মানুষের মনের ভিতরে ভালো-মন্দ লুকিয়ে থাকে। মনের ভিতরে থাকা ভালো-মন্দ একে অপরের সাথে সব সময় যুদ্ধ করতে থাকে। এছাড়া দুনিয়ার মোহ মায়ায় আচ্ছন্ন লোভী আত্মা গুলো, ভালোকে দমন করার চেষ্টায় সর্বদা সক্রিয় থাকে। আর মানুষের মন অধিকাংশ সময় মন্দ কাজের দিকেই ঝুঁকে থাকে। যার ফলে এতো ইবাদত বন্দেগী করার পরও মানুষ ¯্রষ্টার নূর দর্শন করা থেকে বঞ্চিত হয়। রোজা পালনের মাধ্যমে মানুষ তার নিজের ভিতরের মন্দকে পরাজিত করে। মানুষের তার ভিতরের মন্দকে পরাজিত করার শক্তিশালী কৌশল হিসেবে আল্লাহ তায়ালা যূগে যূগে সকল নবী-রাসূলের উম্মতের উপর রোজা ফরজ করেছেন। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছে; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা: ১৮৩)।
হযরত আদম (আ:) আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতেন। যাকে আইয়্যামে বীজের রোজা বলা হয়। হযরত নূহ (আ:) সর্বদাই রোজা রাখতেন। হযরত দাউদ (আ:) এর উম্মতের উপর একদিন পর একদিন রোজা ফরজ ছিলো। হযরত মূসা (আ:) এর উম্মতের উপর আশুরার দিন এবং সপ্তাহের শনিবার রোজা ফরজ ছিলো। হযরত ঈসা (আ:) এর উম্মতের উপর একদিন রোজা রেখে, দুই দিন বিরতি দিয়ে পুণরায় রোজা রাখার বিধান ছিলো। হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর শ্রেষ্টত্বের মর্যাদার খাতিরে এক নাগারে ত্রিশ দিন রোজা পালনের বিধান ফরজ করা হয়েছে।
রোজার মাসেই আসমানী কিতাব গুলো নাজিল হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম (আ:) এর উপর প্রথম রোজায় সহীফা নাজিল হয়েছে। হযরত মূসা (আ:) এর উপর তের রোজায় তাওরাত কিতাব নাযিল হয়েছে । হযরত দাউদ (আ:) এর উপর বারো রোজায় যবূর কিতাব নাজিল হয়েছে । হযরত ঈসা (আ:) এর উপর সাতাশ রোজায় ইঞ্জিল কিতাব নাজিল হয়েছে। হযরত মোহাম্মদ (সা:) এর উপর সাতাশ রোজায় লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে কোরআন শরীফ নাজিল হয়েছে।
তাওরাত কিতাবে রোজাকে হাত্ব বলা হয়েছে। হাত্ব শব্দের অর্থ গোনাহ নষ্ট হয়ে যাওয়া। ইনঞ্জিল কিতাবে রোজাকে ত্বাব বলা হয়েছে। ত্বাব শব্দের অর্থ পবিত্র হওয়া। যবূর কিতাবে রোজাকে কোরবাত বলা হয়েছে। কোরবাত শব্দের অর্থ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। কোরআন মাজীদে রোজাকে সিয়াম বলা হয়েছে। যার অর্থ আত্মশুদ্ধি লাভ করা।
রোজা মানব আত্মার সকল গোনাহ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। রোজার রহমত, বরকত ও মাগফেরাত মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘যে ইহাকে (নফস) বিশুদ্ধ করিয়াছে সেই সফলকাম হয়েছে এবং যে ইহাকে কলুষিত করিয়াছে সেই অকৃতকার্য হইয়াছে।’(সূরা শামস: ৯-১০)। আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার উত্তম কর্মই হলো রোজা পালন করা। যে মানুষ রোজা পালন করে। তার আত্মা বিশুদ্ধ হয়ে যায়। পরিশুদ্ধ আত্মার মানুষ গুলো দুনিয়া-আখেরাত উভয় জগতে সফলকাম। সকল প্রকার মন্দ কাজ বিরত বা সংযত থাকার নামই হলো রোজা। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তবে যে সংযত ও সংশোধিত হয় পরে তাহাদের জন্য ভয় নাই এবং তাহারা দু:খিত হবে না।’ (সূরা আরাফ: ৩৫)।
মানব দেহের ভিতরের দশটি লতিফা রয়েছে। যেমন- লতিফা নফস, ক্বালব, রূহ, সির, খফি, আখফা, খাক, বাত, আব ও আতশ। রোজা পালনের ফলে, মানব দেহে থাকা লতিফা গুলো পরিশুদ্ধ হয়ে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্যে জান্নাতের দিকে ধাবিত হয়। রোজার মাসে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এমন একটি রজনী উপহার দিয়েছেন, এ রজনীর ইবাদতের মর্যাদা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ রজনীকে লাইলাতুল কদর বলা হয়। হযরত আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসূল (সা:) এরশাদ করেছেন, রমজান মাস আগমনের সাথে সাথে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানকে শিকলাবদ্ধ করা হয়। (মুসলিম শরীফ, খ.২, পৃষ্ঠা ৭৫৮)। হযরত সালমান ফারসী (রা:) হতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসূল (সা:) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজান মাসে কোন সৎ কাজের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য কামনা করে, সে যেন অন্য মাসে কোন ফরজ কাজ আদায় করার ন্যায় কাজ করল আর যে ব্যক্তি কোন ফরজ কাজ আদায় করে সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব পেল।’ (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান, খ.৫, পৃষ্ঠা২২৩)। রোজা পালন করলে শুধু সাওয়াবই হয় না। রোজা মানব আত্মায় ঝর্ণার ন্যায় নূর প্রবাহিত হয়। রোজা পালনে মানুষের জ্ঞান বিজ্ঞান ও চিন্তা শক্তি বৃদ্ধি পায়। রোজা মানব আত্মার তেজ শক্তি বৃদ্ধি করে। আল্লাহ তায়ালা রোজায় সকলের আত্মায় নূর দান করুক। আমীন।
লেখক: ইসলামিক চিন্তাবিদ ও গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন