বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে পহেলা মে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনটির ইতিহাস আধুনিক শিল্প-সভ্যতা বিকাশের সূচনা পর্বের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। তখন শ্রমিকদের অধিকার বলতে তেমন কিছু ছিল না। তাদের ন্যায়সঙ্গত বেতনের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বলতেও কিছু ছিল না। অত্যন্ত স্বল্প মজুরিতে তাদের হাড়ভাঙ্গা শ্রম দিতে হতো। কর্ম-সময়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। কারখানা মালিকেরা যতক্ষণ ইচ্ছা তাদের খাটিয়ে নিতো। দৈনিক ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের কাজ করতে হতো। প্রাচীন মিশরের শ্রমদাসদের চেয়েও তাদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। আজকের বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের এই ছিল হাল। অন্যান্য দেশে শ্রমিকদের অবস্থাও এর চেয়ে ভালো ছিল না।
এই পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকরা প্রথমে কর্মঘণ্টা ১০ ঘণ্টা করার দাবিতে সোচ্চার হয়। এই দাবিতে ১৮০০ সালের শুরু থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত সেখানকার শ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় ধর্মঘট চালিয়ে যায়। ১৮২৭ সালের প্রথম দিকে শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। কর্মঘণ্টার আন্দোলনে কিছুটা সাফল্যও আসে। গৃহযুদ্ধের পর শ্রমিক আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন শ্রমিকদের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল। তিনি চাইতেন শ্রমিকরা ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করুক। এক ভাষণে তার এই মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেন, যা কিছু শ্রমিকদের ক্ষতি করবে তা আমেরিকার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে বিবেচিত হবে। কেউ যদি বলে আমেরিকাকে ভালোবাসে কিন্তু শ্রমিকদের ঘৃণা করে তাহলে সে মিথ্যাবাদী। কেউ যদি বলে সে আমেরিকাকে বিশ্বাস করে কিন্তু শ্রমিকদের ভয় পায় তাহলে সে নির্বোধ। তিনি শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার সমর্থন করেন।
বিভিন্ন দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এ ধরনের অভিমত ও সমর্থন শ্রমিক আন্দোলনকে উত্তরোত্তর বেগবান করে তোলে। এতে মালিক-শ্রেণি বিচলিত ও শংকিত হয়ে পড়ে। বেতন ঠকিয়ে, অধিক সময় ধরে কাজ করিয়ে উচ্চ মুনাফা অর্জনের যে সিঁড়ি তারা তৈরি করেছিল তা ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে পড়ে। এমতাবস্থায়, তারা কায়েমি স্বার্থ সংরক্ষণে মরিয়া হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের উপর জুলুম-পীড়ন বেড়ে যায়। একই সঙ্গে মালিকরা শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রমিকদের সংহতি বিনষ্ট করার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা প্রলোভন দিয়ে, বাড়তি সুবিধা দিয়ে কিছু শ্রমিককে তাদের পক্ষে নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ, বিবাদ সৃষ্টি করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। এতে কোথাও কোথাও সাফল্য অর্জন করে। সে সময়ের একজন কারখানা মালিকের উক্তি এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন, শ্রমিক শ্রেণির অর্ধেকটা আমি ভাড়া করতে পারি বাকি অর্ধেককে খুন করার জন্য।
অবশ্য মালিকদের এই ষড়যন্ত্র ও নাশকতামূলক তৎপরতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ও সংবাদপত্রের ব্যাপক বৈরিতা সত্তে¡ও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন চলতেই থাকে। চলমান আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে ১১ হাজারেরও বেশি কারখানার শ্রমিক ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং ওই দিন সফলভাবে ধর্মঘট হয়। ৩ মে পুলিশ গুলি চালায় এবং চারজন শ্রমিক নিহত হয়। আহত হয় আরো অনেকে। ৪ মে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে আয়োজন করা হয় শ্রমিক সমাবেশের। এই সমাবেশেও পুলিশ গুলি চালিয়ে কয়েক জনকে হত্যা করে। কিছুসংখ্যক শ্রমিক আহত হয়। এই সমাবেশে পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে কয়েকজন পুলিশও হতাহত হয়। এ নিয়ে মামলা হয় এবং কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়, যা পরে কার্যকর হয়।
ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও রক্তদান কখনো ব্যর্থ হয় না। এই পর্যায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের মূল দাবি ছিল, দৈনিক কর্মকাল ৮ ঘণ্টা করা। এই আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় পরে তা অর্জিত হয়। এই অর্জন এক ঐতিহাসিক অর্জন, যা এখনো বিশ্বের দেশে দেশে বহাল রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সোস্যালিস্ট লেবার ইন্টারন্যাশনালের সম্মেলনের এক প্রস্তাবে প্রতি বছর পহেলা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই থেকে প্রতি বছর সারা বিশ্বে পহেলা মে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মে দিবস শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন-সংগ্রামের মাইলফলক। এদিন শ্রমিকদের বিজয়ের দিন, সংহতির দিন, আন্দোলন-সংগ্রামে উদীপ্ত ও অনুপ্রাণিত হওয়ার দিন।
একথা অস্বীকার করা যাবে না, শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে কমিউনিস্টদের কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংযুক্ত হওয়ায় শ্রমিক আন্দোলন পরবর্তী পর্যায়ে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান, বেতনভাতা বৃদ্ধি, কল্যাণমূলক সুবিধাদি দান, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, কর্মপরিবেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় আইন-বিধি প্রণয়নসহ নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়। কিন্তু ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, ‘শ্রমিকরাজ কায়েম করো’ ইত্যাদি শ্লোগান বাস্তবায়ন করতে কমিউনিস্ট দেশগুলো শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। দেখা যায়, ওই সব দেশে শ্রমিকরা অন্যভাবে শোষিত ও বঞ্চিত হচ্ছে। উৎপাদনযন্ত্রের মতোই তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা কমিউনিজনের পতনের একটি বড় কারণ। শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক সমর্থন কমে যাওয়ায় এবং শ্রমিক কল্যাণে কমিউনিজমের ব্যর্থতায় শ্রমিক আন্দোলনের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, শ্রমিক আন্দোলন যদি তার নিজস্ব চরিত্র নিয়ে অব্যাহত থাকতো তাহলে শ্রমিকরা এখনকার চেয়ে হয়তো আরো বেশি সুবিধা, নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা লাভ করতে পারতো। বিশ্বের সর্বত্রই এখন শ্রমিকরা অবনত অবস্থায় রয়েছে। তাদের মধ্যে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংহতি নেই বললেই চলে। সাম্রাজ্যবাদের বহুল আলোচিত বিশ্বায়ন তত্তে¡র বাস্তবায়ন শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনা ও অধিকারহীনতাকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। লগ্নি-পুঁজির দাপট এবং সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে পুুঁজিপতিদের স্বার্থ, সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ নিশ্চিত সংরক্ষণ লাভ করছে। এখানে শ্রমিক স্বার্থ উপেক্ষিত। তারা ভয়ানকভাবে পরিস্থিতির শিকার, বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত।
তথাকথিত বিশ্বায়ন ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ও বৈষম্য বাড়াচ্ছে। ধনী দেশগুলো আরো ধনী ও স্ফীত হচ্ছে, দরিদ্র দেশগুলো আরো দরিদ্র ও কৃশ হয়ে পড়ছে। বর্তমানে অর্ধশতাধিক দেশ শোচনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়ে পড়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। এসব দেশে বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান বাড়া তো দূরের কথা, দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে পড়তে দেখা যাচ্ছে। শ্রমিক শ্রেণির নিরাপত্তা, মানবিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা যথাযোগ্য গ্রাহ্যতা পাচ্ছে না। বঞ্চনা, দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা, অনিশ্চয়তা তাদের অস্তিত্বের অনিবার্য ‘বান্ধবে’ পরিণত হয়েছে।
আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিল্পক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তন হয়। ঢালাওভাবে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়। রাজনৈতিক ও শ্রমিক নেতারা শিল্পকারখানার দন্ডমুন্ডের কর্তা বনে যান। প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় একটি লুটপাটকারী চক্র গড়ে ওঠে। কয়েক বছরের মধ্যে বেপরোয়া দুর্নীতি, লুটপাট ও উৎপাদনহীনতার কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রথম চোটটি এসে লাগে শ্রমিকদের ওপর। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার ও কর্মহীন হয়ে পড়ে। যারা কোনোভাবে টিকে থাকে তাদের বেতনভাতা সুবিধাদি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। সুপ্রতিষ্ঠিত পাট, চিনি, বস্ত্রসহ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় শ্রমিক-কর্মচারীদের সুদিন অনেক আগেই অন্তর্হীন হয়েছে। এখনো তার জের চলছে। পাকিস্তান আমলের যেসব শিল্পকারখানা এখনো অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে তাদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। উৎপাদন নেই বললেই চলে, ফলে ব্যবসাও নেই। শ্রমিকদের অবস্থা বর্ণনাতীত। তারা মাসের পর মাস বেতন পায় না। দাবি আদায়ে সংঘটিত আন্দোলন করার ক্ষমতাও শ্রমিকদের নেই। তাদের কথা সরকার ভাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোও ভাবতে চায় না।
আশির দশকে শিল্পের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে গার্মেন্ট শিল্পের হাত ধরে। শত শত গার্মেন্টস কারখানা গড়ে ওঠে। এসব কারখানার শ্রমিক হিসেবে অগ্রাধিকার পায় নারীরা। এই শিল্পে এখন সরাসরি কর্মরত আছে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। সব মিলে এই সেক্টর অন্তত এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই বিপুল সম্ভাবনাময় এবং অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব অবদান যুক্তকারী শিল্প খাতটিও এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। ইতোমধ্যে বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার শ্রমিক। নানা সমস্যা ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার এই শিল্প খাতটি।
বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ আমাদের দেশে তেমন নেই বললেই চলে। কৃষিতে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োজিত। সেখানে কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগ নাস্তি। আত্মকর্মসংস্থানের সুবাধে কিছু নতুন কর্মসংস্থান হতে পারে কিন্তু এক্ষেত্রেও অভাব রয়েছে সহজ শর্তে, স্বল্পসুদে ঋণ পাওয়ার সমস্যা ও কার্যকর পৃষ্ঠপোষকতার। শিল্প বিনিয়োগ কর্মসংস্থানের যে সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে বিনিয়োগ বন্ধ্যাত্বের কারণে সেটাও সম্ভবপর হচ্ছে না। শিল্প হলে, উৎপাদন বাড়লে রফতানি ও রফতানি আয় বৃদ্ধি পেলে শ্রমিকদের বেতনভাতা, সুযোগ-সুবিধা ও অন্যান্য কল্যাণ যতটা সম্ভব নিশ্চিত করা যেতে পারে। কিন্তু এই সম্ভাবনাও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ তরুণ জনশক্তির দেশ। এর কর্মক্ষম জনসংখ্যার বেশিরভাগই তরুণ। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে বাংলাদেশ দ্রæত উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে। কথায় বলে, শ্রমিকের হাত উন্নয়নের হাতিয়ার। এই হাতিয়ারকে শক্তিশালী, নিরাপদ ও সক্রিয় রাখার মাধ্যমেই কাক্সিক্ষত উন্নয়ন নিশ্চিত হতে পারে। এমতাবস্থায় বেকারদের হাত কর্ম ও উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন