এম এ বাশার
কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি, প্রতিবাদী কবি। সমাজে চাপা পড়া, অবহেলার শিকার মানুষদের জন্য তিনি লিখেছেন। তাদের মর্যাদার জন্য সোচ্চার হয়েছেন। সমাজে যে রক্ষণশীলতা, প্রাতিষ্ঠানিক নানা বিধি-নিষেধ, কুসংস্কার ও গোঁড়ামিÑএসবের হাত থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন। তাঁর এ ভাবনা ও চিন্তা-চেতনা আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন। তাঁর বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় ঘটে তাঁর লেখায়। তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে বিশ্বজুড়ে এক অনন্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে তাঁর অগ্নিঝরা লিখনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আনতে সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর লেখায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল শ্রেণীর মানুষ স্বাধিকার আদায়ে আন্দোলন করেছে। মেতে উঠেছে যুদ্ধে।
তিনি শুধু কবি নন, তিনি ছিলেন সমাজ পরিবর্তনের এক রূপকার। তিনি প্রতিটি পেশাজীবী মানুষকে লিখনীর মাধ্যমে আন্দোলনকে বেগবান করেছিলেন। তাঁর জ্বালাময়ী কবিতার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই ব্রিটিশ শাসকের টনক নড়ে ওঠে। তাঁর এ কবিতা রচনার জন্য ব্রিটিশ শোষকরা আমাদের প্রিয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কারাগারে আবদ্ধ করেছিল।
তিনি সকল শ্রেণীর মানুষকে সম-মর্যাদায় আনতে লিখে গেছেন অবিরত। মুটে, মজুর, কৃষক, কামার-কুমার সকলের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি অসংখ্য কবিতা, গান, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়সহ নানা বৈচিত্র্যের লেখার মধ্য দিয়ে জাগ্রত করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর পরিবারসহ আত্মীয়-পরিজনের অধিকাংশই ছিলেন কৃষিজীবী। গ্রামের সেই কুসংস্কারে আবর্তিত জীবনধারায় তাঁকে নানা বৈচিত্র্যে বেড়ে উঠতে হয়েছে।
সমাজের মানুষকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষক সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কাজী নজরুল ইসলামের আন্তরিকতা ছিল অনেক। তিনি তাঁর জীবনবন্দনা কবিতা কৃষকদের কল্যাণে এবং তাদের উৎসাহিত করার মানসে সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থ ‘জীবন বন্দনা’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন, ‘গাহি তাহাদের গান, ধরণীর হাতে দিলো যারা আনি, ফসলের ফরমান। শ্রমকিনাঙ্ক কঠিন যাদের, নির্দয় মুঠি তলে, ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয়, ডালি ভরে ফুলে ফলে।’ এ কবিতার চরণ থেকে প্রতীয়মান হয় তাঁর মাঝে ছিল অগাধ কৃষি ভাবনা। সেইসাথে এ কবিতার মাধ্যমে তিনি কৃষক সমাজের সম্মান ও মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সাম্যের গান গেয়েছেন। একই সঙ্গে চেষ্টা করে গেছেন মানুষকে সংগঠিত করার।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা সবাই কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে জানি। কিন্তু সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে তাঁর পরিচয় অনেকেরই অজানা। কবি নজরুল শুধু যে সাংবাদিক ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন একজন উঁচু মানের সম্পাদক। ধূমকেতু ও লাঙল নামে দুটি পত্রিকার সম্পাদনায় তিনি সে স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এর আগে তিনি এ কে ফজলুল হকের নবযুগ পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ প্রবন্ধে নজরুল সম্পাদিত ধূমকেতু ও লাঙল নিয়ে আলোচনা করেন।
ধূমকেতু প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট। সেদিন ছিল বাংলা শ্রাবণ মাসের ২৬ তারিখ। কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে নিজ খরচে ধূমকেতু প্রকাশ করেন। শুরুতেই তিনি ঘোষণা দেন, সপ্তাহে দুবার ধূমকেতু বের হবে। ধূমকেতুর মোট ৩২ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ৫ মাস ১৪ দিনের মধ্যে এ সংখ্যাগুলো প্রকাশিত হয়। সপ্তাহে শুক্রবার ও মঙ্গলবার ধূমকেতু বেরুতো।
ধূমকেতু বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নজরুল আবারও পত্রিকা বের করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ধূমকেতু বন্ধ হয়ে যাবার প্রায় দু’ বছর পর ১৯২৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর নজরুলের পরিচালনায় বের হয়ে ‘লাঙল’ পত্রিকাটি। এ পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন শ্রী মণিভূষণ মুখোপাধ্যায় এবং প্রধান পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। পত্রিকায় প্রথম পাতায় একদিকে প্রধান পরিচালক হিসেবে নজরুল ইসলামের নাম, আরেক পাশে সম্পাদক হিসেবে শ্রী মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নাম প্রকাশ পেত।
নজরুলের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার ধারক, বাহক ও মুখপাত্র ছিল লাঙল। পত্রিকাটির লোগো ছিল লাঙল কাঁধে কৃষাণের ছবি। প্রথম দিকে এর স্লোগান ছিল শ্রমিক প্রজা স্বরাজ সম্প্রদায়ের মুখপত্র। পরবর্তীতে এর স্লোগান পরিবর্তিত হয়ে ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র’ হিসেবে গণ্য হয়। একই সঙ্গে লাঙলে’র লোগোও পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনের পেছনে একটি কারণ বোধহয় পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন। রেজিস্ট্রেশনভুক্ত হওয়ার আগের লোগো ও স্লোগানের সাথে রেজিস্ট্রেশন-পরবর্তী লোগো ও স্লোগানের পার্থক্য লক্ষ করা যায়।
ফেব্রুয়ারি ১৯২৬ সাল থেকে রেজিস্ট্রেশন নম্বরসহ লাঙল প্রকাশ হতে থাকে। প্রথম পাতায় ব্যানারের ওপর বাঁদিকে রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি লেখা থাকতো। লাঙল পত্রিকাটি নজরুল মূলত তাঁর দলের মুখপত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। এ পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কবিতা ও প্রবন্ধ এবং অন্যদের লেখা, প্রবন্ধ ও কবিতাগুলো ছিল মূলত সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার প্রতীক। প্রতিটি সংখ্যায় নজরুলের একটি কবিতা প্রকাশ পেতো। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশ পায় নজরুলের বিখ্যাত ‘সাম্যবাদী’ কবিতাটি। ২য় সংখ্যায় ‘কৃষাণের গান’ এবং তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সব্যসাচী’ কবিতাটি। আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘সর্ব্বহারা’ প্রকাশ পায় লাঙলের চতুর্দশ সংখ্যায়। এ সকল কবিতায় নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তাধারার প্রকাশ পেয়েছে।
প্রিয় কবি নজরুল ইসলামের মাঝে কৃষকের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা ছিল। কৃষক সমাজের কল্যাণে ও উন্নয়নে কৃষকের গান লিখে কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা অগ্রগামী করে কৃষক সমাজের কল্যাণে তাঁর লিখনী বিস্তৃত হয়েছে। কৃষকের গান শুনে কৃষকদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে প্রেরণা। নজরুলের এ সর্বজনীন ভাবনা নিঃসন্দেহে আধুনিক। বিশেষ করে পত্রিকার নাম ‘লাঙল’ দিয়ে চাষা, মজুর, কৃষকদের অবস্থান সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। লাঙল প্রতীকের মাধ্যমে নজরুল সর্বজনীন হয়ে উঠেছেন। কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কৃষকদের ‘জীবনবন্দনা’ লিখে নিঃসন্দেহে গণমানুষের কবি হয়ে উঠেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন