হোসেন মাহমুদ : ঘর থেকে বেরোলেই ওদের দেখা যায়। কোথায় নেই ওরা? রাস্তাঘাটে, দোকানে-বাজারে, গার্মেন্টসে-কারখানায় তথা প্রায় সবখানেই আছে। এক-দু’জন নয় - অসংখ্য। পেটের দায়ে, সংসার চালাতে দরিদ্র বাবা-মাকে সাহায্য করতে ওরা শ্রমিকে পরিণত হয়েছে, শ্রম দিচ্ছে। ওরা প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকদের সমপরিমাণ কাজ করতে পারে না। বড়রা যে পরিমাণ মজুরি পায় ওরা তা পায় না। তাই ওদের আয়ও কম। কিন্তু ওরাও শ্রমিক, শিশুশ্রমিক।
জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু বলা হয়েছে। এ বয়স পর্যন্ত তাদের সময় তিনভাগে বিভক্ত। শিশুঃ ৫-৬ বছর পর্যন্ত; বালক বা বালিকাঃ ১২ বছর পর্যন্ত এবং কিশোর-কিশোরীঃ ১৭ বছর পর্যন্ত। বাংলাদেশে ১৮ বছর হলে সে ভোট দেয়ার অধিকার লাভ করে অর্থাৎ আইনের ভাষায় প্রাপ্তবয়স্ক হয়। এদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে ১৫ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে হিসেবে এ দেশে ১৪ বছরের কম বয়সী সকলেই শিশু। তবে ২০১৩ সালের শিশু আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকে শিশু বলে গণ্য করা হবে বলা হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, দেশ যখন উত্তরোত্তর উন্নয়নের দিকে এগিয়ে চলেছে, অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে, তখনো সারা দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমাদের শিশুদের এক বড় অংশই নানা ধরনের শ্রমে লিপ্ত। শ্রমিক বলতে সাধারণত বড়দের বোঝায়। অথচ বাস্তবে শুধু বড়রাই নয়, শিশুরাও শ্রমিক। কী কাজ করে না তারা? ফুল বিক্রি, পানি বিক্রি, চা-সিগারেট, মুড়ি-চিনাবাদাম বিক্রি, জুতা পালিশ, লঞ্চ-ফেরিতে কুলির কাজ, ডিম ও নানা ফল বিক্রি, গ্যারেজের কাজ, রুটি-বিস্কুট তৈরির কারখানায় কাজ, চা-বাগানে কাজ, হোটেল-দোকান-গার্মেন্টসে, নসিমন-করিমন-হিউম্যান হলারে ইত্যাদি অসংখ্য ক্ষেত্রে শিশুরা শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত। দারিদ্র্যের কারণে বাবা-মায়েরা শিশুদের একটু বয়স হলেই কোনো না কোনো কাজে লাগিয়ে দেন। তখন বহু শিশুই আর স্কুলে যেতে পারে না কিংবা গেলেও তাদের ছাড়িয়ে এনে কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। তাকে দিয়ে যে যৎসামান্য আয় আসে অভাবের সংসারে তাতে কিঞ্চিৎ উপকার হয়। কিন্তু যে মা-বাবা তাদের সন্তানকে শিক্ষা বঞ্চিত করে ক’টি টাকা আয়ের কাজে লাগান, চিরকালের জন্য সন্তানকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করেন, তারা তা নিরুপায় হয়েই করেন। প্রয়োজন ও অভাব তাদের সন্তানকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে বাধ্য করে। এক তথ্যে বলা হয়েছে, শিশুরা মাসে দেড় থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি পায়। এই টাকা বহু পরিবারেই এক বিরাট সহায় হিসেবে গণ্য হয়।
শিশু কারা তা বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এ নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। এতে বলা আছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নেয়া যাবে না। ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সীদের কাজে নেয়া যাবে, তবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেয়া যাবে না। ২০১৩ সালের শ্রম জরিপে দেখা যায়, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৯ লাখ। শিশুশ্রম জরিপে দেখা যায়, ১৩ লাখ শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত। তারা যেসব ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে জাহাজ ভাঙা, বিড়ি শিল্প, ব্যাটারি তৈরির কারখানা, লেদ কারখানা, কাচ বা গøাস ফ্যাক্টরি, ইট-পাথর ভাঙ্গা, মোটরগাড়ি মেরামত, নির্মাণকাজ ইত্যাদি। ইউনিসেফের এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে শিশুরা ৪৭টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত রয়েছে।
দেশের শিশুশ্রমিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মেয়ে শিশু। নিজ এলাকার গ্রামে যাওয়া-আসা, অফিসের লোক বা পরিচিত জন, দালাল বা সুবিধাভোগীদের মাধ্যমে গ্রামের মেয়ে শিশুরা শহরে কাজ করতে আসে। ভালো বেতন ও থাকা-খাওয়া-পরার প্রতিশ্রæতি দিয়ে তাদের আনা হয়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না। এক হিসেব অনুযায়ী, শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতেই প্রায় আড়াই লাখ মেয়ে শিশু বাসাবাড়িতে গৃহ পরিচারিকার কাজ করে। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সী। বাসায় কর্মরত মেয়েরা বেশিরভাগই অশিক্ষিত এবং সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। চাকরিদাতা বা মনিব কর্তৃক তারা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। এসব নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। প্রায় ক্ষেত্রেই যথাযথ সাক্ষ্য- প্রমাণ জোগাড়ের অভাব ও দারিদ্র্যের কারণে মৃতের পরিবার বিচার পায় না। আবার শুধু মেয়ে শিশুই নয়, ছেলে শিশুদেরও কয়েকটি ক্ষেত্রে মালিক বা তার লোকজনের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ অভাবের দায়ে কাজের ছেলে বা মেয়ে তথা শিশু শ্রমিক শ্রম বিক্রি করতে এসে মারাও যাচ্ছে। তাদের এ মৃত্যু রোধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
দারিদ্র্যই শিশুশ্রমের একমাত্র কারণ। এই দারিদ্র্যই শিশুদের স্কুলে যেতে দেয় না, শিক্ষিত হতে দেয় না, তাদের চোখ থেকে মুছে নেয় সকল স্বপ্ন। বাংলাদেশে অনেক শিশু আছে যারা প্রতিদিন দু’মুঠো খেতে পায় না। তারা দু’টি ভাত খেতে পাবে, ন্যূনতম পোশাক পরতে পারবে, এ আশায় মা-বাবারা তাদের কাজে লাগিয়ে দেয়। কিন্তু শিশুশ্রমিকরা সাধারণত যে পরিশ্রম করে তার উপযুক্ত মজুরি পায় না। অন্যদিকে শহরে যে সব শিশু বাস করে তাদের এক বিরাট অংশ বস্তিবাসী। নোংরা, কদর্য পরিবেশে তারা বেড়ে উঠছে। অনেক শিশুকে ফুটপাতে রাত কাটাতে দেখা যায়। ঝড়-বৃষ্টি-শীতে তারা প্রচন্ড দুর্ভোগের শিকার হয়। থাকার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান তাদের জোটে না। অসুস্থ হলে চিকিৎসা সেবা পায় না তারা। এভাবে নানা ধরনের প্রতিক‚লতার মধ্যে তাদেরকে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। ফলে অনেকের জীবন থেকে সুস্থ অনুভূতিই হারিয়ে যায়। তারা নানাবিধ বেআইনি কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। অনেকে জড়িয়ে পড়ছে মাদক বিক্রির ভয়ংকর কাজে। হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত।
বাংলাদেশের শিশু শ্রমিকদের বেশিরভাগই ভালো অবস্থায় নেই। সবাই জানে যে শিশু শ্রমিকদের দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হয়। তাদের মৌখিক আইন মেনে কাজ করতে হয়। তাদের শ্রম নেয়া হয়, কিন্তু তাদের কল্যাণের দিকে কোনো নজর দেয়া হয় না। তারা যে কঠোর পরিশ্রম করে তার উপযুক্ত বেতন পায় না। সাপ্তাহিক বা বাৎসরিক ছুটি নেই তাদের। তাদের কাজ অনুপাতে কম মজুরি দেয়া হয়। কাজ করতে হয় নানা ধরনের নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। তারা কাজের মাঝে ঠিকমতো বিরতি পায় না। তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই, ঝুঁকির মাঝে কাজ করতে হয় কিন্তু কোনো ঝুঁকি ভাতা পায় না। তারা কাজ করে কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা নেই।
জাতিসংঘের শিশু সনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন। এতে বলা হয়েছে, শিশুর বেঁচে থাকা তাদের জন্মগত অধিকার। সে অধিকারের মর্যাদা দিতে হবে, সে অধিকার রক্ষা করতে হবে। এরই সাথে শিশুর জন্য নিচের অধিকারগুলোর কথাও মনে রাখতে হবে সবাইকে। ১. স্নেহ, ভালবাসা ও সমবেদনা পাওয়ার অধিকার, ২. পুষ্টিকর খাদ্য ও চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার অধিকার, ৩. অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ, ৪. খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদের পূর্ণ সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ৫. একটি নাম ও নাগরিকত্ব, ৬. পঙ্গু শিশুদের বিশেষ যত্ম ও সেবা শুশ্রুষা পাওয়ার অধিকার, ৭. দুর্যোগের সময় সবার আগে ত্রাণ পাওয়ার অধিকার, ৮. সমাজের কাজে লাগার উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠার এবং ব্যক্তি সামর্থ্য অর্থাৎ সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ৯. শান্তি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ পাওয়ার অধিকার, ১০. এসব অধিকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে বিশ্বের সব শিশুর ভোগের অধিকার থাকবে।
বাংলাদেশ শিশু আইন ২০১৩-তে বলা হয়েছে ঃ কোন ব্যক্তি যদি তার দায়িত্বে থাকা কোন শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন বা অবহেলা করেন তাহলে ঐ ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদন্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড দন্ডত হবেন। মিছিলে, সমাবেশে শিশুদের ব্যবহার করা দন্ডনীয় অপরাধ। শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তি বা যৌনপল্লীতে ব্যবহার করা হলে অথবা শিশুদের দিয়ে কোন প্রকার মাদক বা আগ্নেয়াস্ত্র বা অবৈধ কিছু বহন করানো হলে দায়ী ব্যক্তিকে সাজা দেয়া হবে। ইচ্ছে করলেই কোন ধরনের মামলায় নয় বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনোভাবেই গ্রেফতার করা যাবে না। নয় বছরের বেশি কোনো শিশুকে গ্রেফতার বা আটক করা হলে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি পরানো যাবে না। এছাড়া যে কোনো মামলায় শিশুকে জামিন দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। শিশু সংক্রান্ত মামলা দেখাশোনা করবেন নিয়োগ পাওয়া প্রবেশন কর্মকর্তা। আর শিশুর বিচার হবে বিশেষ শিশু আদালতে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, আইনের কথা লেখা থাকে বইতে, বাস্তবে তার প্রয়োগ হয় কতটা? নানা কারণে, স্বার্থ হাসিলের জন্য ও কুচক্রীদের চক্রান্তে অন্য আরো অনেক আইনের মত শিশু আইন বাস্তবায়নেরও উদ্যোগ তেমন দেখা যায় না। তাই কয়েক বছর আগে শিশু আইন পাশ হলেও শিশুরা বা শিশু-শ্রমিকরা তার সুফল পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে দেশের মানবাধিকার সংগঠন, বিভিন্ন শিশু সংগঠন ও সংস্থা এবং সংবাদ মাধ্যম ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারে।
১৪ বছরের কম বয়সী ছেলে বা মেয়েকে গৃহকাজের শ্রমে নিয়োগ না করতে হাইকোর্টের রায় থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রায়ই সংবাদপেেত্র প্রকাশিত শিশু নির্যাতনের খবর থেকে এর প্রমাণ মেলে। কিন্তু শিশু শ্রমিকদের নির্যাতনের সব খবর প্রকাশ্যে আসে না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের উপর নির্যাতনের ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মহান মে দিবস। বিশে^র সর্বত্র শ্রমজীবী সমাজে এ দিনটি উদযাপনের ¯েøাগান হচ্ছে - দুনিয়ার মজদুর এক হও। মজদুর অর্থ শ্রমিক। আমাদের শিশু শ্রমিকদের প্রায় কেউই এ দিনটির কথা জানে না। তাদের তা জানানোরও কেউ নেই। বাংলাদেশে শ্রমিকদের একাধিক সংগঠন থাকলেও শিশু শ্রমিকদের কোনো সংগঠন নেই। শিশু শ্রমই যেখানে আইনত অনুমোদিত নয় সেখানে তাদের সংগঠন গড়াও বৈধ নয়। তাছাড়া শিশুদের পক্ষে সাংগঠনিক কাজ করাও সম্ভব নয়। যাহোক, শিশু শ্রমিকরাও শিশু। শ্রমিক শিশুদেরও রয়েছে অন্য শিশুদের মত সমান অধিকার। এক্ষেত্রে যা করণীয় দেশের তা হল সকল শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য অনুকূল ক্ষেত্র ও পরিবেশ রচনা করতে হবে। যারা দরিদ্র শিশু, তাদেরকেও রাষ্ট্র ও সমাজের ছায়াতলে যথাযথ প্রযতেœ লালন করতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে এখনো তেমন উন্নত নয় সেহেতু প্রায় সকল দরিদ্র পরিবারেই শিশুর ভাগ্যে আঁধারের কালো ছায়া নেমে আসে। তাদের জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
আমাদের শিশুদের শ্রমিকে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে। শিশুশ্রমের অভিশাপ থেকে তাদের মুক্তি দিতে হবে। কোনো সভ্য দেশেই শিশুশ্রম গ্রহণযোগ্য নয়। শিশুশ্রম বন্ধের আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ করতে হবে। আমরা যদি সভ্য মানুষ হওয়ার দাবি করি তাহলে আমাদের দেশে শিশুশ্রম থাকা উচিত নয়। সরকারকে এ ব্যাপারে যথাযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে শিশুশ্রম বিলুপ্ত হোক- এই হোক এবার ২০১৭ সালের মহান মে দিবসের অঙ্গীকার।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন