নদীর স্রোতের মত সময় ও বয়ে চলেছে তার নিজস্ব গতিতে। দেখতে দেখতে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের পঞ্চম বর্ষ পূর্তি আজ (২৭ এপ্রিল)। দীর্ঘ এই পাঁচ বছরে মামলার প্রাপ্তি হচ্ছে নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতের রায়। মৃত্যুদন্ড বহাল থাকা আসামীদের আপীলের প্রেক্ষিতে এখন চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি সুপ্রীম কোর্টের অ্যাপিলেড ডিভিশনে শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে। তবে নিহতদের স্বজনদের দাবি, যত দ্রত সম্ভব সুপ্রীম কোর্টে শুনানী শেষ করে রায় বাস্তবায়ন করা। তা না হলে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে।এদিকে যথারীতি এ দিনটিকে সামনে রেখে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় মিলাদ, দোয়া ও এতিমখানায় খাবার বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে নহতদের স্বজন ও এলাকাবাসী।
নিহতদের স্বজনদেরও এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, দ্রততার সঙ্গে সুপ্রীম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের কার্যক্রম সম্পন্নের দাবি জানান তারা। চাঞ্চল্যকর এই মামলায় ইতিমধ্যেই নিম্ন আদালত এবং হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স শুনানী সম্পন্ন হয়েছে। নিম্ন আদালতের রায়ে নূর হোসেন, তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এমএম রানাসহ ২৬ জনের মৃত্যুদান্ডেদেশ প্রদাণ করা হয়েছিল। হাইকোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রাখেন।এই চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার ৫ বছর পূর্তিতে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রতিক্রিয়ায় দ্রততার সঙ্গে মামলার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ তার ৪ সহযোগিকে অপহরণ করা হয়। অপহরণ দৃশ্য দেখে ফেলায় নজরুল ইসলামের গাড়ির পেছনে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালককেও অপহরণ করা হয়। অপহরণের ৩ দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দরের শান্তিরচর এলাকার শীতলক্ষ্যা তীর থেকে হাত-পা বাধা অবস্থায় অপহৃতদের লাশ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে ঘটনার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগপত্র জমা দেবার ১০ মাসের মধ্যে শুরু হয় বিচার কাজ। বিচার কাজ শুরুর ১১ মাসের মাথায় রায় ঘোষণা হয়। এ ছিল নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলায় ধারাবাহিকতা। অর্থ্যাৎ ৭ খুনের ঘটনার পর ৩৩ মাসের মধ্যে ( ২ বছর ৯ মাস) নিম্ন আদালত রায় ঘোষণা করেছিল। আর নি¤œ আদালতের রায়ের ৭ মাসের মাথায় হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু সুপ্রীমকোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে এখন মামলাটি শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে।
নিম্ন আদালতে মামলাটির বাদি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ৭ খুনের ঘটনার পর ১ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল। দ্রততার সঙ্গে চাঞ্চল্যকর মামলাটির রহস্য উদঘাটন এবং একটি এলিট ও সুশৃঙ্খল বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়নের গুরুত্বপূর্ণ ৩ জন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামী করে ওই সময় অভিযোগপত্র দিয়ে প্রশংসিত হয়েছিল পুলিশ তথা তদন্ত কর্মকর্তা। এ ঘটনার অভিযোগপত্র জমা দেবার ১০ মাসের মাথায় ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এই মামলার বিচার কাজ শুরু করা হয়। বিচার কাজ শুরুর ১১ মাসের মাথায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় ঘোষণা হয়। রায়ে নূর হোসেন, র্যাব-১১’র সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ, উপ অধিনায়ক আরিফ হোসেন ও এমএম রানাসহ ২৬ জনেক ফাঁসি ও বাকী ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করা হয়।
আর নিম্ন আদালতের রায় ঘোষণার পর মাত্র ৭ মাসের মাথায় ২০১৭ সালের ২২ আগষ্ট হাইকোর্টে মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানী সম্পন্ন হয় এবং সেখানে নূর হোসেন, তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন, এমএম রানাসহ ১৫ জনের ফাঁসির দন্ডাদেশ বহাল রাখা হয়। নি¤œ আদালতে ফাঁসির দন্ড পাওয়া বাকী ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হয়। হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স শুনানী পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর এই মামলাটির সব কিছুই দ্রততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স শুনানীর পর সুপ্রীম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে গিয়ে সবকিছু যেন থমকে গেছে। এটি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের গাফলতি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সাত খুনের ঘটনায় হওয়া দুই মামলার প্রথমটির বাদি নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমাদের এখন একটিই চাওয়া, সেটি হল যত দ্রত সম্ভব আদালতের কার্যক্রম শেষে খুনীদের রায় কার্যকর করা। তাহলেই নিহতদের আত্মা শান্তি পাবে।
দ্বিতীয় মামলার বাদি এবং নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের বড় মেয়ের জামাতা ডা. বিজয় কুমার পাল বলেন, ৭ খুনের রহস্য উন্মোচনে গণমাধ্যমের ভূমিকাই ছিল মূখ্য। কারণ ঘাতকরা গ্রেফতারের পর তাদের স্বীকারোক্তিতে যা উল্লেখ করেছে তা আগেই গণমাধ্যম কর্মীরা তাদের অনুসন্ধানে তুলে এনেছিল। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে মামলাটি গতি পায়। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের কারণে মামলাটির রহস্য উন্মোচিত হয়েছিল। আমরা আশা করি আবার গণমাধ্যমের লেখালেখির কারণেই মামলাটি সুপ্রীমকোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে দ্রত নিষ্পত্তি হতে সহায়ক হবে। একই সঙ্গে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যেহেতু এত বড় ঘটনার সঙ্গে জড়িতরাও হাইপ্রোফাইল, তাই চূড়ান্ত রায়ের আগ পর্যন্ত তারা আশান্বিত হতে পারছেন না। কারণ শেষ পর্যায়ে যদি আসামীদের সাজা কমে যায় বা মওকুফ হয়ে যায়? তাই মামলারটি বিষয়ে তিনি আবারও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন যাতে দ্রুত সুপ্রীমকোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের কার্যক্রম শেষ হয়। তিনি আরও বলেন, এখন অনেক কথা কানে আসছে। কারণ মামলার দীর্ঘসূত্রিতা হলে মনে শঙ্কা জাগে। তিনি বলেন, ৭ খুনের ঘটনায় আইনজীবী চন্দন সরকারের পরিবারটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন চন্দন সরকার। তার তিন মেয়ে দু’জনের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়েটি বাবার মৃত্যু কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ওই ঘটনার পর মানসিক ভাবে সে এখনও বির্পযস্ত।
নিহত তাজুল ইসলামের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম রাজু বলেন, নি¤œ ও উচ্চ উভয় আদালতের রায়েই তারা সন্তুষ্ট। তবে রায় কার্যকরের আগে তারা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভার হতে পারছেন না। রায় কার্যকর হলে দেশ ও দেশের মানুষের জন্যই তা মঙ্গল বয়ে আনবে। কারণ এ রায় কার্যকরের মাধ্যমে দেশবাসীকে একটি ম্যাসেজ দেওয়া সম্ভব, সেটি হলো অপরাধী যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন, অপরাধ করে পার পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, ৭ খুনের ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের সবাই ছিলেন পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই সরকারের পক্ষ থেকে যদি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য কোন ব্যবস্থা করা হতো তাহলে পরিবারগুলো অন্তত ভাল থাকার চেষ্টা করতো।
নিহত সিরাজুল ইসলাম লিটনের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম বলেন, হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্সে যে রায় বহাল আছে সেটিই যেন অ্যাপিলেট ডিভিশনে বহাল রাখা হয়।নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেন, সরকারের সদ্বিচ্ছায় এই চাঞ্চল্যকর মামলাটি এই পর্যন্ত এসেছে। হাইকোর্টে যে রায় দেওয়া হয়েছে সেটিই যেন অ্যাপিলেট ডিভিশনে বহাল রাখা হয় এবং রায় যাতে দ্রততার সঙ্গে সরকারের এই মেয়াদেই যেন রায় কার্যকর করা হয়। যাতে এটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
নিহত স্বপনের গাড়ির চালক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শামসুন নাহার আক্তার নুপুর জানান, তিনি বলেন, ৭ খুনের ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার ২ মাস পর আমার একমাত্র সন্তান রোজারও ৫ বছর পূর্ণ হবে। একমাত্র সন্তনকে নিয়ে কষ্টে দিনযাপন করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. আইভী মাষ্টার রোলে ৬ হাজার টাকা বেতনে তাকে সিটি করপোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জ কার্যালয়ে একটি চাকুরি দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সন্তান নিয়ে তার সংসার চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। চাকুরীটি স্থায়ীকরণে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সেই সঙ্গে ৭ খুনের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী তাদের ডেকে নিয়ে সহযোগিতা করার যে আশ্বাস দিয়েছিলেন তা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সবিনয়ে অনুরোধ করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন