শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

সমুদ্র সফেন

আহমদ রাজু | প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাই হাই রে; হেহই-হেহই। এই কিডা কনে আছিস, পাড়ার মুরগিতি ধানগুলো যে খায়ে গ্যালো। হাতের কাছে থাকা ঘর কুড়ানো ঝাঁটা ছুড়ে মারতে মারতে কথাগুলো বলে রইজ উদ্দিন।
রইজ উদ্দিনের তাড়া খেয়ে মুরগিগুলো ছুটে পালায় দিগি¦দিক। সে বারান্দা থেকে নেমে উঠানের একপাশে ছুটে যাওয়া ঝাঁটা কুঁড়িয়ে এনে হেলান দিয়ে রাখে ঘরের কোণে।
খুব বেশি ধান হয় না তার। ছয় কাঠা জমিতে যা হয় তাতে টেনেটুনে সর্বোচ্চ তিন মাস চলে। বাকি মাসগুলো পরের ক্ষেতে কাজ করে চলতে হয়। কুন্নীর কেনা গাভীর দুধ বিক্রি করে যে পয়সা হয় তা রেখে দিতে হয় জমির সার, মাটি, বীজ কেনার জন্যে। যতদিন দুধ হয় ততদিন তাকে চিন্তা করতে হয় না। আর পরের ক্ষেতে কাজ করা? সে তো তিন মাস পরের চিন্তা।
এ বছর তার ভাগ্যে কি আছে তা ভাবলে কষ্টে ভরে ওঠে মন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে জমানো টাকায় ফসল করতে পারবে না। দু’বছর আগে আলুর কেজি দশ থেকে বারো টাকার মধ্যে ছিল, বর্তমানে সেই আলু পঁচিশ থেকে ত্রিশ টাকা। শুধু আলু নয়, পেঁয়াজ রসুন থেকে শুরু করে সার কীটনাশকের দাম ঠিক আলুর মতো বৃদ্ধি পেয়েছে।
খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় রইজ উদ্দিনকে। পাঁচ ছেলে-মেয়ের পিতা হয়েও এই বৃদ্ধ বয়সে নিজের পরিশ্রম করাকে সে নিয়তি বলে ধরে নিয়েছে। শুধু একটা বিষয় তাকে সবসময় পীড়া দেয়। তা হলো, কুন্নীকে সে আজো বিয়ে দিতে পারেনি। চার ছেলে এক মেয়ের মধ্যে কুন্নী সবার ছোট। ছেলেগুলো বিয়ে করে যার যার মতো আলাদা হয়েছে।
একে একে চার ছেলেকে বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে আনলেও সংসারে সুখ বলে যে জিনিসটা আসে তা আসেনি রইজ উদ্দিনের সংসারে। সব ছেলে-বউয়ের চোখে-মুখে যেন স্পষ্ট ফুটে ওঠে, শ্বশুর-শাশুড়ি আর একমাত্র ননদ তাদের বোঝা হয়ে আছে। একথা তারা অনেকভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। কথায় কথায় কুন্নীকে তারা বলতো, আইবুড়ো মেয়ে ভাইদের সংসারে বসে বসে খেতে লজ্জা করে না, কোন সংসারে এমন মেয়ে নেই, থাকলেও তারা ঢাকায় যেয়ে গার্মেন্টসে চাকরি করছে ইত্যাদি ইত্যাদি
শেষ পর্যন্ত ছেলেদের আলাদা করে দিলেও কুন্নী বাপের সংসারে আর থাকেনি। একদিন কাউকে কিছু না বলে ঢাকায় চলে যায়। সেখানে এক গার্মেন্সে চাকরি নিয়ে রইজ উদ্দিনকে চিঠিতে জানায়, সে যেন কোন চিন্তা না করে, ঢাকায় সে ভালো আছে। বেতনও বেশ ভালো। ক’দিন পরে বাড়িতে কিছু টাকাও পাঠাতে পারবে। রইজ উদ্দিন মনে মনে বলে, আমার জন্যি তোর কুনো চিন্তা করতি হবে নানে মা, তুই শুধু ভালো থাক।
অভাবের সংসার না হলে কি আর মেয়েটাকে সুদূর ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতে হতো? আজ এই বৃদ্ধ বয়সে রইজ উদ্দিনকে মেয়ের জন্যে সারাক্ষণ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় কাটাতে হতো না। দেখতে দেখতে তিন বছর গত হয়েছে কুন্নী ঢাকায় গেছে। এই তিন বছরে একবার বাড়িতে এসে সপ্তাহখানেক থেকে গিয়েছিল। যাবার সময় রইজ উদ্দিনের হাতে পনের হাজার টাকা দিয়ে বলেছিল, এই টাহা দিয়ে এট্টা দুধেলা গাই কিনবা। আর তুমি কুনো চিন্তা এরবানা। আমি ঢাহায় খুব ভালো আছি।
-তোর আর ঢাহায় যাতি হবে না। এবার এট্টা ছুয়াল দেহে তোরে বিয়ে দেবো। মায়ে মানসির পরের ঘরে সময় মতো না গিলি চলবে ক্যামনে?
-তুমারে তো কলাম, আমার যন্যি কুনো চিন্তা এরবা না। আমার সময় হলি জানাবানে।
-আর না কস না মা। আর কয়দিন বাঁচবো ক। তোর মাতো এমনিতে কহন মরে তা কতি পারিনে। আমারও নিজির পতি বিশ্বাস নেই। তোর যদি এট্টা গতি এরে কবরে যাদি পারি তালি কবরে শুয়ে আমার আর চিন্তা এরতি হবেনানে।
-তুমি আমার জন্যি খালি চিন্তা এরো। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি ছুয়াল দেহো। সবকিছু ঠিক এরে আমারে মুবাইলি জানায়ানে।
মেয়ের এমন সম্মতিতে মুখে সেদিন হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল রইজ উদ্দিনের।
ছেলেগুলোর গায়ের রং ফর্সা না হলেও মেয়েটার গায়ের রং ফর্সা হয়েছে এজন্য সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দেয় রইজ উদ্দিন। ছেলেগুলোর মতো যদি কালো হতো তাহলে কে তাকে বিয়ে করতো? তার ভরসা একটাই যে, কুন্নীর বিয়ে ঠিকই ভালো জায়গায় হবে। তার মেয়ের কপাল নিশ্চয়ই খারাপ না।
বিভিন্ন ঘটককে রইজ উদ্দিন বলে রেখেছে তার মেয়ের জন্যে যোগ্য ছেলের সন্ধান দিতে। আজ সকালে হোসেন ঘটক এসে জানায়, কোদলার আদু গাজী কুন্নীর ছবি দেখে তার ছেলের জন্যে পছন্দ করেছে। তার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে এখানে কথাবার্তা বলে ফাইনাল করা যায়।
রইজ উদ্দিন আদু গাজীকে ভালোভাবে চেনে। তার ছেলেকে জামাই হিসেবে যদি পায় তাহলে সে নিশ্চিন্তে কবরে যেতে পারবে। আদু গাজীর ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিতে কোন আপত্তি নেই ঘটককে বললে খুশি মনে ঘটক চলে যায়। ঘটক চলে যাবার পরে রইজ উদ্দিন চিন্তা করে আজ বিকেলে বনগ্রাম হাটের মেহেরুন নেটওয়ার্ক থেকে মেয়ের কাছে মোবাইলে কথা বলতে হবে। তাকে বাড়িতে আসার জন্যে বলবে।
মেহেরুন নেটওয়ার্ক থেকে মাঝে মধ্যে মেয়ের কাছে ফোন করে রইজ উদ্দিন। কখনও কুন্নী সরাসরি ধরে, কখনও তার বান্ধবী জোবেদা। মোবাইলটা জোবেদার। কুন্নী আর জোবেদা এক গার্মেন্টসে চাকরি করে। দু’জনের মধ্যে বেশ ভাব। থাকে এক মেসে।
-রইজ চাহা, আহো। মাইয়ার কাছে কল করবা নিশ্চুয়? বললো মেহেরুন নেটওয়ার্কের মালিক এএইচএমআর মন্টু।
-হ রে বাপ। কতদ্দিন মাইয়াডার কুনো খোঁজ পাইনে। আর মনে হয় বেশি দিন তুমারে জ্বালাতি হবে নানে।
-কেন চাহা, একতা কচ্চো ক্যান? বলল এএইচএমআর মন্টু।
-মাইয়াডার বিয়ে ঠিক এরে ফেলিছি। ও বাড়িতি আসলি দিন-তারিখ ঠিক এরবো।
-জামাই কোনহানের? যা এরবা চাহা, অন্তত ভালো এরে দেহে-শুনে মায়ে দিও। অত তাড়াহুড়ার কুনো দরকার নেই। কুন্নীতো আর দেখতি খারাপ না। তাছাড়া সে ঢাহায় চাহরী এরে। অহন চাহরীর কী মূল্য তা যে খোঁজতেছে সে জানে।
-তুমার ও নিয়ে ভাবতি হবেনানে। কুন্নীর ওপর তুমাগের কুনো অধিকার নেই তাতো না। ফাইনাল যা এরি তুমাগের না জানায়ে কি এরতি পারবানে? পারবোনানে। হাজার হলি তুমার বাপের সাথে আমার এট্টা ভালো সম্পর্কো ছিলো। তুমিতো তার-ই ছুয়াল।
-তুমার কতা সব ঠিক আছে। কিন্তু আমি তা কচ্চিনে চাহা। কচ্চিযে কুন্নী চাহরী এরতেছে, এরুকনা। আর কয়দিন পরে দিলি পারতে?
-নারে বাপ। আমার বয়স হয়ছে। কহন বাঁচি মরি কিছু কওয়া যায় না। আর তুমার ভাইগের অবস্থা তো জানো, আমি বাঁচে থাহা অবস্থায় যহন খবর নেনা, আর মরে গিলি আমার মায়েডার খোঁজ নেবে তাই কি বিশ্বাস এরতি হবে?
মুখের ওপর বার দুয়েক আঙ্গুল স্পর্শ করে জ্ঞানী মানুষের মতো মন্টু বলল, আমার ঠিক বুজি আহে না চাহা। তুমার চার চারডে ছুয়াল। সুহি থাকতি হলি তুমি থাকপা। আর সেই তুমি এহন ছুয়ালগেরতে আলাদা থাহে বুড়ো বয়সে খাটতি খাটতি মরতিছো! আমরাতো ছয় ভাই; আমি বাদে সবাই বিয়ে এরেচে। অথচ দেহো আমাগের কারো সাথে কুনো দ্বন্দ্ব-বিবাদ নেই। বাপজানরে আমরা তো কুনো কাজ এরতি দিইনে। কাজ যা এরতি হয় আমরা ছয় ভাই এরি।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রইজ উদ্দিন। আর বাপ, কপালে যা লিহা আছে তাইতো হবে। আমার কপালে আল্লা সুক লিহিনি। যদি সুক-ই লেখপে তালি ছুয়ালগুলোরে আলাদা এরে দিয়ে এই বুড়ো বয়সে তুমার কাকির ক্যান মরতি মরতি রান্দে খাতি হবে? ক্যান ছুয়ালগের বউগের হাতের রান্দা খাতি পারবো না? ক্যান মায়েডারে...। রইজ উদ্দিনের কথা শেষ না হতেই এএইচএমআর মন্টু বলে ওঠে, আর দুকখু এরে কি হবে কও?
-দুকখু আর কি। তুমি এটটু ধরাওদিনি। মায়েডা কিরাম আছে তা কিডা যানে। কদ্দিন হয়ে গ্যালো মায়েডার কোন খোঁজ নিতি পারিনি।
এএইচএমআর মন্টু মোবাইলের বোতাম টিপতে টিপতে বললো, এদিকি আহো চাহা। রিং হচ্চে। ন্যাও ধরো, কতা কও।
রইজ উদ্দিন চোখের পলকে মন্টুর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কানের কাছে ধরে বলে, আমি কুন্নীর বাপ কচ্চি, ঘুনীর বাজারেরতে। হ্যালো। আমি কুন্নীর বাপ। শুনতি পাচ্চো?
ওপাশ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে রইজ উদ্দিন মন্টুর হাতে মোবাইলটা দিয়ে বলল, দেহোদিনি ভাইপো কি অলো। কুনো সাড়াশব্দ তো পালাম না।
সাড়াশব্দ পাবা কী এরে? নম্বরে তো ঢোকতেছে না। মনে হয় ওই মোবাইলডা বোন্দ।
-বোন্দ থাকপে ক্যান? তুমি আর এট্টু চিষ্টা এরে দেহো দিনি। কও যে ঘুনীর বাজারেরতে কুন্নীর বাপ কতা কবে। আমার কতা শুনলি মুবাইল খাটাবেনে।
হেসে ওঠে মন্টু। তুমি যে কী কও চাহা পাগলের মতো। কারে কবো?
-কেনো জোবেদারে কও আমার কতা।
-জোবেদার মুবাইলতো বোন্দ।
-ওই তো, আমার কতা কও। আমার কতা শুনলি খাটাবেনে।
-তুমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে চাহা। মুবাইল বোন্দ থাকলি কোন কতা তো কওয়া যায় না।
মাথা চুলকাতে চুলকাতে রইজ উদ্দিন বলল, কি জানি বাপ; আমি কি আর এতসব বুঝি। আমি তালি বোসতিছি, এট্টু পরে আবার চিষ্টা এরে দেখলি হবেনে।
-আচ্চা বসো তালি। আমি অন্য কাজ সারতি লাগি। বলল মেহেরুন নেটওয়ার্ক এর মালিক মন্টু।
-তুমি কাজ সারো বাপ। আমি কুদোর দুকানের দিকি যাচ্চি। এট্টা চা খায়ে আসি।
রইজ উদ্দিন কুদোর দোকানে যেয়ে চা খায় চুক চুক শব্দে। সে শব্দ অনেকের কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও কারো কারো কাছে বিরক্তিকর মনে হয়।
চা পানরত অবস্থায় টেবিলের উপর থাকা সংবাদপত্র হাতে তুলে নেয় সে। বিভিন্ন সংবাদ পড়তে পড়তে চোখ আটকে যায়, ‘আশুলিয়া ব্রিজের নিচে ক্ষত-বিক্ষত গার্মেন্টস কর্মীর লাশ উদ্ধার’ শিরোনামের সংবাদের দিকে।
সংবাদটি পড়া শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রইজ উদ্দিন। মুখে তার অদৃশ্য কষ্টের ছাপ ফুটে ওঠে মুহূর্তে। সে কষ্ট কিসের এবং কেন তা পাশের টেবিলে বসা লোকগুলো বোঝার চেষ্টা করে না। কাগজটা টেবিলের উপর ভাজ করে রেখে দোকানির চায়ের দাম মিটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় রইজ উদ্দিন। পেছন থেকে মেহেরুন নেটওয়ার্কের মালিক এএইচএম আর মন্টু ডাক দিলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Al Amin Sardar ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১১:৩৮ এএম says : 0
অসাধারণ একটি ছোটগল্প
Total Reply(0)
Al Amin Sardar ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১১:৩৯ এএম says : 0
অসাধারণ একটি ছোটগল্প
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন