শ্রমিকদের স্বচ্ছ ধারণা দিতে ব্যর্থতা, স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র, কারখানা মালিকের অদূরদর্শিতা এবং মজুরি কাঠামো নির্ধারণে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া তৈরি পোশাক শিল্পের সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে মূল কারণ বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে শ্রমিকদের কাছে মজুরি বাড়ার সঠিক তথ্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মালিকদের আন্তরিকতায় ঘাটতি খুঁজে পেয়েছে সিপিডি। শনিবার (২৬ জানুয়ারি) ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে ‘পোশাকখাতে সাম্প্রতিক মজুরি বিতর্ক : কী শিখলাম?’ শীর্ষক সংলাপে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সিপিডি। এই ধরনের সমস্যা এড়াতে কিছু সুপারিশও তুলে ধরেছে সংস্থাটি। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এই সুপারিশের প্রশংসা করলেও তা এদেশের জন্য প্রযোজ্য নয় বলে মত জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা।
সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি প্রফেসর রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে সংলাপে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএ’র বর্তমান সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সিপিডি’র ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডিরি গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
মূল প্রবন্ধে সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের প্রধান কারণ হিসেবে বেশকিছু ত্রুটি তুলে ধরে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিভিন্ন গ্রেডের মজুরি সমন্বয়ে বৈষম্য ছিল। এক্ষেত্রে কেবল সপ্তম গ্রেড ছাড়া অন্য সব গ্রেডের শ্রমিকরা জানিয়েছেন যে, মজুরি কাঠামো যথাযথ ছিলো না। দ্বিতীয়ত, যে মজুরি বাড়ানো হয়েছে সে বিষয়ে শ্রমিকরা সঠিক ধারণা পাননি। মালিক পক্ষ শ্রমিকদের এ বিষয়ে প্রকৃত ধারণা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আবার একেক কারখানায় একেকভাবে মজুরি বাস্তবায়ন ঘটেছে, আবার অনেক কারখানা নতুন কাঠামো অনুসরণ করে মজুরি বাড়ায়নি। তৃতীয়ত, শ্রমিকদের অসন্তোষের মাত্রা এলাকা ভেদে ভিন্ন। চতুর্থত, অসন্তোষ মেটাতে সব শিল্প এলাকার মালিকরা একই রমক সাড়া দেননি। ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী ও গাজীপুর অঞ্চলের শ্রমিক, কারখানা মালিক ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই অসন্তোষের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে সিপিডি। পোশাক খাতে এসব বিষয় সমাধানে কিছু প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি। এর মধ্যে রয়েছে মজুরির পরিবর্তন বিষয়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো, ভবিষ্যতে মজুরি বৃদ্ধির উদ্যোগের সময় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আরও বেশি মতবিনিময়, নারী শ্রমিকদেরকে তাদের গ্রেড, মজুরি ও অন্যান্য আর্থিক ইস্যুগুলো আরও ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। এছাড়া শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে আরও কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করা, মজুরি আন্দোলনের পর শ্রমিকদেরকে নতুন করে হয়রানি থেকে বিরত থাকা। বিশেষ করে বায়োমেট্রিক ডাটাবেইজে কাউকে নেতিবাচক তালিকায় পাঠানোর আগে ত্রিপক্ষীয় কমিটি দিয়ে পর্যালোচনা করা এবং মজুরি বৃদ্ধির চাপ কারখানাগুলো কীভাবে সামলাবে সেজন্য ব্রান্ড ও বায়ারদের উচিত যৌথভাবে একটি কৌশল নির্ধারণ করা।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সিপিডির সুপারিশগুলোর প্রশংসা করে বলেন, ভবিষ্যতে এই সুপারিশ একটি ‘গাইডলাইন’ হিসাবে ভূমিকা রাখবে। বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ তৈরি পোশাক খাতে অসন্তোষ দূর করতে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে পাঁচ জনের একটি প্রতিনিধি দল তৈরির কথা বলেন। একই সঙ্গে এই প্রতিনিধি দল মালিক পক্ষসহ সরকারের সঙ্গে শ্রমিকরা প্রতিনিধিত্ব করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো শ্রমিককে যদি কোনো মালিক অন্যায়ভাবে বের করে দেয় সেটা গ্রহণযোগ্য না। কেননা সেটা অমানবিক। স্বার্থের জন্য অন্যায়ভাবে কাউকে এরকম করা ঠিক হবে না’। আলোচনায় শ্রমিকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, আন্দোলনকারী শ্রমিকদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুই-একজন ছাড়া বেশিরভাগই এখনও ছাড়া পাননি।
এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, কোনো শ্রমিক যেন অন্যায়ভাবে মামলায় জড়িয়ে না পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে যেন মামলা দেয়া না হয়। এটা ঠিক হবে না, এটা আমরা চাই না। কিন্তু যে ঝামেলা করবে, যে ভাঙবে সেটা কিন্তু গ্রহণযোগ্য নয়।
‘কখনও কখনও এমন বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা ঘটেছে’ উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, উত্তরাতে আমরা দেখেছি, কোনো কারখানা নাই, কিছু নাই, সেখানেও কিছু লোক হঠাৎ করে গাড়ি ভাঙা শুরু করে দিল। তাদের ডাকা হলো, ধরা হলো; তাদের অনেকে শ্রমিকও না। হয় তারা শ্রমিকের নাম ব্যবহার করে করছে শ্রমিকদের ইমেজ খারাপ করার জন্য অথবা শ্রমিকদের উসকে দেয়ার জন্য। এগুলোর বিষয়ে আমরা চাই, একটা ভালো মনিটরিং কমিটি হোক। আপনারা পাঁচজন থাকেন, সব সময় আমাকে সাহায্য করেন। আমি আপনাদের সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব।’ বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বেতনের ব্যাপারে যেটা করা হয়েছে, আমাদের বিজিএমইএ যেন অত্যন্ত সতর্কভাবে সেটা ফলোআপ রাখে। শ্রমিক ও মালিক মিলে যা করা হয়েছে, সেটা আপনারা ঠিকভাবে পালন করবেন। যাতে কোথাও কোনো মালিক এর সুযোগ নিতে না পারে। একটা-দুইটা কারখানার জন্য আমাদের এতগুলো কারখানার ইমেজ নষ্ট করতে দেয়া ঠিক হবে না।
প্রফেসর রেহমান সোবহান বলেন, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো মানে আমরা এমন কোন দাবি উত্থাপন করছি না যে তাদের জন্য খুব জাকজমকপূর্ণ জীবযাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। বরং তাদের জন্য আমরা এমন একটি মজুরি চাই যা দিয়ে তারা ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। পোশাক খাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতে তিনি বাণিজ্যমন্ত্রীকে বেশকিছু পরামর্শ দেন।
শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মজুরি কাঠামোয় গ্রেডে সংখ্যা কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, গ্রেডের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। কারণ পোশাকখাতে মজুরি হয় কাজের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে। মজুরি বাড়লেও বিশ্ববাজারে দিনে দিনে পোশাকের দাম কমছে দাবি করে তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে আরও বেশি সরকারি সহায়তা না পেলে এই শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
পোশাক শিল্পে সরকার প্রণোদনা বাড়ানোর কথাটি সঠিক নয় বলে দাবি করেন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, করপোরেট কর ও উৎস কর কমানো হয়েছে বলা হচ্ছে। কিন্তু কমিয়ে যে পর্যায়ে আনা হয়েছে, কয়েক বছর আগেই সে পর্যায়ে ছিলো। সুতরাং এটি আমাদের জন্য কোন ধরনের প্রণোদনা হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারছে না। জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে স্বার্থান্বেষী মহলের হাত থাকতে পারে বলে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন।
সিপিডির সুপারিশগুলো বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে মেলে না বলেও দাবি করেন বিজিএমইএ সভাপতি। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সিপিডি যে প্রস্তাবনা বা তত্ত্ব উপস্থাপন করেছে, তা উন্নত বিশ্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু বাংলাদেশ এখন নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রচেষ্টায় আছে। এগুলো আমাদের দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
শ্রমিক নেতা মন্টু ঘোষ বলেন, শ্রমিকরা তাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। সেখানে পুলিশ যদি তাদের ওপর আঘাত করে, তার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে, সেটা সবারই জানার কথা। এটা নিয়ে এখন যে শ্রমিক হয়রানি হচ্ছে কিংবা দোষারোপ করা হচ্ছে, সেটা উচিত নয়। মনের ভেতরে ক্ষোভ জমিয়ে রেখে প্রকৃত উৎপাদন সম্ভব নয়। বিক্ষোভের পরিস্থিতি খুব দরদ দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে।
উল্লেখ্য, এ মাসের শুরুতে তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের পর দেখা দেয় শ্রমিক অসন্তোষ। পরে সরকারের উদ্যোগে কয়েকটি গ্রেডে সংশোধন এনে মজুরি কাঠামো সংস্কার করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর অঞ্চলের ৬১ জন শ্রমিক, কারখানা মালিক ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই অসন্তোষের কারণ খুঁজে বের করে সিপিডি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন