আফতাব চৌধুরী
একটি দিনের শুরু যেমন ভোর দিয়ে, তেমনি কবি নজরুলকে জানার শুরু ‘প্রভাতী’ দিয়ে। ‘প্রভাতী’র সেই- ‘ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠ রে!’ (প্রভাতী/ঝিঙে ফুল) কালো রাত্রির অবসানে ভোরের আলো ফুটতেই ঘুমন্ত শিশুদের ডেকে চললেন নজরুল। নজরুলের সেই ডাকে, সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে জেগে ওঠে তাঁকে জানার আগ্রহ পেয়ে বসে। ছেলেবেলায় নজরুল ছিলেন দুরন্ত, হাস্যমধুর এবং আনন্দপূর্ণ। তাঁর এইসব স্বভাববৈচিত্র্যের জন্য সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতেন। নিতান্ত অল্প বয়সেই ঘর ছেড়ে লেটো দলে যোগ দিলেন এবং লেটো দলের গান রচনা করে সুনাম অর্জন করেন। তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই হয়ে গিয়েছিল যে, এক সময় তাঁকে ছাড়া যেন আর চলত না লেটো দলের। এ প্রসঙ্গে খান মঈনুদ্দিন জানিয়েছেন- ‘নজরুল এদের জন্য পালাগান লিখে দিতেন। পরে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, নজরুলের গান ছাড়া আর আসর জমত না। এতে কোনো কোনো সময় নজরুল অভিনয়েও অংশগ্রহণ করতেন।’
এভাবে ছেলেবেলা থেকেই তাঁর অন্তরস্থিত রচনাশক্তির পরিচয় প্রকাশ পেতে থাকে। ছাত্র হিসাবে নজরুল মেধাবী ছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত নজরুলকে রোজগারের চিন্তায় রুটির দোকানে কাজ নিতে হয়, কাজ নিতে হয় বাবুর্চির। তাঁর জীবনে যখন আসানসোলের তদানীন্তন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের দয়ায় বিদ্যালাভের সুযোগ আরেকবার আসে, তখন তিনি ডবল প্রমোশন পেয়ে সপ্তম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে ওঠেন। তাছাড়া অন্যান্য অনেক সুযোগ-সুবিধাও পেয়েছিলেন। বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হয়ে দশম শ্রেণিতে ওঠেন কিন্তু মনের অন্য এক টান বড় হয়ে ওঠায় প্রবেশিকা পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি। কী সেই টান! কোন তাগিদে নজরুলের মতো মেধাবী ছাত্রকে আনমনা করে দিয়েছিল? যুদ্ধ, স্বদেশপ্রীতি, স্বাধীনতা, আত্মপরিচয় ইত্যাদির টানে তিনি ১৯১৭ সালে সেনা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ঈদ সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে নজরুল বলেন-
‘ক্লাসে ছিলাম আমি ফার্স্ট বয়। হেডমাস্টারের বড় আশা ছিল আমি স্কুলের গৌরব বাড়াব, কিন্তু এ সময় এল ইউরোপের মহাযুদ্ধ। একদিন দেখলাম এদেশ থেকে পল্টন যাচ্ছে যুদ্ধে। আমিও যোগ দিলাম এই পল্টন দলে।’ (নজরুল রচনা সম্ভার, ১৯৬৫ পৃঃ ২২৭) তিনি ৪৯ নম্বর বাঙালি রেজিমেন্টের অন্তর্গত সৈনিক হিসাবে দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছিলেন এবং হাবিলদারের পদে উন্নীত হয়েছিলেন। সৈনিক জীবনে তিনি প্রধানত নৌশহরা ও করাচিতে ছিলেন। ভাবীদিনের খ্যাতিমান কবিকে এভাবে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের আরও বহু পথ পরিক্রমা করতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আহমদ রফিক বলেন- ‘নজরুল ঘর-পালানো, ইস্কুল পালানো ছেলে। দারিদ্র্যের অভিশাপ মাথায় নিয়ে তাঁর যাত্রা। সেই শৈশব-কৈশোর থেকে। সে-ইতিহাস সবার জানা। বর্ধমান থেকে নানাপথে বাঁক ফিরে, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল শুঙ্ক রাঢ়ভূমি থেকে সজল, পললভূমি পূর্ববঙ্গে তাঁর যাওয়া-আসা জীবনের পাথুরে বাস্তবতার টানে। জীবন তখন সহজ নয়, সহজ স্ফূর্তির অনুকূল নয়। সেখানে স্বস্তি নেই, সুস্থিরতার অবকাশ শেষ পর্যন্ত তাই পল্টন যাত্রা। কিন্তু অস্বচ্ছন্দতা তাঁকে কখনো ছেড়ে যায়নি।
লেটো দলের জন্য গান রচনার মধ্য দিয়ে যে নজরুলের পথচলা শুরু হয়েছিল পরবর্তীতে তা নানাভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে শাখা-প্রশাখায়, ফুলে-ফলে, বর্ণে-ভাবে, রূপে-রসে সজ্জিত হয়ে সাহিত্য আঙিনায় বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছিল। ছাত্রজীবনে রচিত অনেক কবিতার মধ্যে ‘চড়ুই পাখির ছানা’ নামে কবিতাটি স্বতন্ত্রতা লাভ করেছে। উপেক্ষিত একটি চড়ুই পাখির ছানাকে কেন্দ্র করে তাঁর মনে যে গভীর সহানুভূতির প্রকাশ ঘটে, পরবর্তীকালে তা তাঁর সাহিত্য জীবনকে ঋদ্ধ করেছে। উপেক্ষিত, লাঞ্ছিত, পরাধীন জনগণের ব্যথা-বেদনা-আর্তিকে তাই তিনি নিজ অন্তরে অনুভব-উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। একের পর এক তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে গল্প-কবিতা ইত্যাদি। করাচিতে অবস্থানকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’, ‘মুক্তি’, ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘আশায়’ প্রভৃতি প্রকাশিত হতে থাকে। ‘সওগাত’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘প্রবাসী’ ইত্যাদিতে তাঁর বিভিন্ন লেখা প্রকাশ হতে থাকে। একসময় ৪৯নং বাঙালি রেজিমেন্ট ভেঙে যাওয়ায় নজরুল ১৯২০ সালে কলকাতায় চলে আসেন এবং সাহিত্যজীবনে বিশেষভাবে পদার্পণ করেন। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় তাঁর অনেক রচনার সঙ্গে বিশেষ রচনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিও প্রকাশ হয়। যদিও বলা হয়েছে- ‘১৩২৮ সালের কার্তিক সংখ্যার ‘মোসলেম ভারত’-এ নজরুলের ‘বিদ্রোহী ও ‘কামালপাশা’ কবিতা দুইটি মুদ্রিত হবার কিছুকাল আগে সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে একটা আলোড়ন পড়ে যায় ও এই একটি মাত্র কবিতাই বাংলা সাহিত্যে কবি রূপে তাঁকে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়ে দেয়।’ অতঃপর ১৩২৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ কাব্য। এ কাব্যের কবিতাগুলো কবিতা ১৯২০ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে রচিত। এ কাব্যের কতকগুলো কবিতা অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত। তদানীন্তন রাজশক্তির নিপীড়নে জর্জরিত ভারতবাসীর ক্ষোভ ও বেদনা এই অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ‘অগ্নিবীণা’র মধ্য দিয়ে কবি তৎকালীন ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বিপ্লবী তরুণদের হৃদয়ে নজরুলের এই কাব্য উৎসাহ-উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল অনেক ক্ষেত্রে। আর বাংলা কাব্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়-
‘বাঙলা কাব্যে নবযুগের প্রকৃত সূচনা হল নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ (প্রথম প্রকাশ-কার্তিক ১৩২৯ সাল ১৯২২) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই।’ কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে নজরুল যেন নিজেকে সম্পূর্ণ তুলে ধরতে পারছিলেন না, তাই তিনি একটি পত্রিকা সম্পাদনা করার সিদ্ধান্ত নেন। সপ্তাহে দু’বার করে তিনি ‘ধূমকেতু’ নামক পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁদের শুভেচ্ছা বার্তা ও আশীর্বাদী প্রেরণ করেছিলেন ধূমকেতু সম্পাদক নজরুলকে। নজরুলের ধূমকেতু অসাধারণ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল কিন্তু পত্রিকাটি তদানীন্তন সরকারের প্রীতি উৎপাদন করতে পারেনি। কেননা, নজরুল স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন- ‘দেশের যারা শক্র, দেশের যা কিছু মিথ্যা, ভন্ডামী, মেকি তা সব দূর করতে ‘ধূমকেতু’ হবে আগুনের সম্মার্জনী।’ তাই ১৯২২ সালে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র জন্য তিনি রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ১৯২৩ সালে এক বছরের জন্য সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হন। জেলে বসেও চলতে থাকে তাঁর কবিতা-গান রচনা। কাব্যসৃষ্টিতে তিনি যে উল্লসিত হতেন জেলে বসে লেখা ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাস’ কবিতায় তার প্রমাণ রয়েছে। তাছাড়া ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণী মনসা’, ‘জিঞ্জির’, ‘সন্ধ্যা’, ‘প্রলয়-শিখা’ প্রভৃতি কাব্যে দেশপ্রেম, রাজনীতি সমাজনীতি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে তাঁর বিদ্রোহী কবি রূপটি সবিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।
প্রসঙ্গত বলা যায়, সবরকম সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ছিল যাঁর মন, নানারকম বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে জেনেও যিনি হৃদয়ে দেশপ্রেমের দীপ্ত আলো জ্বালিয়ে কোনও কিছু পরোয়া না করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন, সেই বীর সৈনিক ও দেশপ্রেমিক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নজরুলের ‘সর্বহারা’ গ্রন্থের ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কোরাসের-‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!’ শুনে অভিভূত হয়ে যান। তিনি ছুটে আসেন বন্ধু দিলীপকুমার রায়ের কাছে নজরুলকে উদ্ধারের জন্য। নজরুলের মতো কবিপ্রতিভা, নজরুলের মতো স্বদেশপ্রেমিককে কোনওভাবেই কোনও বিপরীত পরিবেশে যেন ছেড়ে দেওয়া না যায় -এই ছিল নেতাজির মনোভাব। বিখ্যাত নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায় মূলত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও কাজি নজরুল ইসলাম উভয়েরই বন্ধুস্থানীয়। তাঁর মাধ্যমেই নজরুল ও নেতাজির সাক্ষাৎ ঘটে। এ প্রসঙ্গে ‘আমার বন্ধু সুভাষ’ গ্রন্থে দিলীপকুমার রায় বলেন- ‘কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি তার দরদ আর কৃতজ্ঞতা ছিল অতুলনীয়। ---হঠাৎ আমার আয়োজিত এক সাহায্যানুষ্ঠানে ওদের দু’জনের দেখা হয়ে গেল। নজরুল তাঁর বিখ্যাত গানটি গাইলেন; ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার?’ কয়েকদিন পরে সুভাষ এলো আমার কাছে। কোনও ভূমিকা না করে’ সোজাসুজি সে বলল- ‘দেখো দিলীপ, আমি এসেছি কাজী নজরুলের জন্যে।’ তাঁদের বিদ্রোহী সত্তা আমাদের হৃদয়ে-মমনে-চিন্তায়-চেতনায় ঝঙ্কার তোলে।
নজরুলের কাব্যে তিনটি সুস্পষ্ট ধারা লক্ষ্য করা যায়- বিদ্রোহী ভাবনা, প্রেম ভাবনা, শিশুবিষয়ক বা শিশুসুলভ ভাবনা। বিদ্রোহী ভাবনামূলক কবিতা বা কাব্যের উল্লেখ আগেই করেছি। আর প্রেমভাবনামূলক কাব্যের মধ্যে পাওয়া যায় ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘পূবের হাওয়া’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘চক্রবাক’ প্রভৃতি। তাঁর শিশুবিষয়ক কবিতা ও কাব্যের মধ্যে আছে ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্য, ‘সঞ্চয়ন’ কাব্যের কয়েকটি কবিতা, ‘সাত ভাই চম্পা’ নামক অসম্পূর্ণ কবিতা, ‘শিশু যাদুকর’ কবিতা এবং ‘ছায়ানট’ কাব্যের ‘চিরশিশু’ কবিতা প্রভৃতি। বাংলা সাহিত্যের সুপরিচিত বিদ্রোহী কবির অন্য রূপটিকে খুঁজে নেব আমাদের বর্তমান আলোচনায়।
নজরুল প্রতিভা ছিল বহুমুখী। কাব্য, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক বিচিত্র ধারায় তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছে। কবিতা এবং গীতিগুলো এদের মধ্যে সর্বাধিক ঔজ্জ্বল্যে প্রকাশমান। কাব্যক্ষেত্রে প্রধানত তিনি বিদ্রোহী কবিরূপে সুবিদিত হলেও তাঁর কাব্য-কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং সরল নিষ্পাপ শিশু হৃদয়ের অমিলন আবেগিক সুর আমাদের আপ্লুত করে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের ‘ঝিঙে ফুল’, ‘খোকার খুশি’, ‘চিঠি’, ‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খুকি ও কাঠবেরালি’, ‘খাঁদু-দাদু’, ‘প্রভাতী’, ‘লিচুচোর’ প্রভৃতি কবিতা আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে থাকে। কবিতাগুলো পাঠ করতে করতে যেন নিজেদের শৈশবের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলোকে চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখি। আমরা নস্টালজিক হয়ে যাই। ফিরে তাকানোর সুযোগ পাই বহু বছর আগে ফেলে আসা আপন আপন শৈশব আঙিনায়। ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যের শিশুবিষয়ক কবিতার আলোচনায় প্রথমেই কাব্য শিরোনামাঙ্কিত ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতাটিকে ছুঁতে চাই। কবিতাটিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনায় কবিহৃদয়ের অপরূপ স্বচ্ছ প্রকাশ ঘটেছে। সবুজ পাতার দেশে ঝিঙে ফুলের বর্ণনায় কবি বাণী রূপদান করেছেন এভাবে-‘গুল্মে পর্ণে/লতিকার কর্ণে/ঢল ঢল স্বর্ণে/ঝলমল দোলে দুল-/ঝিঙে ফুল।’
কবির কাব্যিক অভিব্যক্তিকে লতিকার কর্ণে ঝিঙে ফুলের দুল দুলছে। ছেলেবেলায় খেলার সাথীদের সঙ্গে কানে ঝিঙে ফুলের দুল পরা, কপালে সোনালি পোকার টিপ পরা আর পায়ে পুঁই বীচির আলতা পরা খোকা-খুকির দৃশ্য মুহূর্তেই চোখের সামনে হাজির হয়। আবার, পরবর্তী স্তবকে কবি যখন বলেন- ‘পউষের বেলা শেষ/পরি’ জাফরানী বেশ/ মরা মাচানের-শ্যামলী মায়ের কোলে সোনামুখ খুকুরে’,/আলুথালু ঘুমু যাও রোদে গলা দুকুরে।’ বেলা শেষে দুপুরের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে শিশুদের কোলাহলে যেমন পাড়া মশগুল হয়ে ওঠে, তেমনি জাফরানি বেশ পরিহিত ঝিঙে ফুল মরা মাচানের দেশকে মশগুল করে তোলে। সারা বেলা খেলা করে ক্লান্ত শিশুদের আলুতালু বেশে মায়ের কোলে ঘুমে এলিয়ে পড়ার ছবিও উপরিউক্ত পঙ্ক্তিগুলোতে সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। এভাবে প্রকৃতির অনুষঙ্গকে কবি শিশুর ক্রিয়ামন রূপদান করে অভিনবতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
প্রকৃতি আর মানুষের মেলবন্ধন এ কাব্যের অন্যান্য কবিতায়ও প্রস্ফুটিত হয়েছে শিশুসুলভ ভাব-ভঙ্গি-অনুভূতি ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। খুকি পেয়ারা খেতে ভালবাসে। কাঠবেরালির কাছে পেয়ারা চায়। কিন্তু যখন পেয়ারা পায় না তখন রাগ করে তাকে ‘হুতোম চোখী’ বলে গালি দেয় এবং কাঠবেরালির পেটে পিলে হবে জানিয়ে দেয়। এবারও যখন খুকির কার্যসিদ্ধি হয় না তখন সে কাঠবেরালির পেটে একটা পোকা ঢুকে যাওয়ার কমনা করে। ছোট শিশু তখন হিংসুটে হয়ে ওঠে। পরক্ষণেই আবার- ‘আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!’ বলে আবেদন জানায়। এমনকি সে কাঠবেরালিকে তার ছোড়দি, বৌদি, রাঙাদিদি হওয়ার লোভ দেখায়। তার লজ্জা নিবারণের জন্য ফ্রক-জামা নেবার প্রস্তাব দেয়। এভাবে শিশুসুলভ বিচিত্র মানসিকতার প্রকাশ কবিতাটিকে নজরুলের শিশুবিষয়ক কবিতার মধ্যে একটি বিশিষ্ট কবিতা বলে চিহ্নিত করেছে। কবিতাটি রচনার বাস্তব ভিত্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুজফ্ফর আহমদ বলেছেন- ‘এর রচনার জায়গা কুম্মিলা। --- এর রচনার পেছনে যে ঘটনাটি ঘটেছিল, নজরুল তা আমাদের বলেছিল। সে একদিন দেখতে পেল যে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের শিশু কন্যা জটু যার ভালো নাম অঞ্জলি সেন একা একা কাঠবেরালির সঙ্গে কথা বলছে। তা দেখেই সে কবিতাটি লিখে ফেলে। এই কবিতার ‘রাঙা দা’ হচ্ছেন বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, বৌদি তাঁর স্ত্রী, আর ছোড়দি বীরেন সেনের বোন কমলা দাশগুপ্তা। ‘রাঙা দিদি’ মানে প্রমীলা দাশগুপ্তা, পরে নজরুল ইসলামের স্ত্রী।’ (কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিকথা)
বেড়াতে যাওয়া, নিজেদের পছন্দমতো খাওয়া-পরা, বিয়ে উপলক্ষে বিশেষ মনোভাব, গল্প শোনা বা গল্প বলা ইত্যাদি শিশুদের বিচিত্র আনন্দের বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে নজরুলের ‘খোকার খুশি’, ‘দিদিও বে’তে খোকা’, ‘খোকার বুদ্ধি’, খোকার গল্প বলা’ প্রভৃতি কবিতা। মামার বিয়েতে সারাদিন মন্ডা গজা খেতে পারা যাবে বলে খোকার মনে আনন্দের সীমা নেই। শিশুচিত্তের এই সরলতা ও আনন্দ উপলব্ধি করতে করতে পাঠকও শিশুর সঙ্গে মিশে যান অনায়াসে। ভিন্নস্বাদের একটি কবিতা আমরা পাই আলোচ্য কাব্যে। কবিতাটি হলো ‘খাদু-দাদু’। দাদুর খ্যাঁদা নাক দেখে শিশুর মনে যে-সব প্রশ্ন উদয় হয়েছে, সে সবই সে তার মাকে জিজ্ঞাস করেছে কবিতাটিতে। দাদুর নাক দেখে তার হাসির উদ্রেক হয় এবং ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা প্রসঙ্গে তুলে ধরে। প্রথমেই সে তার মাকে জিজ্ঞাস করে- ‘অ’মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?’ দাদু চিনাম্যান নাকি চাংচু? নাক দিয়ে নানা ব্যঙ্গ করতে তার ভাল লাগে। কখনও সে দাদুর খ্যাঁদা নাককে বুড়ো গরুর পিঠে কোলে ব্যাঙের শুয়ে থাকার সঙ্গে তুলনা করেছে, কখনও উপুড় হয়ে ঠ্যাং ছড়ানো কাছিমের সঙ্গে তুলনা করেছে, কখনও জাপানি নোটিশ আঁটা দেখতে পেয়েছে। দাদুর এই ‘ডেঙাডেং ডেং’ নাক তার কাছে বেশ কৌতুকের হয়ে উঠেছে।
ছোট শিশু দাদুর নাক নিয়ে শুধু কৌতুক করেই ক্ষান্ত হয়নি, সম্পর্কেও রসিকতাটুকুও কবিতায় প্রয়োগ করেছে। তাই দাদুর অমন বাদুড় নাকে সাত-সাতটা শাঁখ বাজার শব্দ শুনে দিদিমাই নাকি দাদুর নাকে থ্যাবড়া মেরে ধ্যাবড়া করে দিয়েছেন কিংবা গজাল ঠুকে বাঁকা নাকের কাঁখ ভেঙে দিয়েছেন-এসবের উল্লেখ করে। দাদু-দিদিমার সঙ্গে নানি-নাতির সম্পর্কেও ¯েœহসুলভ রসিকতায় তাই শিশু হেসে কুটি কুটি হয়। তাই কবিতাটির ছয়টি স্তবকের শেষ পঙ্ক্তিতেই আছে- ‘অ’মা! আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং।’ এভাবে সমস্ত কবিতাটিতেই শিশুসুলভ বৈচিত্র্যতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
তাঁর শিশুবিষয়ক অপর একটি বিখ্যাত কবিতা হলো ‘প্রভাতী’। ভোর হয়েছে-প্রভাতকালীন সৌন্দর্যে চারদিক আলোকিত ও মুখরিত। এই পরিবেশে খুকুমণিকে ওঠার জন্য আহ্বান করছেন কবি। সূর্য হামা দিয়ে আসছে দেখে দারোয়ান ‘রামা হৈ গান গেয়ে চলছে। পাখিরা নীড় ত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে এসে উড়তে শুরু করেছে। তাদের গানে ভোরের আকাশে-বাতাসে-পুষ্পে দোলা লেগেছে। মাঝিরা প্রভাতী হাওয়ায় পাল তুলে তরী নিয়ে চলছে আর এমন সময় খুকু চোখ খুলে ওঠে বসল। কবি বলেছেন- ‘আলসে/নয় সে/ ওঠে রোজ সকালে,/রোজ তাই/চাঁদা ভাই/টিপ দেয় কপালে!’ শিশুদের কপালে চাঁদ মামা বা চাঁদা ভাইয়ের টিপ পরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সত্যিই আনন্দের। কবির বর্ণনায় শিশুদের আনন্দ-কোলাহলের মধ্যে কে আগে উঠেছে নিয়ে কলরবও ধ্বনিত হয়। আলস্য ত্যাগী খুকুরা তারপর হাত-মুখ ধুয়ে সৃষ্টিকর্তার জয়গান করে। তাঁকে তুষ্ট করে বর প্রার্থনা করার জন্য কবি বলে দেন। এভাবে কবিতাটিতে দিনের শুরু প্রভাত এবং মানবজীবনের শুরু শৈশবের অমলিন সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে। স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতাটি শিশুদের ভাব-ভাষা-আবেগ-আনন্দকে প্রকৃতির মধ্যে সৌন্দর্য ও সাজুয্য দান করেছে। কবিতার- ‘রবি মামা/দেয় হামা/গায়ে রাঙা জামা ঐ।’ পঙ্ক্তিগুলোর আলঙ্কারিক আলোচনার মধুসূদন বসু বলেন- ‘সূর্যের উপর শিশুর ন্যায় ব্যবহার আরোপ করায় এখানে সমাসোক্তি অলঙ্কার হয়েছে প্রভাতকালীন সূর্য যেন লাল জামা পরে শিশুর ন্যায় হামা দিয়ে চলেছে। অলঙ্কার প্রয়োগ এখানে শিশু-বিষয়ক কবিতার পক্ষে সম্পূর্ণ উপযোগী হয়েছে।’ (ঝিঙে ফুল) দেখা যায়, ছন্দ, অলঙ্কার, ভাব, ভাষা, আবেগ, অনুভূতি, রূপ, রস, প্রকৃতি, মানুষ সব মিলিয়ে কবিতাটি অনবদ্য।
বুদ্ধিমত্তা, দুষ্টুমি, অভিমান, লাঞ্ছনা এবং শিশুসুলভ ক্রিয়ার এক উল্লেখযোগ্য কবিতা এ কাব্যের ‘লিচুচোর’ কবিতাটি। অন্যের বাড়ির আম গাছ, জাম গাছ, কুল গাছ, লিচু গাছের দিকে কার না চোখ গিয়েছিল শিশুবেলায়। গাছ যখন ফলে ফলে ভরে যেত তখন সেখান সেখান থেকে চুরি করে খাওয়ার অদম্য স্পৃহা আগেকার শিশুদের তাড়না করত। বর্তমান যুগের শিশুদের শৈশব চুরি করে নেওয়া হয়েছে বলে তারা আর লিচু চুরি, আম চুরি এমনকি ফুল চুরির চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু নজরুলের ‘লিচুচোর’ কবিতায় আমরা যে শিশুচরিত্রকে পাই সে তৎকালীন বাংলার প্রতিটি ঘরের শিশু। বাবুদের তালপুকুরের ধারে লিচু চুরি করতে গিয়ে তাকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। হাতে কাস্তে নিয়ে লিচু গাছের উপর উঠে ছোট একটি ডাল ধরে টান দিতেই সজোরে নীচে পড়ে যায়। বাগানের মালি তখন তাকে ‘ধুমাধুম গোটা দুচ্চার’ কিল-ঘুসি লাগায়। এদিকে, শিশুও পরিস্থিতি সামাল দিতে মালিকে থাপড় দিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু পরিত্রাণ পায়নি, তাকে তাড়া করে হাবুদের ডাল-কুকুরে। ‘বাবা গো মা গো’ বলে পাঁচিলের ফোঁকল গলে বোসদের ঘরে আশ্রয় নেয় সে। অতঃপর সে যেন প্রাণ ফিরে পায় দেহে। তখন নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজেই কান মলে। আর কোনও দিন চুরি করতে যাবে না বলে মনে মনে শপথ করে। কিন্তু লিচুগুলোকে তো ভোলা যায় না, আবার আসছে সপ্তাহে যাবে নাকি! কিন্তু পরক্ষণেই ‘তৌবা’, তৌবা’ বলে নাকে খপতা দেয়। এভাবে শিশুর সরলতার এবং মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় কবিতাটিতে। অতএত বলা যায়-
‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যের কবিতাগুলো শিশুদের উপযোগী করে রচিত।’ ২০ নজরুল কাব্যে বিদ্রোহ ভঙ্গী ও বিদ্রোহ বর্জিত ভঙ্গী এবং এই কবিতাগুলোর অধিকাংশই ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে কবি শুধু চলিত ভাষাই ব্যবহার করেছেন। এ কাব্যের কবিতাগুলো ছাড়াও তিনি শিশুদের লক্ষ্য করে অন্যান্য কবিতাও রচনা করেছেন। তাঁর ‘শেষ সওগাত’ কাব্যের ‘অমৃতের সন্তান’ কবিতাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং তত্ত্ববহ। এ কবিতাটির আলোচনা করতে গিয়ে আলোচক বলেছেন- ‘নজরুলের ‘অমৃতের সন্তান’ ও উপনিষদের ঋষির ‘অমৃতস্য পুত্রা’ একই কথা। এখানে তিনি উপনিষদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ‘অমৃতের সন্তান’ কবিতায় তিনি বলেছেন যে, বৈজ্ঞানিকরা নীহারিকালোকের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি লয়ে তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু তিনি তাকিয়া আছেন শিশুদের দিকে। কেননা তিনি তাদের মধ্যে বিস্ময়কর শক্তির অভ্যুত্থানের সম্ভাবনায় বিশ্বাসী।’ ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যের কবিতায় এবং অন্যান্য শিশুবিষয়ক কবিতায় বিদ্রোহী কবি নজরুলের অন্য এক রূপের সন্ধান পেয়ে থাকেন সচেতন এবং অনুসন্ধানী পাঠক মহল। নজরুলচর্চার ক্ষেত্রে এটি একটি উজ্জ্বল ও মহিমময় দিকও বটে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন