শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাংলা নববর্ষ সংখ্যা

ফাহিম ফিরোজের ভাতঘুম স্বকীয় ঢংয়ে উজ্জ্বল

মুসাফির নজরুল | প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৮ এএম

নব্বই দশকের অন্যতম প্রধান কবি ফাহিম ফিরোজের অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ ‘ভাতঘুম’। এ কাব্যগ্রন্থে ফাহিম ফিরোজের কবি মানস ধরিত্রীর বাস্তবতা ছাড়িয়ে ‘মিস্টিসিজমে’র জগতে ধাবমান। ইহলৌকিক জগতের অনেক কিছুই তার হৃদয়কে করেছে ক্ষত-বিক্ষত। তিনি কিঞ্চিত শ্রান্তির অন্বেষণে রাষ্ট্র-রাষ্ট্রান্তরে বেড়িয়েছেন। অতীত তার মানসপটে দানা বেঁধে উঠেছে। স্বর্ণচূড়ার গহিনে তিনি অবগাহন করেছেন প্রিয়ার সঙ্গে। এ কাব্যে তার উপলব্ধি চিরন্তন কাব্যসত্যের গাঁথামালায় উজ্জীবিত।
অনেক সাহিত্য সমালোচক নব্বই দশককে কবিতায় ‘উত্তর আধুনিক’ যুগ বলে অভিহিত করে থাকেন। ত্রিশোত্তর বাংলা সাহিত্যে আমরা ইউরোপীয় ভাবধারায় সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করি। কী কবিতা, কী কথাসাহিত্যে এ ধারা যথেচ্ছরূপে বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। ঠিক বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এসে একদল কবি-সাহিত্যিক এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যে উজ্জীবিত হয়ে তাদের সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হয়েছেন। আর এ সময়ে এ ধারায় যে কয়েকজন তরুণ প্রতিভা সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান সংযুক্ত করেন, কবি ফাহিম ফিরোজ তাদের মধ্যে অন্যতম। তার সৃষ্টিশীলতার দুর্নিবার প্রাণাবেগ, সৃজনে অফুরন্ত সম্ভার, কবিতায় শৈল্পিক সৌকর্যময়তা পরিদৃষ্ট। কবি সাদা-মাটা অভিব্যক্তি গভীর অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছেন এবং তা তিনি প্রকাশ করেছেন অত্যন্ত সাবলীল ভাষায়। তার কবিতা নবতর বীক্ষণে উদ্দীপ্ত :
হরিকেল-বরেন্দ্র-গহণ বন কালো
ভেঙে পড়েছিল পিছনের বক্র চন্দ্রের উপর
চাইরদিক ছিল স্থির নেত্রদ্বয়
এনে হয় মহিপালের কালাদ্র দীঘি
চোখ ফেলে, তাকিয়েছিল, রঙ যত গগন পানে। (ধানকন্যা)
ফাহিম ফিরোজ তার ‘ভাতঘুমের বিভিন্ন কবিতায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। সমাজ-রাষ্ট্রে প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান উঠে এসেছে তার কবিতায়। আর তা উঠে এসেছে এ কাব্য অন্তর্ভূক্ত ‘গনি মিয়ার গল্প’, ‘শাহরিক খালুজান’, ‘ভায়রা পুতের অনুরোধ’, ‘তালুই সাবের দিনচিত্র’, ‘মিস্টার পুঁজিবাদ’, ‘বাপ কপাইলা মেয়ে’ ইত্যাদি কবিতায়। এ প্রসঙ্গে কবির অভিব্যক্তি স্মরণীয় :
মেয়ে আমার বাপ কপাইলা। বড়টা বাড়ি আসলে
বাপের দশহাত হঠাৎ জোছনায় ডুইবা যায় আন্ধার দিনে।
নদী রুইয়ের শাদা অংশের মধ্যে রাজসিক ব্যঞ্জনার ছবি। (বাপ কপাইলা মেয়ে)
কবিতায় বাপের দশ হাত হঠাৎ জোছনায় ডুবে যায় আন্ধার দিনে-এক সাধারণ চিত্রকল্প।কবি জীবনানন্দ দাশের ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি’ কিংবা সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ কিংবা আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ঘাসের নিচে আমার আত্মহত্যার প্লান’ প্রভৃতি পঙক্তিসমূহের মধ্যে পরাবাস্তববাদের যেমন অকৃত্রিম প্রকাশ লক্ষ করা যায় তেমনি ফাহিম ফিরোজের ‘বাপের দশ হাত হঠাৎ জোছনায় ডুইবা যায় আন্ধার দিনে’ পঙক্তিতে চিরভাস্বর হয়ে উঠেছে। কবি এখানে ‘সুপার ন্যাচারিয়েলিজমে’র চৌহদ্দি পেরিয়ে এক অনন্ত কল্পনায় মথিত হয়েছে। কবির চেতনায় আন্ধার দিনের বেলায় হঠাৎ জোছনায় পিতার দশ হাত কল্পিত হয়েছে। এখানে তার কবিত্ব শক্তির পরিচয় পরিদৃষ্ট হয়েছে অকল্পনীয়ভাবে।
ফাহিম ফিরোজের ভাতঘুমের বিভিন্ন কবিতায় সমকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। ‘ঐক্যের জেয়াফত পর্ব’, ‘তালুইসাবের দিনচিত্র’, ‘মাওই’র চিন্তা’, ‘কলকি সংসদ’, ‘আছিয়ার দুঃখ কথন’, ‘গণবিয়ার প্রস্তাব’, ‘কালো মেয়েদের দুঃখগুলো গতি করে দিই’ প্রভৃতি কবিতায় সমকালীন বাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠেছে। যেমন :
মাটি থেকে গ্রাম উপরের দিকে ওঠে, হাওয়ায় ভাসে আনন্দে
গণারণ্যে হৈ-চৈ মেছো হাট থেকে স্বরমালা যেন এখানে
পেয়েছে ঠাঁই। কিছু না, কিচ্ছু না আজ গোপাইল্লার বিয়ে
বংশের পরথম ছাওয়াল..বাজে ঢোল, ড্রাম সেট;
নাচে হাওয়ার পরীরা। (ঐক্যের জেয়াফত পর্ব)
‘ভাতঘুমে’র সবচেয়ে দীর্ঘ কবিতা ‘উত্তর আধুনিক জনক’ একটি কালিক ইতিহাসনির্ভর কবিতা। এ কবিতায় কবি এদেশীয় জাতি-গোষ্ঠীর সুদীর্ঘকালের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, বর্ণ ছাড়াও বিলুপ্ত জনপদের সার্বিক প্রেক্ষাপট লিপিবদ্ধ করেছেন। কবির ভাষায় :
...আমি কি দেইনি মুছে বল্লালের রাজটিকা?
ডোম নারী ছৈল ধরে কৌলিন্যের সে সময়
আছিলাম ল²ণের সংসদে, আছিলাম,
অতসিনী বল্লভার চোখের ভেতর-
সেই দিন, প্রজাপথে কি কান্ড করেছি আমি।
ছিলাম না কোন খানে, ছিলাম না, সেদিন কোথাও?
ইলিয়াস-ফিরোজের ঘোর সংঘাতের সময়।
তোদের দুর্দিনে হাজার হাজার-এক লাখ
আবু বাঙালির কাটা মাথা আমি কুড়িয়েছি।” (উত্তর আধুনিক জনক)
বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে এত দীর্ঘ ইতিহাসকে একসঙ্গে ধারণ করে ইতঃপূর্বে কোনো কবিতা লেখা হয়েছে কি না সন্দেহ। এ কবিতার মাধ্যমে কবির ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রীতির স্বরূপ পরিলক্ষিত হয়।
এ কাব্যে কবি শাহরিক ভাষার সহাবস্থানে গ্রাম্য কথ্য ভাষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। গ্রাম্য জনপদের বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনাবলি অতি সতর্কতার সঙ্গে কবিতায় রূপান্তর করেছেন তিনি। যেমন ‘বেয়াইন বিষয়ক ছাপচিত্র’, ‘গরু দৌড়’, ‘জামাই বাজার’ ইত্যাদি কবিতায় গ্রাম্য পরিবেশে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনকার ঘটনাবলির বর্ণনা রয়েছে।
কবি ফাহিম ফিরোজ তার এ কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় ইতিহাস-ঐতিহ্যের পাশাপাশি সাহিত্যের ইতিহাসকেও তুলে ধরেছেন সমানভাবে। কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে ফুটে উঠেছে মধ্যযুগীয় কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসার ছাপচিত্র :
....আমিও দেখেছি
সল্তের আলোয় ভগ্নিরা গাইতেছে কৃত্তিবাস
চামর-মন্দিরা। জ্যোৎস্না উঠোন জুড়ে
চন্ডীদাস-আলাওল ফুলছে সবার জিহ্বায়
তবে চন্দ্রাবতী-হাকিম টানতো খুব মোর। (উত্তর আধুনিক জনক)
এ অংশে কবির তন্ময় উপলব্ধিতে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের পুরোধা দুই কবির স্মৃতিচারণ উচ্চারিত হয়েছে। একদিকে মঙ্গলকাব্যের ধারার অন্যতম শীর্ষ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচয়িতা কবি বড়–চন্ডীদাস এবং অপর দিকে রোসাঙ্গ রাজসভার ও কবি রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের ধারার ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের রচয়িতা আলাওলের কবিভাবনার চিত্র ফুটে উঠেছে। তার চেতনায় ভেসে এসেছে সুদীর্ঘকালের প্রাচীন কবি ও তাদের সৃষ্টিকর্ম। আবার কখনো ফিরে এসেছেন ইতিহাস নির্ভর শাসন ব্যবস্থায়।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের ¤েøচ্ছদের জীবন-চারণ থেকে শুরু করে তিনি একে এক পাল, সেন, মুঘল প্রভৃতি শাসনামলের সামাজিক-অর্থনৈতিক পটভূমি তুলে ধরেছেন। অতঃপর ১৭৫৭ সালে পলাশী প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলা পতনের প্রায় দুইশ’ বছর যাবত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নিষ্পেষিত এদেশীয় বীরদের বীরত্বগাথার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া বিজয়ের স্বাধীনতার কর এভাবে :
....আমিও কম নারে
বানালাম তীতুমীর, মজনু শাহ এবং ক্ষুদি
তারপর সাতান্ন বিদ্রোহ, বনে-রণে ঘুরে
সাতচল্লিশ ও একাত্তরে পেলি সেই ধন।” (উত্তর আধুনিক জনক)
বলো না গীতার না- নুরার খালু
সেই মহাজনক সিংহের মুখ থেকে,
মুজিব দিছিল এন তোদের কুসকুস
রঙ যার সবুজ, শিশির দর্পণে আলোকিত
খেলি তাকেও বেক্কল! শুদ্ধ ছিলি কবে?
কবির মানসপটে উপলব্ধি হয়েছে তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা, ফকির মজনু শাহ’র বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, সাতচল্লিশের দেশ-বিভাগ, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান- এভাবে এক সময় একাত্তরের স্বাধীনতা লাভসহ বঙ্গবন্ধুর চির অমর অবদান স্বাধীনতা অর্জন, সকল রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রতিচ্ছবি।
‘ভাতঘুম’ কাব্যে কবি দুর্বোধ্যতা এড়িয়ে সহজ-সরল ও সাবলীল ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন। কবিতার বিষয়বস্তু নির্বাচনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি সামাজিক জীবনচিত্রে প্রতিফলিত দৈনন্দিন বিষয়াবলির সমন্বয়ে রসাত্মক শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন ‘জামাই বাজার’, ‘ল্যাংড়ার আবার জুতা পিন্ধার শখ’, ‘গণবিয়ার প্রস্তাব’, ‘কালো মেয়েদের দুঃখগুলো গতি করে দিই’-ইত্যাদি কবিতায় সমাজের একেবারে বাস্তব জীবনাচার প্রতিফলিত হয়েছে।
তবে ফাহিম ফিরোজের অনেক কবিতার নামকরণের দিকে তাকালে এর ভাষাভঙ্গি অতি হালকা ভাষাভঙ্গি বা বিষয়বস্তু মনে হলেও কবিতার অন্তর্দৃষ্টি অনেক গভীর। আর এ গভীর অন্তর্দৃষ্টি যদি আগামীতেও তার কবিতায় চলমান থাকে তাহলে তার পক্ষে জ্ঞানসমুদ্রের আরো গভীরে সিঞ্চন করে মণিমুক্তা আহরণ সম্ভব। তিনি তার এ কাব্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বুড়িগঙ্গা, শীতল²্যা বিধৌত অঞ্চলের পাললিক কথ্য ভাষার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে বিভিন্ন চরিত্র সৃষ্টি করে গীতিনাট্যিক ঢঙে কথোপকথনের মাধ্যমে কবিতা রচনা করে স্বাতন্ত্র্যতার পরিচয় দিয়েছেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, কবি ফাহিম ফিরোজ একটি বিশেষ কালিক চেতনাকে ধারণ করে যেভাবে নিজস্ব ঢংয়ে স্বকীয় মুন্সিয়ানায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি তার অসাধারণ ‘উত্তর আধুনিক জনক আমার’ কবিতার ন্যায় ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ কবিতা বাংলা কাব্য সাহিত্যে আরো সংযোজন করলে বাংলা কবিতার পরিধি আরো বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হবে। তার এ ক্রমসৃজনীকর্ম বহু বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রবাহে বাংলা কাব্য সাহিত্যকে প্রসারিত করবে।

প্রাবন্ধিক: সহকারী অধ্যাপক বাংলা, পিএইচডি গবেষক (ঢা.বি.)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
সাহিত্য প্রেমি ৮ নভেম্বর, ২০২২, ১:১৮ এএম says : 0
আপনি তো মশাই বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কিন্তু পাগল নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে ইচ্ছে জাগলো কেন?
Total Reply(0)
সাহিত্য প্রেমি ৮ নভেম্বর, ২০২২, ১:১৮ এএম says : 0
আপনি তো মশাই বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কিন্তু পাগল নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে ইচ্ছে জাগলো কেন?
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন