মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাংলা নববর্ষ সংখ্যা

বাংলার লোকসংস্কৃতি

মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৮ এএম

একটি পলল বদ্বীপে গড়ে ওঠা আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ মূলতই একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার পলিমাটিতে ব্যাপক ফসল ফলার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা এসে এ এলাকায় তাদের বসতি স্থাপন করেছে। মানুষের প্রধান মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই হলো খাদ্য। আর এ খাদ্যের সংস্থান করতে গিয়েই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এ পললভূমিতে এসে বসতি স্থাপন করার কারণে এটি প্রাচীনকাল থেকেই একটি জনবহুল দেশ। নানা দেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে এখানে যারাই এসেছে, এখানকার উদারদিল লোকেরা তাদের আশ্রয় দিয়েছে, আপন করে নিয়েছে। এভাবে গোড়া থেকেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে বহুত্ববাদের ধারায় গড়ে উঠেছে এ দেশ।
এখানে নানা ধারায় প্রাচীন জনবসতির গড়ে ওঠায় এখানকার সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেছে এক মিশ্র ধারায়। প্রাচীনকালে বাইরে থেকে যারা এদেশে এসেছে তাদের মধ্যে- আর্য, শক, হুন, কোচ, মেচ, সেন, আরবীয়, ইরানি, তুর্কী, আফগান, মোগল, পাঠান আফ্রিকান, ইউরোপীয়, উলন্দাজ, ইংরেজ, বিহারি, পাকিস্তানি, আরাকানি ইত্যাদি নানা স্রোত- এর সংস্কৃতি বিনির্মাণে উপাদান জুগিয়েছে। এখানকার মানুষ নানা ধর্ম পালন করলেও কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার কারণে কৃষির নানা উপাচার তাদের জীবনবোধের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। যে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন, সেগুলোকে উৎড়িয়ে কৃষির সেসব উপাচার এখানকার মানুষের সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
এখানকার লোক তথা জনবসতির আবহমানকালের ধারায় গড়ে ওঠা সংস্কৃতিই হলো মূলত এখানকার লোকসংস্কৃতি। কালেরপ্রবাহে এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির শাসন-শোষণ, তোষণ, ইত্যাদি নানা ধারায় সংস্কৃতির রূপান্তর বা ক্রমবিবর্তন ঘটলেও লোকসংস্কৃতির মৌল ধারাটি কিন্তু এখনো অব্যাহত আছে। আধুনিকতার ডামাডোলে অনেক কিছুর বিবর্তন-পরিবর্তন হলেও লোকসংস্কৃতিই হলো এখানকার নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল সংস্কৃতি। সংস্কৃতির একটি বৃহত্তর সংজ্ঞায় বলা হয় ‘আমরা যা তাই আমাদের সংস্কৃতি’। বাংলাদেশ আজো একটি কৃষিপ্রধান দেশ। ফলে কৃষকের জীবনের কর্মপ্রবাহের সমষ্টিই হলো এখানকার লোকদের সংস্কৃতি তথা লোকসংস্কৃতি।
বাংলার লোকসংস্কৃতির বড় উপাদান হলো এর ভাষা। বাংলা নামের এ দেশটির নামকরণই হয়েছে এর ভাষাগত অবস্থার কারণে। খ্রিস্টপূর্ব যুগে আগত গৌতম বুদ্ধ নিজে যেসব বর্ণমালা শিখেছিলেন এর মধ্যে বাংলা বর্ণমালাও ছিল। চর্যাপদের কবিদের মধ্যে দেখা যায় বারমাসির প্রয়োগ। এর মানে এখানকার লোকজ জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে বারমাসি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এখানকার আবহাওয়াগত কারণে মানুষের ঘর তৈরিতে যেসব উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে- মাটি, শন, নলখাগড়া, কাঠ ইত্যাদির ব্যবহার ছিল মূল। পরবর্তীতে পোড়ামাটি, শান, ইট ইত্যাদির ব্যবহারের পাশাপাশি এসেছে করোগেটেড টিনের ব্যবহার থেকে শুরু করে আধুনিককালের বহুতল ভবন নির্মাণের কাল। কিন্তু কালের বিবর্তন আমাদের চাকাকে যেদিকেই নিয়ে যাক না কেন এখানকার মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গী খনার বচন আজো তাকে পথ দেখায়। কৃষক কখন তার জমিতে বীজ বপণ করবে, কোন সময়ে বৃষ্টি হলে কৃষকের জীবনে দুর্যোগ নেমে আসবে, কোন সময়ে বৃষ্টি হলে ‘ধন্য রাজার পূণ্য দেশ’, আবার কতগুলো কলাঝাড়া থাকলে একজন কৃষক ‘মাচায় শুয়ে’ থাকার যোগ্যতা অর্জন করতো- এতো কৃষিভিত্তিক সমাজের সেই খনার বচনে নির্দেশিত। এমনকি এখানকার আধুনিক স্থাপত্যেও দেখা যায় লোকজ সে উপাদান বিদ্যমান। এখনো মানুষ এমনকি আধুনিক স্থপতিরা বাড়ি তৈরি করতে খনার বচনকে সামনে রেখে কাজ করে। ‘দক্ষিণ দুয়ারি ঘরের রাজা, উত্তর দুয়ারি তারি প্রজা, পূব দুয়ারির মুখে ছাই, পশ্চিম দুয়ারির খাজনা নাই।’ খনার এ বচন তো এখনো দালান কোটা নির্মাণের সময়, বাড়ি তৈরিতে বা ফ্লাট
নির্মাণেও দক্ষিণ দুয়ারি হতে চায়। দক্ষিণদুয়ারির এই যে মানসিকতা এখানেই আমাদের লোকসংস্কৃতির প্রভাবটি ধরা পড়ে।
বাংলার লোকসংস্কৃতির আলোচনায় এখানকার ষড়ঋতুর বিষয়টি প্রাচীনকাল থেকেই বৈচিত্র্যপূর্ণ। পৃথিবীর খুব কম দেশেরই ৬টি ঋতু আছে। বাঙালির লোকসংস্কৃতির ধারায় এখানকার কালপরিক্রমা এক ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। বছরের কোন মাসে কোন ফসলের বীজ বপণ করতে হবে, কোন মাসে কোন গাছ লাগাতে হবে, কোন ঋতুতে কোন ফল, ফসল ফলাতে হবে, কোন সময়টায় মাছ ধরার কাজে সময় দিতে হবে, গরু বাছুর, পশু-পাখি প্রতিপালনে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, কোন সময়টায় ফসল তোলার আনন্দে মেতে উঠতে হবে, কোন সময় জমির খাজনা পরিশোধ করতে হবে এর সবই ছককাটা জীবনের অংশ। এগুলো কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রভাবের ফল নয় বরং লোকেদের জনজীবনের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মের ধারায় গড়ে ওঠা। বিভিন্ন ধর্মীয় কারণে উৎসবাদিতে বৈচিত্র্য থাকলেও বাঙালির লোকজ উৎসবগুলো একান্তই আলাদা ও সার্বজনীন।
বাঁশ-বেতের কাজ, মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিল, কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, কাঁথার কারুকাজ, দাঁড়িয়াবান্দা, ছি, বৌছি, কানামাছি, ডাংগুলি খেলা, বলি খেলা, লাঠিবাড়ি খেলা, ঘুড়ি উড়ানো, নানা ধরনের মেলা, তীর্থ ভ্রমণ, আত্মীয়বাড়িতে বেড়ানো, যৌথ পরিবার, বড়দের মান্য করা ছোটদের স্নেহ করা, সন্তান জন্মদানে আঁতুরঘর, পাটের, শনের, ধানের, চালের বহুমুখী ব্যবহার, নৌকা বাইছ, ঘোড়া দৌড়ানো, মইদৌড়, লাঙ্গলদৌড়, কেশকামলা, বিলের মাছ ধরতে হাত বাওয়া, কোনো পাখির ডাককে কল্যাণ-অকল্যাণ জ্ঞান করা, ইত্যাদি বহুমুখী ধারায় লোকসংস্কৃতির বিচরণ। এর কোনো কোনটা অধূনা সংস্কার না হয়ে কুসংস্কার হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। তবে বিষয়টি কু-হোক আর সু-হোক লোকসংস্কৃতির উপাদান তো বটেই।
বাঙালির বর্ষপরিক্রমার ধারায় চৈত্র সংক্রান্তি অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনটি অতিবাহিত হওয়ার মধ্যদিয়ে নতুন বছরে প্রবেশে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্যের লোকসংস্কৃতি। ফাল্গুনের হালকা গরমে যখন শীত বিদায় নিতে শুরু করে এরপরই চৈত্রের কালবৈশাখী এসে ধূলাবালি সব উড়িয়ে প্রকৃতিকে সাফ-সোতর করে নতুন দিনের যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি নেয়। নতুনের আহ্বান নিয়ে আসে বৈশাখ। আমাদের আর্থ-সামাজিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও নীতি-নৈতিকতার ইতিহাসের পাতায় তাই দেখতে পাই পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। ফলে বাংলাসনের প্রথম দিনটি তথা পহেলা বৈশাখকে আলাদা বৈচিত্র্যে পালন করাও এখানকার লোকসংস্কৃতির এক অন্যতম অঙ্গ।
পহেলা বৈশাখ পালনে যেসব উপাচার পালন করা হয় এর মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা একটি। কৃষক পরিবারের মেয়েরা ঘরের মাটির ভিটা এবং দুয়ার লেপে-পোঁছে সুন্দর করে। হিন্দু পরিবারে কাদামাটির সাথে গোবর মিশিয়ে লেপা-পোঁছা করা হয় এবং তুলসী গাছের গোড়ায় ফুল রাখা হয়। মুসলমান পরিবারের লোকেরা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে হাতমুখ ধোয় এবং অজু সেরে নামাজ পড়ার পর কুরআন তেলাওয়াত করে। কৃষক তার কৃষির সরঞ্জাম লাঙ্গল-জোঁয়াল-মই ইত্যাদি ধোয়। গরুকে গোসল করায় এবং ভালো খাবার দেয়। গরুর গোশালা পরিষ্কার করে। মাছি যাতে গরুর কাছে না ভিড়তে পারে সেজন্য প্রয়োজনে ধোঁয়া দেয়। ছেলে-মেয়ে যাতে নিজ নিজ কাজ যথাসময়ে এবং যথানিয়মে করে সে দিকে অভিভাবকগণ একটু আলাদা নজর রাখে। ধোপ দূরস্ত পরিষ্কার পোশাক পরে অনেকে এদিক-সেদিক বেড়াতে যায়। মিথ্যা বলা বা কাউকে ঠকানো থেকে বিরত থাকে। মানুষ একে অন্যের সাথে আচার-আচরণে সতর্কতা অবলম্বন করে যেন বছরের প্রথম দিনে কোনো অনাকাক্সিক্ষত কিছু না হয়। এ উপলক্ষে কোনো কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মিছিল, শোভাযাত্রা, বর্ষবরণ ইত্যাদি অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। নিম্নবিত্ত শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষজনও কর্মছুটির সুযোগে এদিন নানা রঙের পোশাক পরে ব্যাপক হারে পার্কগুলোতে ভিড় জমায়। এ দিন প্রত্যেকে তার নিজ সামর্থ অনুযায়ী যতটা সম্ভব ভালো খাবারের আয়োজন করে। পারতপক্ষে এদিন আগের দিনের বাসী খাবার যাতে ঘরে না থাকে সেদিকে সকলেই একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখে। সকাল সকাল গরম ভাতের সাথে বিশেষ করে নানা জাতের শাক এবং মাছ-গোশত খেয়ে থাকে। শহরে বিশেষ করে রাজধানী শহর ঢাকার রমনা অশ্বত্থমূলে বা কোনো কোনো হোটেলে পান্তাভাত খাওয়ার যে দৃশ্য আমরা দেখি তা লোকসংস্কৃতির অংশ নয়।
পহেলা বৈশাখ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৈশাখী মেলা বসে। মেলায় বিশেষ করে হাতে তৈরি কুঠির শিল্পের নানা জিনিস যেমন- চেয়ার, টেবিল, চৌপায়া, বেলাইন, পিঁড়ি, রেহেল, লাঠি, ইঁদুর ধরার ফাঁদ, নারিকেল কুড়ানি, গাঁইল, চেগাইট, খড়ম, পাউডি, ডাল ঘুটনি, ঘুড়ির নাটাই, মাটির তৈরি রকমারি জিনিস, খেলনা, মুড়ি, খৈ, মন্ডা, মিঠাই, জিলাপি, বাতাসা, তিল­া, ইত্যাদি বেচা-কেনা হয়ে থাকে।
ব্যবসায়ীরা বছরের প্রথম দিন থেকে খোলে নতুন খাতা, যাকে বলে হালখাতা। মুসলমান ব্যবসায়ীরা এদিন আয়োজন করে মিলাদের। প্রিয়জনকে বই দেয়া, বইমেলার আয়োজন, নববর্ষের শুভেচ্ছা কার্ড পাঠানো, পুইনাহ অনুষ্ঠান, উপজাতীয়দের বৈসাবি উৎসব, বাচ্চা-কাচ্চাদের বেঙ্গাবেঙ্গির বিয়ে, বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা, গম্ভীরা গানের মাধ্যমে আত্মসমালোচনা, বলী খেলা, কুস্তি ইত্যাদি নানা ধারায় পহেলা বৈশাখে লোকসংস্কৃতির প্রাচীন ধারাটি আধুনিকতার সাথে সেতুবন্ধন তৈরি করে বাঙালির আবহমানকালের ঐতিহ্যকে লালন করে চলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাচীন খাজনা আদায়ের পুইনাহ অনুষ্ঠানের ন্যায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক ‘রাজস্ব হালখাতা’ উদযাপনের মাধ্যমে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বৈশ্বিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট বিচার করলে তাই দেখা যায়, বাংলার লোকসংস্কৃতি বহুমুখী ধারায় বিকশিত এক উন্নত সংস্কৃতি। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত ও পুষ্ট বাংলার এ লোকসংস্কৃতি আধুনিকতার ডামাডোলে যেন বিলীন হয়ে না যায়- এই হোক একান্ত প্রত্যাশা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন