংসা করেন। রোসাঙ্গ রাজ্যের প্রধান অমাত্য মাগন ঠাকুর ছিলেন আলাওলের প্রধান পৃষ্টপোষক। তার আদেশ ও অনুরোধে কবি দুটি কাব্য রচনা করেন। ‘পদ্মাবতী’ ও ‘সয়ফুল মুলুুক বদিউজ্জমাল’।
মাগন ঠাকুরের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকাতর কবি কাব্য সাধনা ত্যাগ করেন। ইতোমধ্যে দিল্লীর সম্রাট শাহসুজা তার ভাই সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক বঙ্গদেশ হতে বিতাড়িত হন। মীর জুমলার দ্বারা পশ্চাদ্বাবিত হয়ে রোসাঙ্গ রাজার আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু মীর জুমলার প্ররোচনায় রোসাঙ্গ রাজা শাহসুজাকে হত্যা করেন। কবি আলাওলের জীবনেও অকস্মাৎ এক ট্রাজেডী হাজির হয়। মির্জ্জা নামক এক খারাপ লোকের অপবাদে আলাওল কারাগারে বন্দি হন। কিন্তু খুব শীঘ্রই রাজা তার ভুল বুঝতে পেরে আলাওলকে সসম্মানে মুক্তি প্রদান করেন। শুধু তাই নয় তাকে কাব্য সাধনা করতে অনুপ্রাণিত করেন। কবি আবার নতুন করে কাব্য চর্চ্চা শুরু করেন। মাগন ঠাকুরের মৃত্যুর পর রোসাঙ্গ রাজার সৈন্যাধ্যক্ষ সৈয়দ মুসা তাকে আশ্রয় দান করেন। সৈয়দ মুসা কাব্য রসিক ও ধার্মিক ছিলেন। তার অনুরোধ রক্ষা করতে কবি পুনরায় কাব্য চর্চায় মন দেন। শেষে সয়ফুল মুলুক শেষ করেন।
আলাওলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা ‘পদ্ধাবতী’। যার রচনাকাল ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দ। হিন্দী ভাষার সাধক কবি মালিক মুহাম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্যের স্বাধীন কাব্যানুবাদ আলাওলের ‘পদ্মাবতী’। অযোধ্যার জায়েস নামক স্থানের অধিবাসী মালিক মোহাম্মদ ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে ‘পদুমাবৎ’ কাব্য রচনা শুরু করেন এবং শেষ করেন শের শাহের শাসন কাল ১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে। আলাওল জায়সীর কাব্যের হুবহু অনুবাদ করেননি। তিনি কখনও আক্ষরিক, কখন ও ভাবানুাবদ, আবার কখনও স্বাধীনভাবে অনুবাদ করেন।
১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে কবি আলাওল মহাকবি নেজামী গজনবীর রচিত ‘হপ্ত পয়কর’ অনুবাদ করেন। সাতটি পয়কর বা গল্প বর্ণিত বলে কাব্যের নাম হয় ‘হপ্তপয়কর’। ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘তোহফা’ বা ‘তত্তোপদেশ’ ফারসী কবি ইউসুফ গদার রচিত আলাওলের বাংলা অনূদিত গ্রন্থ। ‘সেকান্দরনামা’ মহাকবি নেজামীর বঙ্গানুবাদ।
আলাওলের রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘পদ্মাবতী’ শ্রেষ্ঠতর। অনুবাদ সাহিত্য হওয়া সত্তে¡ও রোমান্টিক এই প্রণয় গাঁথায় বিমোহিত সকল পাঠক। ‘পদ্মাবতী’র সাহিত্যমূল্য বিচার্তে দীনেশচন্দ্রসেন লিখেছেন-“ ‘পদ্মবতী’ কাব্যে আলাওলের গভীর পাণ্ডিত্যের পরিচয় আছে। কবি পিঙ্গলাচার্যের মগন, রগন প্রকৃতি অষ্ট মহাযানের তত্ত¡ বিচার করিয়াছেন, খন্ডিতা, বাসকসজ্জা ও কলহান্তরিকা প্রভৃতি অষ্ট নায়িকার ভেদ বিরহের দশ অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে আলোচনা করিয়াছেন, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র লইয়া উচ্চাঙ্গের কবিরাজী কথা শুনাইয়াছেন, জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্ক লগ্নাচার্যের ন্যায় যাত্রার শুভাশুভের এবং যোগিনী চক্রের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ভাষার দক্ষতা আলাওলের বিস্ময়কর। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য পর্যালোচনা কালে দেখা যায় সাহিত্যে দেব-দেবী, প্রণয়, ভক্তি, মাহাত্ম্য কীর্তন, রাধা, কৃষ্ণের প্রেম প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক পরিপুষ্ট কবিতার জয়গান। সাহিত্যে মানব মানবীর কোন কথা নেই। মুসলমান কবিরাই প্রথম মানুষকে বাংলা সাহিত্যে তুলে ধরলেন। বিশেষ করে রোসাঙ্গ রাজসভার তিন জন শক্তিশালী ও অমর প্রতিভাবান কবির সাধনায় বাংলা সাহিত্যের গতি মানুষের দিকে ধাবিত হয়। তারা হলেন দৌলত কাজী, কোরেশী মাগন ঠাকুর ও আলাওল। তাদের হাতের জাদুষ্পর্শেই বাংলা কবিতা উজ্জল হয়ে উঠে। বাংলা সাহিত্য থেকে ধর্মকে নির্বাসিত করার এই দু:শাহস মুসলমান কবিরাই প্রথম দেখিয়েছেন। মানুষের জীবন, প্রেম, সুখ, দু:খ তারা রুপায়ন করেন গভীর মমতায়। বাংলাদেশের প্রচলিত রুপকথা, বঙ্গীয় উপাদান, ভাষা দেশপ্রেম নিয়ে সাহিত্য ধারা সৃষ্টি করে তারা আমাদের গৌরবকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন। আর আলাওলের কাব্যধারা ও ছিল তা নিয়েই। আমাদের গর্বিত ঐতিহ্যের ল্যাম্পপোস্ট, বাংলা মানবীয় কবিতার বটবৃক্ষ মহাকবি আলাওল হোক আমাদের জীবন চলার অনুপ্রেরণার অনি:শেষ উৎস।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন