সড়কে কোনোভাবেই শৃঙ্খলা ফিরছে না। ফলে বন্ধ হচ্ছে না প্রাণহানির ঘটনা। প্রাণ যাচ্ছে একের পর এক। এভাবেই কি দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে মানুষের মৃত্যুর বিভীষিকা চলতে থাকবে? দেশে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে যে, দুর্ঘটনা রোধে হালে বিশেষ বাহিনী গঠনের দাবি উঠছে। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি র্যাব বাহিনী গঠন করা যায়, দুর্ঘটনা রোধে এ-জাতীয় বাহিনী নয় কেন? কোনভাবেই তা রোধ করা যাচ্ছে না।সরকারি ও বেসরকারিভাবে এ দুর্ঘটনা রোধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও সড়ক দুর্ঘটনা বাস্তবে কার্যকর করা যাচ্ছে না।আমাদের দেশের গাড়ি চালকের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা,অতি দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো,ওভারটেক করাসহ বিভিন্ন কারনে সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়ে যাচ্ছে।আর এই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আমাদের দেশে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে।সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও অঙ্গহানির ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীসহ দেশব্যাপী আন্দোলনে দিন কয়েকের জন্য সড়কে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরলেও আবারও আগের অবস্থায় ফিরে গেছে সব। বিশেষজ্ঞদের মনে প্রশ্ন, এত বড় আন্দোলনে হুঁশ না ফিরলে আর কবে ফিরবে?
আগের মতোই ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলছে। চালক ও সহকারি কেউ আইন মানছে না। অধিকাংশ গাড়ি বা চালকের বৈধ কাগজপত্র নেই। গুটি কয়েকের কাছে লাইসেন্স থাকলেও সেগুলো নবায়ন করা হয়নি। যত্রতত্র থামানো হচ্ছে বাস। নিজেদের ইচ্ছেমতো যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে। বাসের রেষারেষিও চলছে আগের মতো। অন্যদিকে, যাত্রীরাও ফিরে গেছে আগের অবস্থায়। আইন-কানুন মানার কোন প্রয়োজন মনে করছে না পথচারীরা। সিগন্যালের তোয়াক্কা না করে যাচ্ছেতাইভাবে রাস্তা পাড় হচ্ছে। ফুট ওভারব্রিজ ও জেব্রার ক্রসিং থাকলেও সেগুলোর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কাছাকাছি গাড়ি চলে আসলেও হাতের ইশারা দিয়ে কোন রকমে দৌড়ে পার হচ্ছে। একইভাবে নগরীর ফুটপাতগুলোর অবস্থাও বেহাল। নগরবাসী মনে করছে, আন্দোলনের পরে সড়ক ও ফুটপাতে ভাসমান দোকানের সংখ্যা আরও বহুগুণ বেড়েছে। অনেক এলকায় ফুটপাত ছেড়ে মূল সড়কে দোকান বসিয়েছে ভাসমান হকাররা। কেউ আইন মেনে রাস্তায় চলতে চাইলেও হকারদের হাক-ডাকে সেটি কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে মূল সড়ক ধরে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিকরা। গত বছর বাংলাদেশে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথের মোট দুর্ঘটনার সংখ্যা ৬ হাজার ৪৮টি। এসব দুর্ঘটনায় মোট নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৭৯৬ জন। আহতের সংখ্যা ১৫ হাজার ৯৮০। এসব তথ্য বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের পাঁচ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ২২১ জন নিহত হয়েছে। অন্যদিকে রেলপথের ৩৭০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৩৯৪ জন, নৌপথের ১৫৯টি দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১২৬ এবং আকাশপথে পাঁচটি দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৫৫ জন।
সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৭ হাজার ৩৫০টি যানবাহনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এসব যানবাহনের মধ্যে ১৮.৯২ শতাংশ বাস, ২৮.৬৮ শতাংশ ট্রাক ও কাভ্যার্ডভ্যান, ৭.৯৩ শতাংশ কার জিপ ও মাইক্রোবাস, ৯.৬১ শতাংশ অটোরিকশা, ২৫.৩০ শতাংশ মোটরসাইকেল, ৩.৭২ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ৫.৮০ শতাংশই ছিল নছিমন, করিমন ও হিউম্যান হলার। দুর্ঘটনাগুলো ৪১.৫৩ শতাংশ গাড়ি চাপায়, ২৯.৭২ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষে, ১৬.১৮ শতাংশ খাদে পড়ে, ০.৫৫ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে এবং ০.৮৯ শতাংশ ট্রেন-যানবাহনের সংঘর্ষে ঘটেছে।
২০১৮ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান অনুযায়ি, জানুয়ারি মাসে ৪৯৯ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫১৪ জন, আহত ১৩৫৩ জন। ফেব্রæয়ারিতে ৪৩৯ দুর্ঘটনায় ৪৫৯ জন নিহত, আহত ১৫২১ জন; মার্চে ৪৯১ দুর্ঘটনায় নিহত ৫০৩ জন ও আহত ১৫০৬ জন; এপ্রিলে ৪৫১ দুর্ঘটনায় ৪৭১ জন নিহত ও আহত ১২২৩ জন; মে মাসে ৪৫৮ দুর্ঘটনায় ৪৮৪ জন নিহত ও আহত ১১২৭ জন; জুনে ৫২২ দুর্ঘটনায় নিহত ৬১৫ জন নিহত ও আহত ১৭৯০ জন; জুলাইয়ে ২৭৬ দুর্ঘটনায় নিহত ৪২৫ জন ও আহত ১১২২ জন; আগস্টে ৪৯১ দুর্ঘটনায় নিহত ৫১৯ জন ও আহত ১৬৩৮ জন; সেপ্টেম্বরে ৪২৩ দুর্ঘটনায় নিহত ৫১৪ জন ও আহত ১১৬৬ জন; অক্টোবরে ৩৯৫ দুর্ঘটনায় ৪৯৫ জন নিহত, ৭৭০ জন আহত; নভেম্বরে ৪৩২ দুর্ঘটনায় নিহত ৪৩৩ ও আহত ৯৭৯ জন এবং ডিসেম্বরে ৫৩৭ দুর্ঘটনায় ৫৮৪ জন নিহত ও আহত হন ১২৭১ জন।
বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো, রেল ক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা সহ আরও বেশ কয়েকটি কারণে এসব দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে, ট্রাফিক আইন, মোটরযান আইন ও সড়ক ব্যবহার বিধিবিধান সম্পর্কে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। একইসঙ্গে টিভি-অনলাইন, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সড়ক সচেতনতামূলক বা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা, জেব্রাক্রসিং দেওয়া, চালকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, যাত্রীবান্ধব সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন, গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতিগত উন্নয়ন-আধুনিকায়ন, জাতীয় মহাসড়কে কমগতি ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা এবং লাইসেন্স নবায়নের সময় চালকদের জন্য ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে।
সংসদে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন দ্রুত বাস্তবায়ন করে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে সড়ক নিরাপত্তা তহবিল গঠন করা যেতে পারে।পৃথিবীর কোথাও এমন বিশৃঙ্খল ব্যবস্থা নেই। রাজধানীতে ২৭৯টি রুটে ২৪৬টি কোম্পানির বাস চলাচল করে। মাত্র ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের নগরীতে এত রুট ও অনেক কোম্পানির বাস চলায় সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা অনেক কঠিন। সড়কের বিশৃঙ্খলা বহু পুরনো। আস্তে আস্তে এ গুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনে যুক্ত ক্ষমতাসীনরা আইন প্রণয়নে যুক্ত থাকে। যার কারণে সর্বদা যাত্রী স্বার্থ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন