আব্দুল্লাহ আল ফারুক তমালের ফেসবুক পেইজের ছবিগুলো এখনো জ্বলজ্বল করছে। দৃষ্টি আকর্ষণ করছে অনেকের। মা জান্নাতুল ফেরদৌসীর সাথে রয়েছে যৌথ ছবি। সাগর সৈকতে দুই সন্তান ও স্ত্রীর সাথে হাস্যেজ্জল ছবি। এখন শুধুই স্মৃতি।
বনানীর এফ আর টাওয়ারে তমাল কাজ করতেন ইইউআর সার্ভিস বিডি লিমিটেডের সেলস্ ম্যানেজার হিসেবে। বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর গুপ্টি ইউনিয়নের শ্রীকালিয়া গ্রামে। ঢাকায় স্ত্রী সানজীদা অভি ও দুই সন্তানকে নিয়ে তমালের সুখের সংসার। একমাত্র সপ্তাহিক ও সরকারি বন্ধের দিন ছাড়া অফিস থেকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতেন।
এফ আর টাওয়ারের ভয়াবহ আগুন সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। নিহত সবার মতো তমালেরও সবকিছু ছাই হয়ে গেছে। তমালের মা জান্নাতুল ফেরদৌস যতক্ষণ জেগে থাকেন ততক্ষণ চোখের পানি ফেলেন। চোখের পানির যেন শেষ নেই। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ঘড়ির কাঁটার সাথে ছেলেটার জীবন চলছিল। অফিস আর কাজ এ নিয়েই তার সময় বয়ে যেত। ঘড়ির কাঁটা ও তমালের জীবনের মধ্যে ছেদ পড়েছে। ঘড়ির কাঁটা তো ঠিকই সচল আছে। কিন্তু থেমে গেছে আমার তমালের জীবন। তমালের বাবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মকবুল আহমেদ বুক চাপড়ে আর্তনাদ করেন। এখনো বিলাপ করে বড় ছেলের নাম ধরে বলেন, ‘আব্দুল্লাহ তুমি একি করলা। এত বড় কষ্ট আমি হজম করব কীভাবে? আমার দুই নাতি-নাতনির কী হবে? ভবনে আগুন লাগার পর আমার তমাল বাঁচার জন্য আড়াই ঘণ্টা লড়াই করেছে। জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে। সরকার কি তমালকে বের করতে পারত না?’ বাবার এই প্রশ্ন সবাই শুনতে পারে। কিন্তু জবাব দেয়ার মতো কেউ নেই। আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টা পর তমালকেও উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তমালকে মৃত ঘোষণা করেন।
মার্চের ২৮ তারিখ দুপুরের দিকে আগুন লাগার পর তমাল আর অফিস থেকে বাইরে বের হতে পারেননি। নিশ্চিত মৃত্যু এগিয়ে আসছে। আর এমন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দ্রæত মোবাইল ফোনে পরিবারের অনেকের সাথে কথা বলেন তমাল। তিনি সবাইকে বলেছিলেন, ‘ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চারদিকে আগুন ও কালো ধোঁয়া হলেও এখন পর্যন্ত সেফ জোনে আছি। কিন্তু সেফ জোনটা জীবনে নতুন করে ফেরা নাকি আজীবনের জন্যে ঘুমিয়ে যাওয়া বুঝতে পারছি না।’
বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন তুহিন এসব কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি ফোনে তমালকে এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রæত ভবনের ছাদে উঠে যেতে বলেন। তমাল ওই অবস্থায় মেসেঞ্জারে জবাব দেন, ‘ভাইয়া নো স্কোপ। আমায় ক্ষমা করে দিও।’ শেষ পর্যন্ত অগুনের কাছে তমাল হেরে যান। সবার বিশ^াস ছিল তমাল বেঁচে ফিরবেন। কিন্তু সেই বিশ^াসকে মিথ্যে প্রমাণ করেছে দাউ দাউ করে জ¦লা আগুনের লেলিহান শিখা।
তমাল ও সানজীদা অভি দম্পতির দুই সন্তান পাঁচ বছরের মেয়ে সোহাইলী তেহরীন মানহা এবং দেড় বছরের ছেলে আব্দুল্লাহ আল আইমান। সানজীদা বলেন, প্রতিদিন তমাল বাসা থেকে মেয়ে মানহাকে নিয়ে বের হতো। মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে সে অফিসে যেত। স্কুুল ছুটির সময় হলেই মোবইল ফোনে কয়েকবার রিং করত তমাল। স্কুলে গিয়েছ কিনা? মানহাকে নিয়ে বাসায় গিয়ে ফোনে জানাবে। তোমার ফোন না পেলে চিন্তার মধ্যে থাকবো।
সানজীদা আরও জানান, ২৮ মার্চ মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গেছি কিনা সে কথা জানার জন্য তমালের ফোন আসেনি। মেয়ের স্কুল ছুটির পরও ফোন না আসায় অবাক হয়ে যাই। দুপুর ১টার দিকে তমাল ফোন দিয়ে বলে, ‘অভি আমাদের ভবনে আগুন লেগেছে। আমার জন্য দোয়া করো। মানহা ও আব্দুল্লাহ আল আইমানের দিকে খেয়াল রেখো। আমায় ক্ষমা করে দিও।’ সেই যে দুপুরের দিকে তমালের মোবাইল ফোন বন্ধ হলো, আর খোলেনি। জীবনের শেষ কথা স্ত্রী অভিকে বলার পরই সেফ জোন পরিণত হয় মৃত্যুকূপে।
সানজীদা অভি এখন নির্বাক। সান্তনা দেয়ার ভাষাও কারো জানা নেই। মানহা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে বাবাকে খুঁজে। এখন তাকে কে স্কুলে নেবে। তার অপেক্ষা যেনো কাটছেই না। বাবা আর কখনো তাকে আদর করবে না। একথা মানহাকে কিভাবে বুঝাবেন স্বজনরা। উল্লেখ্য, ঘটনার দিনই অফিস থেকে বাসায় ফিরে সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা আগেই করেছিলেন তমাল। তার সেই কল্পনা আর কখনো বাস্তব হয়ে ধরা দেবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন