রোজা সামনে রেখে গত এক সপ্তাহে বেড়েছে আরো কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম। মসুর ডালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০ টাকা। চিনিও কিনতে হচ্ছে চেয়ে দুই থেকে তিন টাকা বেশি দামে। ছোলা কেজিপ্রতি বেড়েছে তিন থেকে চার টাকা। গত একমাসে বৃদ্ধি পাওয়া পেঁয়াজের ঝাঁঝ কমেনি বরং তা বেড়েছে। গত সপ্তাহে ২৮-৩০ টাকা দরে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হলেও গতকাল বাজারে এ দাম বেড়ে ৩০-৩৫ টাকা হয়েছে। এদিকে বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও আসন্ন রোজার বাজার মনিটরিংয়ে নামছে একাধিক গোয়েন্দা দল।
জানা গেছে, রোজার আগেই দেশের চারটি গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক দল বাজার যাচাইয়ে নামবে। নিত্যপণ্যের অবৈধ মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি মনিটর করবেন তারা। বাজার মনিটরিংয়ের গোয়েন্দা দলে র্যাব, পুলিশ ও আনসারের সদস্যরাও থাকবেন। অবৈধ মজুতের সন্ধান পেলে মজুতকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান হচ্ছে-জিরো টলারেন্স। অতীতের ন্যায় এ বছরও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে বলে নিশ্চিত করেছেন স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র। জানা গেছে, যে কোনও অযুহাতে নিত্যপণ্যের বাজার যাতে অস্থির না হয় সেদিকে সতর্ক নজর রাখছে সরকার। এ কারণেই সরকারের এই আগাম ব্যবস্থা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রমজানে কারসাজি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ালে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাজার বিশ্লেষকদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণে প্রশাসনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভাঙতে পারলে, নিত্যপণ্যের দর তদারকিতে টিসিবিকে (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) আরও সক্রিয় করতে পারলে আসন্ন রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের জন্য সহজ হবে।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রমজান উপলক্ষ্যে নিত্যপণ্যের মজুত পরিস্থিতি দেখতে বাজারে নামছে দেশের চারটি গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে একাধিক দল। পণ্যের মজুত, চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি মনিটরিং করবে এসব দল। এ সময় তারা পণ্যের দাম ও মান যাচাই করবেন। ভাউচারের সঙ্গে কোনও ধরনের অসঙ্গতি দেখলে বা প্রতীয়মান হলে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেবে। এজন্য ব্যবসায়ীদের কাছেও সহযোগিতা চাওয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে বিশেষ বাজার মনিটরিং কার্যক্রম চালাবে মন্ত্রণালয়। এজন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুই/তিনটি প্রস্তুতিমূলক বৈঠকও করা হয়েছে। চ‚ড়ান্ত করণীয় নির্ধারণে বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের নিজ নিজ জেলার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা বাজার মনিটরিং ছাড়াও ব্যবসায়ীদেরকে সচেতনতামূলক পরামর্শ দেবেন এবং কেউ সরকারি নির্দেশনা অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ২০০৭ সাল থেকে ঢাকা শহরের বাজার তদারকির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি মনিটরিং দল রয়েছে। একজন উপ-সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন করে কর্মকর্তা এবং পুলিশ ও র্যাবের সমন্বয়ে এ দল গঠিত। তিনি বলেন, তারা নিয়মিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও অনিয়মের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকেন।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম কমেছে। ১০৫ টাকা ডজনের ডিম এখন ৯০ টাকা ও ১৬৫ টাকা কেজির ব্রয়লার মুরগি ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর গোশত আগের মতোই ৫৫০ টাকা কেজি। চলতি মাসের শুরুতে পাইকারি বাজারে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চিনির দাম ছিল দুই হাজার ৪০০ টাকার মতো। এখন সেটা ২০০ টাকা বাড়তি। ফলে খুচরা দোকানে কেজিতে ৫০-৫২ টাকার চিনি ৫৪-৫৬ টাকায় উঠেছে।
দেশে এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। কিছুদিন আগেও পেঁয়াজের কেজি ২৫ টাকার মধ্যে ছিল। এতে কৃষকেরা দাম পাচ্ছিলেন না বলে অভিযোগ ছিল। এখন দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা, হাইব্রিড পেঁয়াজ ও ভারতীয় পেঁয়াজ ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে পেঁয়াজের দর কেজিতে ১০ টাকার মতো বাড়তি। গত সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৮-৩০ টাকা। গতকাল বাজার ভেদে ৩০-৩৫ টাকা দওে বিক্রি হচ্ছে। চীনা আদা ও রসুনের দরও কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়েছে। চীনা রসুন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১২০ টাকা দরে। কেজিপ্রতি চীনা আদা ১২০-১৩০ টাকা ও দেশি আদা ১৪০-১৫০ টাকা চাইছেন বিক্রেতারা।
কারওয়ান বাজারের হাজী মিজান স্টোরের বিক্রেতা জামাল হোসেন বলেন, প্রতি কেজি ছোলার দাম ৩-৪ টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে সরু দানার মসুর ডাল ও খেসারি ডালের দাম কেজিতে ৪-৫ টাকা বাড়তি। তাঁর দোকানে ছোলা ৮০ টাকা, সরু মসুর ডাল ৯০ টাকা ও খেসারির ডাল ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
সবজি ও মাছের দামই মানুষকে ভোগাচ্ছে বেশি। ঝিঙে, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল-এই তিন সবজি বিক্রেতারা ৮০ টাকা কেজি চাচ্ছেন। ঢ্যঁড়স, লতি, বেগুন, পটোল, ধুন্দল, বরবটি ইত্যাদি সবজির দর কেজিপ্রতি ৫০-৬০ টাকা। কাঁচা মরিচের দর এখনো কম, কেজিপ্রতি ৬০-৮০ টাকা। মাছের বাজারে নদী বা বিলের ভালো কোনো মাছ কিনতে গেলেই কেজিপ্রতি দর হাজার টাকার আশপাশে। বড় বেলে, আইড় ও নদীর চিংড়ির কেজিপ্রতি দর ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা হাঁকছেন বিক্রেতারা। বোয়াল, পাবদা, চাষের মাঝারি চিংড়ি, ট্যাংরা, সরপুঁটি ইত্যাদি মাছের কেজিপ্রতি দর ৫০০-৭০০ টাকা। কেজিপ্রতি বড় রুই ও কাতলার দাম ৩৫০-৪০০ টাকা। সাধারণ তেলাপিয়া ও চাষের কই মাছের দরও কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেশি। বড় তাজা তেলাপিয়া ২৫০ টাকা কেজির নিচে বিক্রিতে নারাজ বিক্রেতারা।
কারওয়ান বাজারে কেনাকাটা করতে যাওয়া মিজান সরদার বলেন, ছোলার দাম যদি কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়ে, তাহলে রোজার মাসে আমার ১০ টাকা বাড়তি খরচ হয়। কারণ দুই কেজি ছোলায় মাস চলে যায়। কিন্ত এক কেজি সবজি কিনতে এখন ৩০ টাকা বেশি লাগছে। যে চিংড়ি ৫৫০ টাকা ছিল, সেটা এখন ৭০০ টাকা চাইছে।
অন্যদিকে খেজুর প্রকারভেদে ২২০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। লবঙ্গ এর দাম স্থির থাকলেও বেড়েছে এলাচের দাম। কিছুদিন আগেও ভালো মানের এলাচ কেজিপ্রতি বিক্রি হতো ২২০০ টাকায়, এখন দাম ২৮০০ টাকা। সবকিছুর ভিড়ে চালের বাজার স্থির রয়েছে। নতুন চাল উঠতে শুরু করায় উল্টো কোনো কোনো চালের দাম কমতে শুরু করেছে।
রমজানে ১৮৭টি স্থানে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি: রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজধানী, বিভাগীয় শহরসহ মোট ১৮৭টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রয় করছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী এই তথ্য জানান। মন্ত্রী জানান, টিসিবি ডিলারদের মাধ্যমে গত ২৩ এপ্রিল থেকে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে ঢাকা মহানগরীতে ৩৫টি, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১০টি, অবশিষ্ট ৬টি বিভাগীয় শহরের প্রতিটিতে পাঁচটি করে ৩০টি এবং ৫৬টি জেলা শহরের প্রতিটিতে দু’টি করে ১১২টি স্থানে এই পণ্য বিক্রয় করছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন