বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ইতোমধ্যেই দেশের বহু শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে অগণিত শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বিবিএস’র ‘তাঁত শুমারি ২০১৮’-এর প্রতিবেদন মতে, গত ২৮ বছরে ৯৬,৪১৫টি তাঁত ইউনিট বন্ধ হয়ে ৭,২৫,৬৫০ জন তাঁতি কমেছে। আর এক খবরে জানা গেছে, গত এক বছরে দেশের ৩০০টি বস্ত্র প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। লোকসানের অজুহাতে পাটকলগুলোর শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে মজুরি পাচ্ছে না। এর প্রতিবাদে লক্ষাধিক শ্রমিক সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছিল গত মাসে। নৌপথের শ্রমিকরাও নিয়োগপত্রসহ বেশকিছু ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য লাগাতর ধর্মঘট করেছিল একই সময়ে। এসব অতি সাম্প্রতিক ঘটনা। অন্যদিকে, দেশের শ্রমিক অঙ্গনে সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে, ১২-১৩শ’ গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে বিদেশি ক্রেতা সংগঠন, সরকার ও মালিক পক্ষের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির পরিদর্শনের কারণে। পরিদর্শনে যেসব কারখানায় নিরাপত্তা ও কর্ম-পরিবেশ ভালো নয় বলে পরিলক্ষীত হয়েছে, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাতে কয়েক লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের প্রচন্ড চাপে এসব হয়েছে। জানা মতে, সব গার্মেন্টে পরিদর্শন হলে আরও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তাতেও অনেক শ্রমিক চাকরি হারাবে। অপরদিকে, গার্মেন্ট খাতের সর্বশেষ নিম্নতম মজুরির অসংগতির প্রতিবাদে শ্রমিকরা আন্দোলন করেছিল এই বছরের প্রারম্ভে। সে কারণে ৮-৯ হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত ও ৬ হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এর আগে বেশিরভাগ ভারী শিল্প ও অসংখ্য ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। এই করুণ পরিস্থিতি থেকে সাংবাদিকরা পর্যন্ত মুক্ত নয়। দেশে অসংখ্য মিডিয়া আছে। তাতে কর্মরত আছে কয়েক হাজার সাংবাদিক ও সাধারণ কর্মী। কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু ছাড়া বেশিরভাগ মিডিয়ার সাংবাদিক ও কর্মীরা ঠিকমত বেতন পায় না। তাদের নিয়োগপত্রও নেই। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের অধিকাংশ শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নেই। যে যৎসামান্য প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আছে, তা মেকি তথা মালিকের অনুগতদের দিয়ে গঠিত। ফলে তার মাধ্যমে শ্রমিকের কোনো কল্যাণ হয় না। অথচ ইউরোপের অনেক দেশে পুলিশ ও আর্মিরা পর্যন্ত ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য। এ দেশের মালিকরা একতাবদ্ধ। তারা খুবই শক্তিশালী। ফলে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সমীহ করে চলে। উপরন্তু সংখ্যায় তারা নগণ্য হয়েও জাতীয় রাজনীতি ও পার্লামেন্ট তাদের দখলে। এমনকি সারা বিশ্বের ন্যায় দেশের বেশিরভাগ সম্পদের মালিকও তারা, যাদের সম্পদের বেশিরভাগই অবৈধভাবে অর্জিত। শ্রমিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও জাতীয় রাজনীতি, পার্লামেন্ট ও সম্পদে তেমন কোনো অংশীদারিত্ব নেই।
যা’হোক, দেশে যেসব শ্রমিক এখনও কর্মে আছে, তাদের মধ্যে সরকারি খাতের শ্রমিকরা কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে। কারণ, তাদের চাকরি, বেতন, পেনশন ইত্যাদির নিশ্চয়তা আছে। ৫ বছর পরপর নতুন মজুরি/পে স্কেল পায় তারা। বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের এসবের কিছুই নেই। তাদের চাকরি সকালে আছে তো বিকালে নেই। উপরন্তু বিদায়ের পর খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। কারণ, পেনশন, আনুতোষিক, কল্যাণ ফান্ড ইত্যাদি বলতে কিছুই নেই। সর্বোপরি বেশিরভাগ নারী শ্রমিক প্রসূতি ছুটি পায় না। ডে কেয়ার সেন্টারও নেই। বহু নারী শ্রমিক যৌন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয় কর্মস্থলে। এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে না, নিয়োগ পত্র না থাকায়। দেশে সরকারি লেবার কোর্ট আছে, তার রায় সহজে পালন করে না মালিকরা। এক গবেষণা প্রতিবেদন মতে, গার্মেন্টের ৮০% শ্রমিকের কোনো স্থায়ী নিয়োগ পত্র নেই। সর্বোপরি গত ১৬ এপ্রিল অ্যাকশন এইডের সংলাপে বক্তারা বলেছেন, ‘২০১০ সালের পর এ পর্যন্ত গার্মেন্ট খাতে তিন দফায় মজুরি বেড়েছে ২৮৭%। তা সত্তে¡ও এ খাতের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান বাড়েনি।’ অপরদিকে, দেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি এখনও প্রাধান্য পায়নি বলে অনেকের অভিমত। উপরন্তু এখনও বেশিরভাগ গার্মেন্টে বেতন অনিয়মিত। তাই বেতনের দাবিতে আন্দোলন করতে হয় তাদের। গত ২০ এপ্রিল ঢাকার বাড্ডা ও আশুলিয়ায় বকেয়া বেতন পরিশোধ ও ছাঁটাই-কৃত শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে গার্মেন্ট শ্রমিকরা। দেশের গার্মেন্টের শ্রমিকের ৮০% নারী। এই হচ্ছে দেশের প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিরাট অংশের খন্ড চিত্র। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চিত্র আরও করুণ। অথচ দেশের ৮০-৮৫% শ্রমিকই এই খাতের।
দেশে শ্রমিকদের জন্য ‘জাতীয় নিম্নতম মজুরি’ নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি খাতের শ্রমিকদের নিজস্ব মজুরি আছে, যা অনেক বৈষম্যমূলক। যেমন: গার্মেন্ট খাতের মজুরি, চা খাতের মজুরি, সরকারি খাতের শ্রমিকদের মজুরি ইত্যাদি। এসবের মধ্যে কোনো মিল নেই, পার্থক্য অনেক। সর্বোপরি বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন। জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের জরিপ ও অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থার প্রতিবেদন মতে, ‘তিন বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন শ্রমিকের মাসিক মজুরি বাংলাদেশে ১০৮, মিয়ানমারে ১৬২, ভারতে ২৬৫, পাকিস্তানে ১৮৭ ও কম্বোডিয়ায় ২০১ মার্কিন ডলার। আর প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকদেরও মাসিক বেতন বাংলাদেশে ২৮৭, ভারতে ৫৯১, পাকিস্তানে ৪৯২ ও মিয়ানমারে ৩৪৯ মার্কিন ডলার। কিছুদিন আগে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি খুব কম’। অথচ বর্ণিত দেশগুলোর চেয়ে এ দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি। বিশেষ করে শিক্ষা, আবাসন ও চিকিৎসা ব্যয় পার্শ্ববর্তী সব দেশের চেয়ে বেশি। তাই এসব ব্যয় নির্বাহ করতেই শ্রমিকদের আয়ের সিংহভাগ শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে, দেশের শ্রমিকরা প্রায় সময়ই নানা দুর্ঘটনায় নিপতিত হয়, যা নির্মাণ, জাহাজ ভাঙ্গা ও পরিবহন খাতে বেশি। কিন্তু কোনো খাতেরই আহত শ্রমিকদের চিকিৎসায় সহায়তা করে না কেউই। দেশে কয়েক লাখ নারী গৃহকর্মী আছে, যারা শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। তাদের মজুরিও নগণ্য। আর নির্যাতনের সীমা নেই। বলা হয়, অতি শ্রম, হার্ড ওয়ার্ক করলে শ্রমিকের জীবন আয়ু, কর্ম আয়ু ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। তবুও এ দেশের বিপুল শ্রমিক অতি শ্রম ও হার্ড ওয়ার্ক করতে বাধ্য হয়। মজুরি খুব কম হওয়ায় অনেক শ্রমিক ঘনঘন পেশা পরিবর্তন করে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয় না। সর্বত্রই একই অবস্থা।
তাদের এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য তারা নিজেরাও দায়ী কম নয়। কারণ, শ্রমিকদের বেশিরভাগই অসংগঠিত। যে সামান্য সংখ্যক সংগঠিত আছে, তারাও শক্তিশালী নয়। বহু ধারায় বিভক্ত তারা। প্রত্যেকেই পছন্দনীয় জাতীয় রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন। ফলে তারা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারে না। সর্বোপরি তারা নিজেদের মধ্যে কোন্দল, মারামারি, বদলী, চাকুরিচ্যুতি ইত্যাদিতে লিপ্ত। অর্থাৎ তারা নিজেরাই নিজেদের বড় শত্রু হয়েছে। রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি বেশি ঘটে সরকারি দলে। তাই যখন যে দল সরকারে থাকে, তখন সেই দলের শ্রমিকদের পাল্লা ভারী থাকে। এতে শ্রমিকদের তেমন কোনো লাভ হয় না। কিন্তু কতিপয় শ্রমিক নেতা নানা সুবিধা গ্রহণ করে ব্যাপক লাভবান হয়।
বলা আবশ্যক, যে নিজের ভাগ্য নিজে পরিবর্তন করে না, তার ভাগ্য কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। তাই বাংলাদেশের শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন তাদেরকেই করতে হবে। সে লক্ষ্যে সব ভেদাভেদ ভুলে সকলকে এক পতাকা-তলে সমবেত হতে হবে অরাজনৈতিকভাবে। সংগঠন পরিচালনা করতে হবে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে। অতঃপর সব অসংগঠিত শ্রমিকদের সেই পতাকা-তলে নিয়ে সব ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে। সর্বোপরি সব শ্রমিককে আধুনিক কর্মের উপযোগী করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, এ কাজটি এ দেশের মালিকরা করবে না। তাই শ্রমিকদেরই করতে হবে নিজেদের স্বার্থেই। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার রোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর তা করাও দেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই এর ব্যবহার শিখে তা প্রয়োগ করতে সক্ষম হওয়া দরকার। তাতে করে কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠান ও চাকরি রক্ষা হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন