মায়ের কাছে শেখা বুলি পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর। এরচেয়ে মধুর আর কোনো ভাষা হতে পারে না।
যে যতো বড় শিক্ষিত, ডিগ্রীধারী পণ্ডিতই হোক না কেন মাতৃভাষা ছাড়া তার পক্ষে মনের আবেগ-অনুভূতিটুকু সুক্ষভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই সহজ ও সাবলীলভাবে মায়ের ভাষায় তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ!’ এর অভাবে শিক্ষা পরিপুষ্টি লাভ করে না, সর্বাঙ্গীণ হয় না সর্বোপরি প্রতিদিনের জীবনযাত্রা।
তাঁর এই উক্তিটি যে কতটুকু সত্যি তা আমরা মহাকবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের জীবনীতে দেখি, তিনি রাতারাতি নাম, যশ খ্যাতি অর্জনের আশায় নিজ ভাষা পরিত্যাগ করে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন, কিন্তু কিছুদিন যেতেই তাঁর ভুল ভাঙে। তাইতো তিনি লিখেছেন-
‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।’
আজ যে বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, সেই প্রাণের ভাষা, গানের ভাষার জন্য আমার ভাইয়ের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হয়েছে রাজপথে। বিশ্বের বুকে বাংলা হচ্ছে একমাত্র ভাষা যার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে।
বর্তমানে জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা ভাষার অবস্থান
৭ম, বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক এ ভাষায় কথা বলে।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দু’টি অংশ— পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত
বিষয়ে মৌলিক পার্থক্য ছিলো স্পষ্ট, সাদৃশ্য যা ছিলো তা হচ্ছে ধর্ম।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? বাংলা নাকি উর্দু? নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবী করা হয় । উলেখ্য সেই সময়ে সরকারী কাজকর্ম ছাড়াও সকল ডাকটিকেট, পোষ্টকার্ড, ট্রেন টিকেটে কেবলমাত্র উর্দু এবং ইংরেজিতে লেখা থাকতো, অথচ হাস্যকর হলেও সত্য, উর্দু ছিলো পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ লোকের ভাষা। অপরদিকে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ ভাগ লোকের ভাষা ছিলো বাংলা।
মাথামোটা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে বাদ দিয়ে নিজেদের আধিপাত্য বিস্তারের জন্য উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
ডিসেম্বরের শেষের দিকে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং তমদ্দুন মজলিশের আহবায়ক অধ্যাপক নুর‘ল হক ভুইয়া এর আহবায়ক নিযুক্ত হন ।
জানুয়ারি ১৯৪৮ পূর্ব পাকিস্তান স্টুডে’টস লিগের জন্ম । এর প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ।
১১ মার্চ ১৯৪৮, এইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবীতে একটি বড় সমাবেশ আয়োজন করা হয় । সমাবেশ শেষে বের হওয়া মিছিলে মুসলিম লীগ সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী হামলা চালায় এবং মিছিল থেকে শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, অলি আহাদ সহ বেশ কয়েকজন ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি হিসাবে অভিহিত করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ইসলামীকরণের অংশ হিসাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নামেন।
২১ মার্চ - ১৯৪৮, রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর পূর্ব পাকিস্তান সফর উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিশাল সমাবেশে জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’। সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও জনতার একাংশ সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করে ওঠে। জিন্নাহ সেই প্রতিবাদকে আমলে না নিয়ে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন।
২৪ মার্চ ১৯৪৮, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ্রষ্টুডে’টস রোল ইন নেশন বিল্ডিংগ্ধ শিরোনামে একটি ভাষণ প্রদান করেন। সেখানে তিনি ক্যাটেগরিক্যালী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবীকে নাকচ করে দিয়ে বলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয়কে তুলে ধরে।
জিন্নাহর এই বক্তব্য সমাবর্তন স্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং ছাত্ররা দাঁড়িয়ে ্রনো নোগ্ধ বলে প্রতিবাদ করেন। জিন্নাহর এই বাংলা বিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন আরো বেশী গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।
২৬ মার্চ ১৯৪৮, জিন্নাহ ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে বৈঠক করেন এবং বৈঠকে তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দেন। সেই সাথে ১৫ই মার্চ ষ্টুডে’টস একশন কমিটির সাথে খাজা নাজিমুদ্দিনের বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতির অঙ্গীকারনামা বাতিল ঘোষণা করেন।
২৮ মার্চ ১৯৪৮, ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে এক রেডিও ভাষণে জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তার মনোভাব পুনর্ব্যক্ত করেন।
৬ এপ্রিল ১৯৪৮, জিন্নাহর ঢাকা ত্যাগের পর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে।
কবি বলেছেন, নানান দেশের নানান ভাষা।
বিনে স্বদেশীয় ভাষা,
পুরে কি আশা?গ্ধ
তাই তো পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত শ্রেণী পেশার লোক মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে দিন দিন আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে।
১৯৫২ সালের ফ্রেব্রুয়ারী মাসে ভাষা আন্দোলন চুড়ান্ত রূপ ধারণ করে।
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, পাকিস্তান সরকার, ২১ ফেব্রুয়ারী ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুর‘ ।
সকাল ১১ টা কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুর‘ হয়।
সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয় । এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুর‘ করে । গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিকউদ্দিন আহমদ, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তর‘ণ মৃত্যু বরণ করেন। পরে হাসপাতালে আব্দুস সালাম যিনি সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন মৃত্যু বরণ করেন । অহিউলাহ নামে ৯ বছরের একটি শিশুও পুলিশের গুলিতে মারা যায় । পুলিশের সাথে ছাত্রদের ৩ ঘ’টাব্যাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে কিন্তু পুলিশ গুলিবর্ষণ করেও ছাত্রদের স্থানচ্যূত করতে ব্যর্থ হয় ।
ইতিমধ্যে বাংলাকে জাতিসংঘের ৭ম দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দেওয়ার জোর দাবী জানানো হয়েছে, তা যদি হয়
বাংলা ভাষা এবং বাঙালিরা বিশ্বের বুকে স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে নিজেদের স্থান করে নিবে, শহীদের আত্মা পাবে তৃপ্তি।
ভাষার কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে সগৌরবে স্বীকৃত। শুধু তাই নয়, আফ্রিকান রাষ্ট্র সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটিরও বেশি লোকের মাতৃভাষা ‘বাংলা’।
তবে, শুধু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আর বৃহত্তম জনগোষ্ঠীের ভাষা বাংলা এই ভেবে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুললে হবে না। সর্বত্র শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা করতে হবে। একুশের চেতনাকে মনে প্রাণে লালন করতে হবে,
তবেই ভাষা আন্দোলন তথা শহীদের আত্মদান সার্থক হবে।
(তথ্যসমূহ-ই’টারনেট থেকে সংগৃহীত)
১৪৪৭. চাহিবার প্রশ্ন কোথা ? ছিলই না অস্তিত্ব যখন
স্বতঃই সকল কিছু তুমি দান করেছ তখন।
১৪৪৮. দিয়েছ এ বা¯‘ভিটা খাদ্য পানি - জীবন অসীম
বর্ণনার সাধ্য নাই সে অশেষ দানের করীম।
১৪৪৯. দান করে করে প্রভু নিয়ে যাও দারুস সালাম*১
অসিলায় প্রিয় নবী মোস্তফার- খায়রুল আনাম*২।
১৪৫০. করিবেনা কেন দান ? এই অস্তি- জগৎ সংসার
ওগো সর্বশক্তিমান ! সকলি তো বখশিশ তোমার।
খরগোশের বনের পশুদের নিকট গমন ও সিংহ নিহত হওয়ার সংবাদ প্রদান
১৪৫১. মুক্তির মহানন্দে খরগোশ এবার
ছুটিয়া চলিল সেই প্রান্তরের পানে
১৪৫২. যেখানে রয়েছে সব সাথী বন্ধু তার।
দেখিল আপন চোখে সিংহকে যখন
নিজ যুলুমের পাপে নিরূপায় অসহায় রূপে
নিহত হইতে পড়ে জঙ্গলের কূপে
আনন্দ-অধীর চিতে নেচে নেচে চলিল তখন
যেথায় রয়েছে তার বন্ধু ও স্বজন।
১৪৫৩. মিত্তিকার কারামুক্ত হয়ে যথা বন বিটপির
সুশ্যামল কিশলয় উঁচু করে শির
১৪৫৪. নৃত্য করে সমীরণ সনে
চলিল খরগোশ সেই মত নৃত্য করে
সবুজ প্রান্তর পানে প্রফুল্ল বদনে।
১৪৫৫. শক্ত কান্ড ভেদ করে নব পত্র-পল্লব যখন
নিচ থেকে ক্রমে ঊর্ধ্বে করে আরোহণ
১৪৫৬. তখন অঙ্কুর দল আপন ভাষায়
আল্লা’র দরবারে করে শোকর আদায়।
পত্র পল্লব শাখা ফল মূল সব
তসবি জপিতে থাকে
করে মহাবিভুর স্তব।
১৪৫৭. গায় তারা : দয়াময় করুণা নিধান
আমাদের মূলদেশে করেছেন।
১৪৫৮. খাদ্য পানি দান
তার ফলে মোটা তাজা হয়েছি আমরা বৃক্ষ কুল।
১৪৫৯. হয়েছে মজবুত দৃঢ় আমাদের দেহ কান্ড মূল।
পানি ও কাদার মাঝে রুদ্ধশ্বাস বন্দি প্রাণগুলো
মুক্ত হয়ে নিগঢ় কারার
নাচে প্রেম-সমীরণে মহান ধাতার।
পূর্ণিমা-চন্দ্রের মত দীপ্তিময় নি¯‘লুশ মনে
দোলা লাগে, ঢেউ জাগে
নৃত্য করে দেহ কায়া
আল্লাহর প্রেম-সমীরণে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন