শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

মেহেদি রাঙা একুশ

মু হা ম্ম দ কা মা ল হো সে ন | প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)

অলক্ষ্যে দরজার ওপাশে চোখ মুছে পুত্রবধু রূপাও। মুহূর্তে এক আবেগঘন ভারি পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কান্না বিজড়িত কন্ঠে আঁখি বলে, ‘মাগো, তুমি কেঁদো না। ইনশাল­াহ, আমাদের তূর্য ভাইয়া বারবার ফিরে আসবে। বাংলা বর্ণমালার সাথে মিশে গেছে ভাইয়া। বাবাও নিশ্চয় খুব ভালো থাকবেন’ বোনের কথা শুনে মাথা নাড়ে অশ্রুত বাবু। বোনকে সমর্থন দেয়। কাঁপা গলায় বলে, ‘একটু শক্ত হও মা। নিজেকে আরেকটু সংযত কর। তোমার কিছু হলে আমরা বাঁচবো কী করে। কোথায় যাবো বলো?’ একরত্তি ছেলেমেয়েদের কথা শুনে অবাক হন মা। স্বাধীন দেশের ছেলেপুলেগুলো কতো দায়িত্ববান হয়ে গেছে। হঠাৎ করে কতো বড় হয়ে গেছে আঁখিবাবু সোনারা। ওল্টো মাকে সান্তনা দিতেও শিখে গেছে। ভাষা শহীদের রত্নগর্ভা মা হিসেবে ভাবতেই গর্ভে বুক ভরে ওঠছে। মুক্তিযোদ্ধা পিতার আদর্শ থেকে সন্তানগুলো তাহলে একটুও বিচ্যুত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কখনো মিথ্যে হতে পারেনা। এভাবে কেটে যায় আরো কিছুটা সময়। আবেগে সিক্ত হয় সকলে। হঠাৎ উচ্ছলা হয়ে ওঠে আঁখি। কথা বলে আরেকটু সহজ করতে চেষ্টা করে পরিবেশ। ‘মাগো, কান্নাকাটি অনেক হয়েছে। এবার একটু থামো। তোমাকে নাস্তা খাইয়ে দিচ্ছি। খাবারগুলো তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’ আঁখির কথা শুনে চেঁচিয়ে ওঠে বাবু, ‘নারে আঁখি তুই কেন খাওয়াবি? মাকে আমি খাওয়াব। তুই পারবি না। তুই ছোটো।’ ‘সরি ভাইয়া, অসম্ভব। মাকে আমিই খাওয়াব। বেশ পারবো।’ ‘না না, আমি খাওয়াব।’ ‘হতে পারেনা আমি খাওয়াব।’ ‘না না আমি...।’ ‘আমি..।’ ভারি গুমোট পরিবেশখানা মুহূর্তে হালকা হয়ে যায়। নিমেষে কেটে যায় দুঃখের বাতাবরণ। আঁখিজলের আড়ালে হাসির রেখা ফোটে ওঠে। লেগে যায় ভাইবোন। খুনসুঁটিতে মেতে ওঠে দু’জন। হেসে কুটিকুটি হয় মিসেস সৈয়দা সহিদা পারভিন চৌধুরী। দূরে মাইকে বেজে ওঠা গানের সঙ্গে সুর মেলায় আঁখি, ‘চেয়ে দেখ লাল সবুজের পতাকা যে উড়ে, ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ আমার হৃদয় জুড়ে।’ বোনের সঙ্গে সঙ্গে বাবুও গলা মিলায়, ‘চলো একুশের গান গাই,চলো একুশের গান গাই।’ পাগল ছেলেমেয়ে দুটো এমনি। এই মেঘ এই রোদ্দুরের মতো। হাসতে হাসতে লেগে যায়, আবার ভালো হয়ে যায়। চোখের সামনে এমন নিদারুণ স্বর্গীয় মিষ্টি দৃশ্য দেখে আপ্লুত হন মা। দাঁতে দাঁত চেপে কপট মৃদু রাগ দেখান। ‘অ্যাই, তোরা এবার থামবি! পাগল বানিয়ে ছাড়বি আমাকে!’ এরিফাঁকে নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে নেয় দু’ভাইবোন। হেসে গড়াগড়ি খায়। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মাগো তোমাকে তো আমরা সবসময় সু¯’ ও স্বাভাবিক দেখতে চাই। তুমি বেঁচে থাকলে আমরাও নিশ্চয় বেঁচে থাকবো, ভালো থাকবো।’ সময় ও পরিবর্তিত পরিস্থি’তি মানুষকে কতটা বদলে দেয়। বদলে দিয়েছে আঁখিবাবুকেও। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দেখেনি, ভাইকে হারাতে না দেখলেও খুব কাছ থেকে দেখেছে প্রিয় বাবাকে হারাতে। প্রিয়জন হারানোর কী ব্যথা বুঝতে পারে। এই শোক কখনো ভুলে যাওয়ার মতো নয়। বুঝতে পারে এখন বৃদ্ধা মায়ের মনের ওপর দিয়ে কী ঝড় বহে যাচ্ছে। তারা নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ করে নেয়। মাথার ওপর ছায়াদানকারী নির্ভরতার প্রতীক বাবাকে হারিয়েছে, কি?‘ অতসহজে মাকে হারাতে দেয়া যায়না। কোনো অবস্থাতেই মন খারাপ করতে দেয়া যাবেনা। সবসময় মাকে আনন্দমুখর পরিবেশে হাসিখুশি’র মধ্যে রাখতে হবে। এবারের অমর একুশে ভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে হাতেহাত রেখে দৃপ্ত শপথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় দু’ভাইবোন। পূব আকাশের রক্তিম সূর্যটার মতো ছোট্ট নুহা’র মেহেদি রাঙা একুশের সূর্যটাও সবার অলক্ষ্যে আনন্দে হেসে ওঠে।
(সমাপ্ত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন