শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

আমি কি ভুলিতে পারি?

আ লী এ র শা দ | প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৯, ১২:১১ এএম

একটি জাতির জীবনে এমন কিছু গান, কবিতা, বাণী থাকে যা বিশেষ মুহূর্ত, দিবস বা মাসের মাহাত্ম্য ঘোষণা করে সগৌরবে।

এ সকল গান, কবিতা, বাণীগুলোকে বলা যায় টনিক বা সঞ্জীবনী। যা মানুষের হৃদয়কে চাঙ্গা করে, মানুষকে আলোড়িত, শিহরিত, অনুরণিত করে। মানুষকে মনে করিয়ে দেয় তার শেকড়ের কথা। এ গান, কবিতা, বাণীগুলো কালের পরিক্রমায় মানুষের জীবনযাত্রা তথা সংস্কৃতির সাথে এমনভাবে মিশে যায় যে এই বিশেষ টনিক বা সঞ্জীবনী ছাড়া মনে হবে ঐ বিশেষ মুহূর্ত, দিবস বা মাসটিই আসেনি। তেমনই একটি কবিতা বা গান হলো-
্র আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারিগ্ধ
এ গানটিতে গভীর বেদনা লুকায়িত রয়েছ। রয়েছে সত্য ইতিহাস, রয়েছে অন্যায় ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জেগে ওঠার আহ্বান। গানটিতে মহান ভাষা আন্দোলনে আত্মাহুতি দানকারী শহীদদের ত্যাগ, মহিমার কথা ফুটে উঠেছে ভিনড়বরকম এক কাব্যিক দ্যোতনায়।
ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলাদেশের আনাচে -কানাচে,বিভিনড়ব স্কুল, কলেজে এ গানটি বাজানো হয়।
এ গানটি শুনলেই মনে হয় ভাষা আন্দোলন এবং ভাষা শহীদদের কথা। মনে হয় দুয়ারে হাজির ঐতিহাসিক ফেব্রুয়ারি মাস। বিশেষকরে, ২১ শে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরিতে খালি পায়ে যখন শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ অর্পন করা হয়, তখন এ গানটি না গাইলে বাঙালির কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি একেবারেই ম্লান। একুশে ফেব্রুয়ারির সমার্থক,একুশে ফেব্রুয়ারির আরেক নাম এ গান যা ্রএকুশের গানগ্ধ নামে পরিচিত।
গানটির রচিয়তা বিশিষ্ট গ্রন্থাকার, কলামিস্ট, সাহিত্যিক
আবদুল গাফফার চৌধুরী। তিনি ১৯৩৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর, বরিশাল জেলার এক জলবেষ্টিত গ্রাম উলানিয়ার চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে হাইস্কুলে ভর্তি হন।১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে।১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ন্যায্য দাবিতে ছাত্ররা মিছিল বের করলে বর্বর পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। নিহত হন সালাম, রফিক,বরকত, জব্বার, সহ আরো অনেকেই।
হতাহতদের দেখতে সকলের সাথে বিকেলে আবদুল গাফফার চৌধুরীও হাসপাতালে। তিনি ঢাকা মেডিকেলের গেটের সামনে একটি রক্তমাখা লাশ দেখতে পান। বড়ই বিভৎস ছিল লাশটি। লাশটির মাথার খুলি বুলেটের আঘাতে উড়ে গিয়েছিল। এটি ছিল ভাষা শহীদ রফিকের লাশ। লাশটি দেখে তার চোখে জল চলে এলো। ভাইয়ের এমন রক্তমাখা লাশ দেখে তার মনে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল, তারই প্রেক্ষিতে তিনি লিখেন এ অমর কবিতাখানি।
্আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।।
যা পরবর্তীতে গান হিসাবে গাওয়া হয়।
গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় একটি লিফলেটে। সেখানে ‹একুশের গান› শিরোনামে কবিতা আকারে ছাপা হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে ‹একুশে সংকলনে› এটি স্থান পায়। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে।
ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গনে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময়ও গানটি গেয়েছিল। এ কারণে তাদেরকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
গানটিতে সর্বপ্রথম সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদ যিনি সে সময়কার একজন শ্রেষ্ঠ সুরকার এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন,গানের সুরে পরিবর্তন আনেন। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুর করা গানটিই গাওয়া হয়। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে।
অমর এ গানটি বিখ্যাত চলচিত্রকার জহির রায়হান ১৯৬৯ সালে তাঁর ্রজীবন থেকে নেয়াগ্ধ চলচিত্রে ব্যবহার করেন।
এ গানটি এখন শুধু বাংলাদেশ বা বাংলা ভাষার মানুষই না, সারা বিশ্বের মানুষও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। কারণ একুশে ফেব্রুয়ারি এখন সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আর এই গানটি বর্তমানে হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়।
একটি জাতির জীবনে এমন কিছু আচার-অনুষ্ঠান থাকে যা সেই জাতির রক্তের সাথে মিশে সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে থাকে। জাতির সুখ-দুঃখ, আবেগ অনুভূতির সাথে মিশে এমন এক কিংবদন্তীতে পরিণত হয় যা অস্বীকার করা মানে ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করার সামিল। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই বিশেষ অংশটিই হয়ে উঠে মূর্তমান ইতিহাস।
ভাষা আন্দোলন বাঙালির জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রতিটি বাঙালির কাছে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে অদ্বিতীয় ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে আমরা কি তা কখনও ভুলতে পারি? ভাষা আন্দোলনকে যেমন কেউ ভুলতে পারব না তেমনি ভুলতে পারব না এরই প্রেক্ষাপটে রচিত ্রআমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারিগ্ধ কালজয়ী গানটিকে। কারণ এ গানটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে ধারণ করে।
ভাষা আন্দোলন, আন্দোলনে সকল শহীদ, একুশের গানটির লেখক, সুরকার সব মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, সত্যিই আমি বা আমরা কি ভুলিতে পারি?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন