আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। সব চাওয়া-পাওয়া, আশা-নিরাশা পেছনে ফেলে ১৪২৫ সাল কালের স্রোত লীন। ১৪২৬ সালের শুভাগমনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রভাতের সূচনা হলো। এখন অনেকে বাংলা বর্ষবরণের সঙ্গে পৌত্তলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্পর্ক আবিষ্কার ও তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালালেও বাংলা সন ও নববর্ষ উদযাপন মূলত মুসলিম ঐতিহ্যজাত এবং মুসলিম শাসকরাই তা প্রবর্তন করেন। বাংলা সনের সঙ্গে বাংলার শাসনব্যবস্থার সংস্কারে মুসলমান শাসকদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দিল্লী সালতানাতের সময়ে হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হলেও কৃষিভিত্তিক সমাজ বাস্তবতায় হিজরি বর্ষপঞ্জি ও কর আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু অসামঞ্জস্য দেখা দেয়ায় একটি নতুন সনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবর হিজরি সনের ভিত্তিতে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের নির্দেশ দেন। মুঘল রাজদরবারের দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ্উল্লাহ সিরাজী হিজরি সন ও সৌর সনের সমন্বয় করে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। ব্রিটিশ আমলে খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি আমাদের সমাজে বাংলা সন ও বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রচলন ও প্রভাব অক্ষুন্ন ছিল। মুঘল আমলে প্রবর্তিত বাংলা বর্ষপঞ্জিতেও কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা বর্ষপঞ্জিতে কিছু সংস্কার আনেন। তার সংস্কার অনুসারে এখন প্রতিবছর ১৪ এপ্রিলে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের উৎসব হয়ে থাকে। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং হাজার বছরের রাজনৈতিক বিবর্তনে আমাদের সংস্কৃতিতে যে বৈচিত্র এসেছে সেখানে সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলা, হিজরি এবং গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় সমভাবে গুরুত্ব বহন করছে। আমাদের ভাষার ঐতিহ্য ও ইতিহাস যেমন স্বকীয় অনুপ্রেরণায় দীপ্যমান, তেমনি আমাদের রয়েছে একটি নিজস্ব ক্যালেন্ডার, যা জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধ ও গর্বিত করেছে। এ কারণে আমাদের জাতীয় জীবনে বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এখনো আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। আমাদের ঋতুবৈচিত্র, খাদ্যসংস্থান ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রভাব স্বমহিমায় বিদ্যমান রয়েছে এবং থাকবে। বিশ্বায়নের যুগে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি ক্রমে বৈদেশিক বাণিজ্যনির্ভর হয়ে উঠলেও পহেলা বৈশাখের উৎসবমুখর আবাহন বাড়তি জৌলুস সৃষ্টি করেছে।
বাংলা নববর্ষ পালন এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে গ্রামীণ জনপদে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতা এবং কৃষকের ঘরে নতুন ফসল উঠার এ সময়ে নববর্ষ উদযাপনে বৈশাখী মেলা হয়ে উঠত সব বয়েসী মানুষের আনন্দ-উৎসব ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নতুন উপলক্ষ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ আবাহনে যেসব অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে তা নিয়ে সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মুখে উল্কি আঁকা, বিভিন্ন জীবজন্তু বিশেষ করে হুতুম পেঁচা, হাতি, কুমির, সাপ, বিচ্ছু ও ঘোড়ার মুখোশ পরা, প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষদের একসঙ্গে অশালীন পোশাক পরে শোভাযাত্রা করা, শোভাযাত্রায় বাদ্য-বাজনার সঙ্গে আপত্তিজনক ভঙ্গিমায় নৃত্য করা ইত্যাদি বিশেষ কোনো স¤প্রদায় বা গোষ্ঠির আচরিত সংস্কৃতি হতে পারে, তবে এদেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের জন্য এসব সংস্কৃতি নয়। এগুলো তাদের আচরিত সংস্কৃতির পরিপন্থী ও খেলাপ। তাদের জন্য এসব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ সার্বজনীন সংস্কৃতির নামে এসব অনৈসলামিক আচারকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। বুঝে হোক, না বুঝে হোক সরকারিভাবে এর পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। সার্বজনীন সংস্কৃতি বলে বিশ্বে কিছু নেই। একেক দেশের একেক জনগোষ্ঠীর ও সমাজের সংস্কৃতি আলাদা। এ কারণেই বিশ্বজুড়ে সংস্কৃতিক বৈচিত্র আমরা লক্ষ্য করি। সংস্কৃতি গঠন ও নির্মাণে ধর্মের ভূমিকা প্রধান। ধর্মের যেহেতু বিভিন্নতা আছে, সুতরাং সাংস্কৃতিক বিভিন্নতাও থাকবে। পৌত্তলিক সংস্কৃতি পৌত্তলিকতার অনুসারীদের সংস্কৃতি হতে পারে, বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মুসলমানের সংস্কৃতি হতে পারে না। এর প্রচলন ও চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি তাই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলা হচ্ছে। অথচ কয়েক দশক আগে এদেশে তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে বিজাতীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া আসলে এদেশের মানুষের হাজার বছরে গড়ে ওঠা নিজস্ব সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়ন্ত্রের নামান্তর। এ ব্যাপারে এখনই আমাদের সচেতন ও সাবধান হতে হবে। ধর্মের সঙ্গে বর্ষবরণের কোনো সম্পর্ক নেই, এ ধরনের কথা সত্যের অপলাপ মাত্র। বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে অবশ্যই ইসলাম ধর্মের অবিভাজ্য ও গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।
স্বাধীন দেশের নাগরিকেরা তাদের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নিজেদের বর্ষবরণের উৎসব পালন করবে, এটাই প্রত্যাশিত। একই বাংলাভাষা এবং একই বাংলা পঞ্জিকার দাবিদার হওয়া সত্তে¡ও রাজনৈতিক মানচিত্রের বিভাজনের কারণে ইতোমধ্যেই ভাষা এবং ক্যালেন্ডার অনুসরণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে। বাংলা বর্ষবরণ একই দিনে হয় না। দেশ ভাগ হয়েছে, সংস্কৃতি ভাগ হয়নি, এ কথা অচল। যখন এক দেশ ছিল, তখনও আজকের বাংলাদেশের সংস্কৃতি ভারতের অন্যান্য অংশের সংস্কৃতি থেকে পৃথক ছিল। একে কোনোভাবেই আর এক করা যাবে না-একথা অবশ্যই আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। আমাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের স্বার্থেই বহিরাগত ও অপসংস্কৃতির স্থলে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছি। দেশে অনেক উন্নয়নের কাজ হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পাশাপাশি মানুষের নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ও চলছে। মাদক, যৌন হয়রানি, পারিবারিক কলহে খুন-জখম, হত্যা, ধর্ষণ, নৃশংসতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের মূলে রয়েছে, আমাদের নিজস্ব হাজার বছরের নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করা এবং এ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়া, অপসংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া। বলা বাহুল্য, আমরা যতই উন্নয়ন করি না কেন, যদি নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় চলতে থাকে, তবে তা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। কারণ, উন্নয়ন মানুষের জন্য। মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিলে সমাজ, পরিবার সর্বোপরি দেশে অরাজকতা দেখা দেয়া স্বাভাবিক। তাই উন্নয়নকে টেকসই ও সুষম করে তুলতে মানুষের মধ্যকার নীতি-নৈতিকতা এবং জ্ঞান চর্চার তাকিদ সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও সমাজের অভিভাবক শ্রেণীসহ সচেতন মহলকে আরও সচেতন হতে হবে। এবারের নববর্ষ দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ ও সাফল্য বয়ে আনুক, আমরা তা প্রত্যাশা করি। বাংলা নববর্ষে আমাদের পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতা ও দেশবাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন