গত ১৯ মার্চ সকালে রাজধানীর প্রগতি সরণিতে বাসচাপায় প্রাণ হারাল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) মেধাবী শির্ক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী। ২০ মার্চের সকল জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় খবরটি শিরোনাম হয়ে আসে। এছাড়া বিভিন্ন পত্রিকায় এই মর্মান্তিক ঘটনাসহ সড়কে নৈরাজ্যের কথাও উঠে আসে। এর আগে খুদে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশ কাঁপানো আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। রাজধানীর শহীদ রমিজদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে বাসচাপা দেওয়ার ঘটনায় টানা ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠলে তাদের দাবি মানার আশ্বাস দেয় সরকার। কিন্তু যে প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়ে ছিল তার বাস্তবায়ন কতটুকু হলো? এ ক্ষেত্রে শুধু উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো, ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ জাতীয় সংসদে অনুমোদন হয়েছে। বাকি দাবি একটাও মানা হয়নি। অতীতের ঘটনার আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা না নিতে পারায় আবার আবরার নামে এক ছাত্র সড়ক র্দুঘটনায় মৃত্যু মুখে পতিত হলো। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় আবরারের মৃত্যু বেপরোয়া চালকদের সাবধান করতে পারে। এ দিকে শিক্ষার্থীদের চলা আন্দোলনের মধ্যে গত ২১ মার্চ গাইবান্ধা ও যশোরে যন্ত্রদানবের চাকায় পিষ্ট হয়েছে তিন স্কুল ছাত্রী। সড়ক আন্দোলনের পর থেকে গত আট মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে। ১৯ মার্চ আবারার নিহত হওয়ার পর ছাত্ররা যে ১২ দফা দাবি দিয়েছে তা অত্যন্ত যৌক্তিক। এগুলো হলো: পরিবহন খাতকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করতে হবে। বাস চালকদের লাইসেন্সের কাগজ চেক করতে হবে। দুর্ঘটনায় আটক চালককে দ্রæত সময়ের মধ্যে সবোর্চ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্সবিহীন চালককে দ্রæত সময়ে অপসারণ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সব স্থানে আন্ডার পাস, স্পিড বেকার এবং ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। চলমান আইনের পরিবর্তন করে সড়কে হত্যার সাথে জড়িত সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দায়িত্ব অবহেলাকারী প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশকে স্থায়ী অপসারণ করে প্রয়োজনীয় আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে বাস স্টপেজ এবং যাত্রী ছাইনি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং ছাত্রদের হাফপাস (অর্ধেক ভাড়া) অথবা আলাদা বাস সার্ভিস চালু করতে হবে ।
আমাদের দেশে আইন আছে। আইনের প্রয়োগ নেই। দেশে প্রায়ই কোথাও না কোথাও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ২০ মার্চ আরও ১১ জনের মৃত্যু, ২১ মার্চ পরদিনের খবর দুই শিক্ষার্থীসহ ১৮ জনের মৃত্যু। সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে অনেকে ধারনা করেছিল শিক্ষার্থীদের দেশ কাঁপানো আন্দোলনের পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে বা দীর্ঘদিনের জনদাবি, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সব রকম ব্যবস্থা দ্রæত নেওয়া হবে। কিন্তু তার বিন্দু মাত্র বাস্তবায়িত হয়নি। ২০ মার্চ একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, বাসের পাল্লাপাল্লি প্রতিযোগিতায় রাজধানীর প্রগতি সরণিতে কলেজ ছাত্রের অকাল মৃত্যু। এ ঘটনার পর ছাত্ররা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। এর পর সাতদিনের আলটিমেটাম দিয়ে ১১ দফা দাবি পূরণের দাবির আশ্বাস পেয়ে বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা ২০ মার্চ তাদের বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করে । প্রশ্ন হলো, দায়িত্বশীলরা গত আট মাসে দাবি পূরণে আশ্বাস দিয়েও বাস্তবায়ন করতে পারেননি। সাত দিনে তারা কী করে সক্ষম হবে?
জানা যায়, সারাদেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে ৫ লাখ ১১ হাজার ৩৪৮টি। এসব গাড়ির ৪১ শতাংশ রাজধানী ঢাকায় চলাচল করে। বিআরটিএ জানাচ্ছে, গত বছর সারাদেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ছিল ৩ লাখ অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। সংস্থাটির মতে, ৫০ শতাংশ গাড়ি চালায় লাইসেন্সবিহীন অবস্থায়। এর ৩০ শতাংশ ঢাকায় চলছে। ফলে র্দুঘটনা বাড়ছে, বাড়ছে প্রাণহানি। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ৬৬৬টি দুর্ঘটনায় ৬৯৯ জন নিহত হয়েছে এবং এক হাজার ২২৭ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে বাসের কারণে ঘটা ৩৫৪টি দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বাসের ফিটনেস ছিল না।
বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের (এআরসি) গবেষণা অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রতিবছর ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এবং আহত হয় ৩৫ হাজার। অন্যদিকে বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মৃত্যুর হার ৮৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়াও আহত ও স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণের হারও কম নয়। এ সমস্যা একটি সামাজিক ট্র্রাজেডিতে পরিণত হয়েছে। মানুষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হয়, যানবাহনে চড়তে হয়। কিন্তু লাশ হওয়ার ভয়ে যদি শঙ্কিত হতে হয়, তাহলে সেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি হতে পারে না, মৃত্যু একদিন হবে তবে এভাবে কেন? সড়ক দুর্ঘটনা শুধু সামাজিক সমস্যা নয়, এর পিছনের রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় রয়েছে। উপরন্ত বিচারহীন, প্রতিকারহীন ঘটনা ঘটতে থাকলে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নেবে এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য দুর্ঘটনার পর ড্রাইভার পালিয়ে যায়। অনেক ড্রাইভারের নিজের প্রাণ চলে যায়। আবার সড়ক দুর্ঘটনা আইন দুর্বল হওয়ায় অনেকে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায় ।
সরকারি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিগত তিন বছরে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫০০০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি হিসেবে প্রদান ভিত্তি হলো পুলিশের রিপোর্ট, যেখানে অনেক দুর্ঘটনার রিপোর্ট উঠে আসে না। তাদের মতে, সরকারি হিসেবের দুই তিন গুণ করলে সঠিক সংখ্যাটা পাওয়া যাবে। মোট কথা হলো, লাইসেন্স তৈরি করার সময় দুর্নীতি দূর করা না গেলে পরিবহন সেক্টরে শৃংখলা ফিরবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পরিবহন চালকের মানসিকতার পরিবর্তন করা প্রয়োজন। অর্থ্যাৎ যথোযুক্ত মটিভেশন এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের মানসিক উন্নতি ঘটানো না গেলে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। পুলিশের মানসিকতার পরিবর্তন করাও প্রয়োজন। ট্রাফিক আইন বাস্ততবায়নে পুলিশের ও স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে গেলে চলবে না। বিষয়টি পরিবহন খাতে নৈরাজ্যের বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। এ বিষয়টি হল, পরিবহন খাতের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সুবিদাভোগী ব্যক্তিদের কব্জায়। প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে এদের বেগ পেতে হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা সুদৃঢ় না হলে এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। মনে রাখতে হবে, নিরাপদ সড়কের আন্দোলন সরকার বিরোধী আন্দোলন নয়। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন