তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়....। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতার মতোই নতুনের জয়গান নিয়ে বছরঘুরে আবার এসেছে পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ ১৪২৬। পুরনো দিনের দুঃখ, গ্লানি, হতাশা দূর করে আসবে নতুন ভোর। যে ভোরে উদিত হবে নতুন সূর্য। কালবৈশাখী ঝড়ঝঞ্ঝা সব উপেক্ষা করে এক নতুনের শুভবারতা নিয়ে এসেছে বৈশাখ। নব উদ্যমে সাজবে পৃথিবী, এটাই সবার প্রত্যাশা।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট তার বাণীতে বলেছেন, বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ উৎসব সার্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালির আত্মপরিচয় এবং জাতিসত্তা বিকাশের শেকড়। তিনি তার বাণীতে অতীতের গ্লানি, দুঃখ, জরা মুছে; অসুন্দর ও অশুভ পেছনে ফেলে নতুন কেতন উড়িয়ে বাংলা নববর্ষ ১৪২৬ জাতীয় জীবনে আরো সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক- এ প্রত্যাশা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, নতুন বছরের প্রথম দিনে আমরা অতীতের গ্লানি ভুলে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে আশায় বুক বাঁধি। দেনা-পাওনা চুকিয়ে নতুন করে শুরু হয় জীবনের জয় গান। পয়লা বৈশাখ তাই যুগ যুগ ধরে বাঙালির মননে-মানসে শুধু বিনোদনের উৎস নয়, বৈষয়িক বিষয়েরও আধার। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলা নববর্ষ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বাঙালি জনগোষ্ঠী বর্ষবরণ উৎসবকে ধারণ করেছে তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাণী দিয়েছেন। তিনি তার বাণীতে নববর্ষের নতুন আলোতে দেশের সকল মানুষের সুখ ও শান্তি কামনা করেন।
বাংলা নববর্ষকে ঘিরে মানুষের মনে বইছে আনন্দের ফল্গুধারা। নতুন দিনের আলোয় আজ সবাই দিনভর মেতে থাকবে উৎসব-আনন্দে। সর্বস্তরের মানুষ হৃদয়ের টানে মিলিত হবে এ উৎসবে। তাতে থাকবে না কোনো ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ, থাকবে না ধনী-গরিবের বৈষম্য।
নববর্ষ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের নানা বয়সের মানুষ উৎসবের আলোয় রঙিন হয়ে উঠবে। পোশাক-পরিচ্ছদ, খানাপিনা, গানবাদ্যসহ সব কিছুতে থাকবে বাঙালিয়ানার প্রাধান্য। দিনভর ঘোরাঘুরি, আড্ডা, আমন্ত্রণ ও তুমুল উচ্ছ্বাসে মেতে উঠবে তারুণ্য। যান্ত্রিক শহর ঢাকার মানুষ সাতসকালেই ঘর থেকে বের হবে। নারীরা পরবে লাল-সাদা শাড়ি, ছেলেদের পরনে থাকবে রঙ- বেরঙের পাঞ্জাবি, ফতুয়াসহ বৈশাখের সাজসজ্জা। মা-বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বে শিশু-কিশোরের দল। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বসবে নানা সাংস্কৃতিক উৎসব। মানুষ দলবেঁধে তাতে অংশ নেবে।
প্রতি বছরের মতো এবারো রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানে গানে আর চারুকলা থেকে বের হওয়া নববর্ষের শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালি বরণ করবে নতুন বছরকে। সে আয়োজনের সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন চূড়ান্ত করেছেন। তৈরি হয়েছে বিভিন্ন স্ট্রাকচার। এ ছাড়াও মুখোশ, চিত্রকর্ম, মাটির তৈরি সরা, পুতুল, মাছ, পাখি, সূর্যসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়েছে। এবারে মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজের দায়িত্বে আছে চারুকলার ২১তম ব্যাচ। জয়নুল গ্যালারিতে শিক্ষার্থীদের তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম বিক্রির জন্য প্রদর্শন করা হচ্ছে। চারুকলায় আগত দর্শনার্থীরাও পছন্দমতো সেগুলো কিনছেন।
আয়োজকরা জানান, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার পুরোভাগে থাকবে মহিষ, পাখি ও ছানা, হাতি, মাছ, বক, জাল ও জেলে, ট্যাপা পুতুল, মা ও শিশু এবং গরুর আটটি শিল্প কাঠামো। এ ছাড়া রয়েছে পেইন্টিং, মাটির তৈরি সরা, মুখোশ, রাজা-রানীর মুখোশ, সূর্য, ভট, লকেট ইত্যাদি।
সকাল ৯টায় চারুকলা থেকে বের হবে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বর্ণিল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে এ শোভাযাত্রা শাহবাগ মোড় ঘুরে আবার চারুকলায় এসে শেষ হবে। এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে।’ ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে।
এ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে মেলা, পান্তা ভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হবে।
ঢাকায় পয়লা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠান। ভোরে সূর্যোদয়ের পরপরই ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানাবে। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের শুরু।
ছায়ানট ছাড়াও আরো অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন দিনভর নানান আয়োজনে নববর্ষ বরণ করবে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও থাকবে বর্ষবরণের নানা অনুষ্ঠান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন