বাংলা সাহিত্যে গোলাম হোসেন একটি অবহেলিত প্রতিভা। যদিও আধুনিক গদ্যে-পদ্যে তাঁর দান অপরিসীম। বিশেষ করে গদ্য সাহিত্যে তার দান অধিক। কাব্যে মাইকেল মধুসূদন ও গদ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা তাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তিনি এই অন্ধকরণের অসারতা উপলদ্ধি করেন এবং জাতি হিসেবে হিন্দু মুসলমানের সত্তা ও অভিব্যক্তি যে ভিন্নতর হবে এ কথা মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করেন। তাঁর ‘দিল্লি আগ্রা ভ্রমণ’ ও ‘বঙ্গদেশীয় হিন্দু মুসলমান’ গ্রন্থদ্বয়ে এই অভিব্যক্তির চরম প্রকাশ ঘটে। এই গ্রন্থদ্বয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে, হিন্দু ও মুসলমান শত শত বছর ধরে একত্রে বসবাস, একই অন্নে পালিত, এমনকি একই আবহাওয়ায় জাতীয়তার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তার কারণ বহুবিধ হলেও বাঙালি উচ্চ বর্ণের হিন্দু সমাজের অনুদার মনোভাবই যে প্রধানত দায়ী সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আজাদী উত্তরকালে লিখিত কবির আত্মজীবনীতেও কবি তাঁর বিশিষ্ট চিন্তা ধারার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। ‘বঙ্গদেশীয় হিন্দু মুসলমান’ গ্রন্থে কবি বাঙালি হিন্দু মুসলমানের বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সে স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। কবির আবির্ভাবকালে লর্ড কার্জন কর্তৃক ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ সালে বঙ্গদেশ বিভক্ত হয়। এর পর বছর ১৯০৬ সালে পাক-ভারত বঙ্গদেশীয় মুসলমানদের স্বাধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে নিখিল ভারত মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়। কবি সক্রিয়ভাবে এই সব আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও সেই স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি অমনোযোগী থাকতে পারেননি। বরং এই আন্দোলন ও তার পরিমাপ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতেন। তারই ফলশ্রুতি তার ঐ গ্রন্থ। লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ বাঙালি মুসলমানের অনুকূলে ছিল মনে করে সাধারণভাবে তা বাঙালি মুসলমানদের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছিল। পক্ষান্তরে বাঙালি হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক হলেও এ আন্দোলনের পুরোধার ছিলেন এদেশের হিন্দু সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদরা। ফলে অল্পদিনের মধ্যে আন্দোলনের রূপ পাল্টে তা ‘স্বদেশী আন্দোলন’ নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং স্বদেশীকতার নামে বিলেতি বর্জনও চলতে থাকে। ফলে মুসলিম সমাজ এক নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। গোলাম হোসেন স্বদেশী আন্দোলনে যোগদানের জন্য সমাজকে আহ্বান করেন বটে, তবে তিনি হিন্দু জনতার বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করেন যে, তারা বঙ্গভাগ ও স্বদেশী আন্দোলনকে এক করে মারাত্মক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন। অবশ্য পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু জননেতারা স্বেচ্ছাকৃতভাবে এই দুই আন্দোলনকে একত্র করে রাজনৈতিক ফায়দা ওঠাতে চেয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে তারা যথেষ্ট সফলতাও অর্জন করেন। তবে মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের অনেকেই বিলেতি বর্জনের মূল রহস্য ধরতে পেরেছিলেন। কথাশিল্পী নজিবর রহমানের ‘বিলাতি বর্জন রহস্য’ পুস্তিকা খানির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সে কারণে কবি গোলাম হোসেনের কণ্ঠে সমকালীন মুসলিম বাংলাই যেন কথা বলে উঠেছিল। যদিও তার পরবর্তী গ্রন্থ ‘দিল্লি আগ্রা ভ্রমণ’ গ্রন্থে এসব বিপ্লব-আন্দোলনের কথা না থাকলেও কবির স্বাজাত্য বোধের পরিচয় অত্যন্ত স্পষ্ট। তবে এ বিষয়ে লক্ষ্য করার মত যে, মুসলিম সমাজের দাবি, সমাজের দাবি দাওয়ার প্রতি উচ্চকণ্ঠ হলেও গোলাম হোসেনের কোন রচনাই হীন সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট নয়। উপরন্তু তিনি সাহিত্য ও সমাজ জীবন থেকে এই হীন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দূরীভূত করার জন্য আকুল আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁর গ্রন্থে। অবশ্য শেষ জীবনে বাংলা সাহিত্যে অনৈসলামি ভাবধারা ও হিন্দু প্রভাব সম্পর্কে তিনি ব্যক্তিগতভাবেও আলোচনা করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি তাঁর নিজস্ব সৃষ্ট কাব্য সাহিত্যকেও রেহাই দেননি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোন সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে কোন কথা বলেননি বটে, তবে প্রতিবেশী হিন্দু সাহিত্যিকদের বিদ্বেষমূলক সাহিত্য সৃষ্টির সমালোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি কোন লেখকের দোষের কথা বলতে গিয়ে তাঁর যথার্থ গুণের কথা ভোলেননি। নিজের ব্যবহারেও তার ব্যতিক্রম নেই। প্রাথমিক জীবনে সাহিত্য ক্ষেত্রে গুরুরূপে বঙ্কিমচন্দ্র ও মধুসূদনকে মেনে নিলেও তিনি তাদের সমালোচনা করতে পিছপা হননি। নিজের লেখার প্রতি তাঁর নালিশ ছিল যে, নিজে মুসলিম হয়েও মুসলমানী আদর্শ বর্জিত সাহিত্য সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই লজ্জার কথা তিনি সারা জীবনেই ভুলতে পারেননি। তার মনে হয়েছে মুসলিম সন্তান হিসেবে এই কাজে আত্মনিয়োগ করা নিতান্তই গর্হিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁর প্রথম রচনা ‘বঙ্গবীরাঙ্গনা’ কাব্যের ব্যক্তিগত কপির পাতার পর পাতা তিনি কালির আঁচড়ে বিকৃত করেছেন। এমনকি কোন কোন স্থানে তাতেও সন্তুষ্ট হতে না পেরে বহু পাতা ছিঁড়ে ফেলে মনের জ্বালা জুড়িয়েছেন। অথচ সমকালের মুসলমান লেখকরা হিন্দুয়ানী আদর্শে কাব্য সাহিত্য রচনা করে যথেষ্ট আত্মতৃপ্তি লাভ করতেন। হিন্দু লেখকগণ তাদের প্রশংসা করতে গিয়ে এতদূর বাড়াবাড়ি করতেন যে, তাদের মুখে এমন কথা বাঁধত না যে, এই হিন্দু মার্কা মুসলমান লেখক খাঁটি ব্রাহ্মণ সন্তানকেও সাহিত্যিক দৌড়বাজিতে হারিয়ে দিয়েছেন। স্বয়ং গোলাম হোসেন সেই মোহে পড়ে ‘বঙ্গবীরাঙ্গনা’ রচনা করে বিশেষ গৌরব বোধও করেছিলেন। মীর মশাররফ হোসেন, কবি কায় কোবাদ, মোজামে¥ল হক প্রমুখ মুসলিম কবি সাহিত্যিকরা এই ভাষাতেই সাহিত্য সাধনা করে খ্যাতিমান হয়েছেন। গোলাম হোসেনও তাই সেই পথেই যাত্রা করেছিলেন। ‘বঙ্গবীরাঙ্গনা’য় এই হিসেবে তার সিদ্ধির পরিচয় মিলেছে। কিন্তু মুসলিম কবি পরবর্তীকালে তার জাতীয় দৃষ্টি ভঙ্গিতে এই সাহিত্য সৃষ্টির অসারতা উপলদ্ধি করে তার গ্রন্থ সমালোচনা প্রসঙ্গে যেসব মন্তব্য করেছেন, বাঙালি মুসলমান সাহিত্য সেবকদের কাছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গোলাম হোসেন তার দীর্ঘ জীবনে বেশ কয়েকটা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তার গ্রন্থাবলীর মধ্যে বঙ্গবীরাঙ্গনা (১৯০৬), বঙ্গদেশীয় হিন্দু-মুসলমান (১৯১০), দিল্লি আগ্রা ভ্রমণ (১৯১২), নীতি প্রবন্ধমূলক (১৯২১), কাব্য যুথিকা প্রথম খ- (১৯৬০), পয়গামে মোহাম্মদী অনুবাদ (১৯২১)। তার অপ্রকাশিত পত্রাবলী ও পা-ুুলিপির মধ্যে হযরত মোহাম্মদ (ছঃ আঃ)-এর জীবনী কাব্য প্রথম ও দ্বিতীয় খ-, ‘পাকিস্তান গাথা ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপ’, ‘বর্তমান মুসলিম বাংলা অনৈসলামিক ভাবধারা ও হিন্দু প্রভাব’ প্রথম ও দ্বিতীয় খ-, ‘আশা মরীচিকা’ সামাজিক উপন্যাস, ‘কারবালা কাব্য’, ‘সিরাজউদ্দৌলা’ কাব্য, ‘পলাতকা’ কাব্য, ‘বন্দিনী বাঁদীর বেদনা’। প্রথম ছয়খানা কাব্যের পা-ুলিপি বাংলা একাডেমিতে প্রকাশের জন্য দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পা-ুলিপি বাংলা একাডেমিতে পাঠানোর সাথে সাথে লেখক কিছু মাসিক বৃত্তির জন্যও আবেদন করেছিলেন। একাডেমি কবির আবেদন মঞ্জুর করে কবিকে দুইশ টাকা মঞ্জুর করেছিলেন। তাছাড়া কবি শিক্ষা বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং শিক্ষা বিভাগ তার প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ এককালীন তিনশ টাকা দান করেন ২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯। এছাড়া বাংলা একাডেমির একখানা পত্র থেকে জানা যায়, কবি তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী একাডেমিতে প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এটি একাডেমি পরিকল্পিত সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের সাহিত্যিক জীবনের অভিজ্ঞতা বিষয়ক গ্রন্থে সংকলিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সাহিত্যিকদের তরফ থেকে উপযুক্ত সাড়া না পাওয়ায় একাডেমি কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনাটি বাতিল করেন। ফলে কবির আত্মজীবনীটি প্রকাশিত হতে পারেনি। পরে আত্মজীবনীটি পশ্চিম বাংলা থেকে ‘নেদায়ে ইসলাম’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রকাশ করেন ময়মনসিংহ জেলার পাকুন্দিয়া গ্রাম নিবাসী খুরশীদ আহমেদ। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে তাঁর বেশ কিছু মননশীল প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে ১৯২৯ সালে ‘মোহাম্মদী’র জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় সংখ্যায় ‘বাঙ্গালা দোভাষী পুথি’ এবং ‘ইসলাম দর্শনে’ তার কিছু কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। কবির সাহিত্য সাধনার কাল ১৯০৬ থেকে ১৯২১ সাল। পরবর্তীতে তাঁর একমাত্র কাব্য ‘যুথিকা’র প্রথম খ- ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। এর মাঝে প্রায় চল্লিশ বছরের ব্যবধানকালে মনে হয় কবি অজ্ঞাতবাসে ছিলেন। তাই তাঁর লেখনীর সাথে পাঠকদের কোন পরিচয় ঘটেনি।
কবির সাহিত্য জীবন শুরু হয় ১৯০৪ সালে। তখন তিনি সরকারি স্কুলসমূহের সহ-পরিদর্শক রূপে কার্যরত ছিলেন। এ সময় তার সাথে পরিচয় ঘটে ডেপুটি ইন্সপেক্টর, পরবর্তীকালে সহ-ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন বাংলার খান বাহাদুর আহসান উল্লাহর সঙ্গে। খান বাহাদুরের বিশেষ অনুপ্রেরণাতেই তিনি সাহিত্য চর্চায় অগ্রসর হন। কাব্য রচনার মধ্য দিয়েই তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু। মাত্র দুই বছরের সাহিত্য সাধনার ফলেই তিনি রচনা করেন ‘বঙ্গবীরাঙ্গনা’ (১৯০৬)। তার সর্বশেষ কাব্য ‘যুথিকা’ প্রথম খ- প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। ১৯৬৪ সালের ৫ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু ঘটে। জন্ম ১৮৭৩-৭৪ সালে যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার জোকা গ্রামে মাতুলালয়ে। তার পিতা মুন্সি আব্দুর রহমান ছিলেন সেকালের আরবি ফারসি শিক্ষিত একজন মুন্সি। ছেলেকে তিনি যথাসাধ্য লেখা পড়া করাবার চেষ্টা করেছিলেন। আর্থিক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাকে সুদূর কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসা কলেজে ভর্তি করে দেন। এই কলেজ তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তিনি তার পুত্রের শিক্ষা সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। কলকাতা সিটি কলেজে বিএতে ভর্তি হওয়ার কিছুকাল পরেই কবির পিতা মৃত্যুবরণ করেন (১৮৯৯)। ফলে পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে সংসারের দায়িত্ব গ্রহণের তাগিদে বিএ ডিগ্রি অর্জনের পূর্বেই পড়া বন্ধ করতে হয়। অবশ্য এই ক্ষতি দীর্ঘ আঠার বছর পর ১৯১৮ সালে তিনি যথাযথ পুশিয়ে নিয়ে ডিগ্রি পাস করেন। এ সময় তিনি স্থানীয় বিনোদ বিহারী হাই স্কুলে শিক্ষকতায় নিযুক্ত ছিলেন। স্কুল জীবনে তিনি বিখ্যাত কীর্তনীয়া ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ রায় বাহাদুর খগেন্দ্র মিত্রকে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন এবং বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও জগদীশ চন্দ্র বসুকে শিক্ষক রূপে পেয়েছিলেন।
গোলাম হোসেন সমকালীন মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি আধুনিক শিক্ষায় উচ্চ ডিগ্রিধারী ছিলেন। তার সমকালীন একমাত্র কাজী ইমদাদুল হক ব্যতীত অন্য কোন সাহিত্যিকই বিএ ডিগ্রিধারী ছিলেন না। কবির একই জেলাবাসী অপর কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন অতি মাত্রায় রবীন্দ্র ভক্ত। তিনি তাঁর একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে অতিমানব রূপে চিত্রিত করেন। গোলাম হোসেন তাঁর এই রবিয়ানার প্রতিবাদ করে ব্যঙ্গ কবিতা লেখেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের ‘ছত্রপতি শিবাজী’ কবিতায় সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের প্রতিবাদমূলক একটা সুদীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। তবে কবিতাটি প্রকাশিত হয়নি। সম্প্রতি দোভাষী বা মুসলমানী পুঁথি সাহিত্য নিয়ে সুধী সমাজে যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে এক্ষেত্রে গোলাম হোসেনই পথিকৃতের কাজ করেছেন। ১৯২৯ ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় সংখ্যায় এক ধারাবাহিক প্রবন্ধে এ বিষয়ে সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যতদূর জানা যায়, বাংলার পুঁথি সাহিত্যের উপর সেটিই সর্ব প্রথম রস বিচারমূলক বিস্তারিত আলোচনা। কবি তাঁর একই মহকুমাবাসী সাহিত্যিক ডা. লুৎফর রহমানের ধর্মীয় মত নিয়ে তাঁর পিতা তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। কবি গোলাম হোসেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সহচর’ পত্রিকা যাতে লুৎফর রহমানের লেখা প্রকাশিত হত তার বিরুদ্ধেও সমালোচনামূলক কবিতা লিখেছিলেন। তিনি নজরুল ইসলামের ‘ধূমকেতু’ সম্পর্কেও সমালোচনামূলক কবিতা লিখেছেন।
কবি গোলাম হোসেন দীর্ঘ ৯০ বছর জীবিত ছিলেন। এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে অনেক সংগঠন তাঁর সাহিত্য কীর্তির জন্য তাকে বিভিন্ন সময়ে সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান করেছেন। এর মধ্যে ১৯৫৮ সালের ১৩ ও ১৪ জুনে রংপুর শহরে অনুষ্ঠিত রংপুর সমজদারের আসরের চতুর্থ সম্মেলনে কবিকে মূল সভাপতি করে মূল্যায়িত করা হয়। ঐ বছরেই উক্ত আসরের তরফ থেকে রংপুর শহরে একটি বিশেষ কবি সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। রংপুর কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের উদ্যোগে একটি সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকেও কবিকে সংবর্ধিত করা হয়। এছাড়া কবির জন্মভূমি মাগুরার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্র শিক্ষকবৃন্দ তাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় সাহিত্য কীর্তির জন্য যতটুকু সম্মান পেয়েছেন তা নিতান্ত কম নয়, কিন্তু প্রচারের অভাবে তা প্রকাশ পায়নি। আজকের মত পত্র-পত্রিকা ও সম্প্রচারের ব্যবস্থা এত ভালো না থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি ঠিকই, তাতে আফসোসের কিছু নেই, কারণ যুগকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। জীবনের শেষাবধি তিনি অজ¯্র কবিতা ও গদ্য-পদ্যের গ্রন্থাদি রচনা করেছেন। তার কিছু প্রকাশিত হয়েছে, বেশির ভাগই প্রকাশিত হতে পারেনি। পা-ুলিপি আকারে রয়ে গেছে। অনেক কিছুর আজ আর অস্তিত্ব নেই। তবুও সেই মুসলিম সমাজের অনগ্রসরতার যুগে তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তার মূল্য কম নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন