সর্বকালের সেরা মহামানব মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ (সা.) যেভাবে রোজা পালন করেছেন তার উম্মতদেরও সেভাবেই রোজা পালন করতে হতে। তাই প্রতিটি মুসলমানকে জেনে রাখা দরকার কিভাবে হুজুর (সা.) রোজা পালন করেছেন। রাসুল (সা.) রমজানের জন্য দু’মাস আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতেন। রজবের চাঁদ দেখে তিনি বার বার রমজান পর্যন্ত পৌঁছার দোয়া করতেন। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রজব মাস শুরু হলে রাসুল (সা.) এই দোয়া পড়তেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবিও ওয়া শা’বান। ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’ অর্থ- ‘হে আল্লাহ আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করে দিন। আর আমাদেরকে রমজান মাস পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ (নাসায়ি) এভাবেই রজবের প্রতিটি দিন রমজানের প্রার্থনায় সিক্ত হত রাসুল (সা.)-এর নূরানী চোখদ্বয়।
রমজানের প্রস্তুতির জন্য শাবান থেকেই নফল রোজা শুরু করতেন প্রিয়নবী (সা.)। হজরত আয়শা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে শাবান মাস ছাড়া আর কোন মাসেই এত বেশি নফল রোজা রাখতে দেখিনি। (বুখারি।) তিনি (সা.) সাহবিদেরও রোজার প্রস্তুতির জন্য উৎসাহ দিতেন। হজরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) কোন একজনকে বলছিলেন, হে অমুকের পিতা! তুমি কি শাবান মাসের শেষ দিকে রোজা রাখনি? তিনি বললেন, না। রাসুল (সা.) বললেন, তাহলে তুমি রমজানের পরে দুটি রোজা পূর্ণ কর। (বুখারি।)
রমজানের ঠিক আগে আগেই রাসুল (সা.) রমজানের ফজিলত এবং বরকত সম্পর্কে সাহাবিদের জানিয়ে দিতেন। এ সম্পর্কে অনেকগুলো হাদিসের মধ্যে একটি হাদিস উল্লেখ করছি। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজান বরকতময় মাস। এ মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে এমন একটি মহিমান্বিত রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রষ্ঠ।’ (মুসলিম।) বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় রাসুল (সা.) চাঁদ দেখে রোজা শুরু করতেন। হাদিসের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, কেউ এসে তাকে চাঁদের সংবাদ দিলে তিনি তা ঘোষণা করার অনুমতি দিতেন। তিনি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ এবং চাঁদ দেখেই রোজা ছাড়। (বুখারি।)
জাকজমকহীন অনাড়ম্বর রোজা পালন করতেন রাসুল (সা.)। নবীজী (সা.) এর সাহারি ও ইফতার ছিল সাধারণের চেয়েও সাধারন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) কয়েকটি ভেজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। ভেজা খেজুর না থাকলে শুকনো খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। ভেজা কিংবা শুকনো খেজুর কোনটাই না পেলে কয়েক ঢোক পানিই হত তাঁর দিয়ে ইফতার।’ (তিরমিজি।) রাসুল (সা.) সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করতে পছন্দ করতেন। ইফতারে দেরি করা তিনি পছন্দ করতেন না। তেমনিভাবে রাসুল (সা.) এর সাহারিও ছিল খুব সাধারণ। তিনি (সা.) দেরি করে একেবারে শেষ সময়ে সেহরি খেতেন। সেহরিতে তিনি দুধ ও খেজুর পছন্দ করতেন। সেহরিতে সময় নিয়ে কঠোরতা করা তিনি (সা.) পছন্দ করতেন না।
অন্যান্য সময়ের চেয়ে রমজানে রাসুল (সা.) এর ইবাদতের পরিমাণ বেড়ে যেত। বুখারির বর্ণনা অনুযায়ী তিনি (সা.) প্রবাহিত বাতাসের মত দান করতেন। রমজানে রাসুল (সা.) জীবরাইল (আ.) কে কোরআন শুনাতেন। আবার জীবরাইল (আ.) হজরত (সা.)কে কোরআন শুনাতেন। রমজানের রাতে তিনি (সা.) খুব কম সময় বিশ্রাম নিয়ে বাকি সময় নফল নামাজে কাটিয়ে দিতেন। নির্ভযোগ্য হাদিস থেকে জানা যায়, রাসুল (সা.) তিনদিন সাহাবিদের নিয়ে ২০ রাকাত সালাতুত তারাবি পড়েছেন। চতুর্থ দিন থেকে তিন ঘরে আর সাহাবিরা বাইরে নিজেদের মতো নামাজ পড়তেন। খলিফা ওমর (রা.) এর সময় জামাতে তারাবি পড়ার প্রচলন হয়। আমাদের দেশে রমজান এলেই তর্ক বিতর্ক শুরু হয়ে যায়, যা মোটেই কাম্য নয়। তারাবি সুন্নাত নামাজ। আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হারাম। সমাজে ফেতনা সৃষ্টি করার অধিকার আমাদের কারো নেই।
শেষ দশ দিন ইতিকাফ করা রাসুল (সা.) এর নিয়মিত সুন্নাত ছিল। ইতিকাফে কদরের রাত তালাশ করাই মূল উদ্দেশ্য। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, শেষ দশকে আমাদের মসজিদগুলো মুসল্লিশূন্য থাকে। রাসুল (সা.) শাওয়ালের চাঁদ দেখে রোজা ছাড়তেন। একাধিক হাদিস থেকে জানা যায়, শাওয়ালের পহেলা রাত খুবই বরকতময়। এ রাতে রাসুল এবং সাহাবিরা এবাদত বন্দেগী করে কাটিয়ে দিতেন। আমাদেরও উচিত ইবাদতময় জীবন গড়ে তোলা।
রমজানকে স্বাগতম জানিয়ে প্রিয়নবীর (সা.) ভাষণ
মাহে রমজানকে স্বাগতম জানিয়ে মহানবী হযরত মুহম্মদ মোস্তফা (সা.) বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন বিশুদ্ধ হাদিসের কিতাবে তা সংগৃহীত রয়েছে খুব নিখুঁতভাবে। পাঠকদের জন্য মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে মহানবী (সা.) এর ঐতিহাসিক ভাষণটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
বিশিষ্ট সাহাবি হযরত সালমান ফারসি (রা.) হুজুর (সা.) এর ভাষণটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একবার শাবান মাসের শেষ দিন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্য এক গুরুগম্ভীর ভাষণ প্রদান করলেন। ওই ভাষণে প্রিয়নবী (সা.) বলেন, হে লোক সকল! তোমাদের উপরে এক মহান মাস! এক কল্যাণময় মাস! ছায়া বিস্তার করছে। এটা এমন এক মাস, যাতে এমন একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য এ মাসের রোজাকে ফরজ করেছেন এবং রাতে (সালাতুত তারাবি) নামাজ পড়াকে নফল করেছেন। যে ব্যক্তি এ মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় একটি সুন্নাত বা নফল কাজ করবে, আল্লাহ তাকে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করার সমান সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ পালন করবেন, অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ পালনের সওয়াব তার আমলনামায় আল্লাহতায়ালা লিখে দিবেন।
এটা পরস্পরিক সহানুভূতির মাস। এটা ঐ মাস যাতে মুমিন ব্যক্তির রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ মাসে যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে ইফতার করাবে এটা তার পক্ষে তার গুনাহ সমূহের জন্য ক্ষমা স্বরুপ হবে এবং তার নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। আর তাকে রোজাদারের সমান সাওয়াব দান করা হবে এতে তার সাওয়াব হতে কিছুই কমানো হবেনা।
হাদীস বর্ণনাকারী বলেন, আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি এমন সামর্থ রাখে না যা দ্বারা রোজাদারকে ইফতার করাতে পারে। তখন রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা এ সাওয়াব ঐ ব্যক্তিকেও দান করবেন যে কোন রোজাদারকে এক ঢোক দুধ দ্বারা, একটি খেজুর দ্বারা অথবা এক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করাবে। যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পরিতৃপ্তির সাথে ভোজন করায় আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউজ কাউসার হতে পানীয় পান করাবেন। ফলে জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত সে কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না। এটা এমন একটি মাস যার প্রথম অংশ রহমত, মধ্য অংশ ক্ষমা আর শেষ অংশ জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভের মাস। যে ব্যক্তি এ মাসে নিজের অধিনন্তদের কর্মভার হালকা করে দিবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দিবেন এবং তাকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দান করবেন। (বায়হাকি শরিফ এবং মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নম্বর : ১৮৬৮।)
এ হাদিসে প্রিয়নবী (সা.) রমজানের মাহাত্ম্য সম্পর্কে বলেছেন যেনো তার উম্মত রোজা সম্পর্কে আরো বেশি আগ্রহী এবং উদ্যমী হয়। আমরা যেনো বেশি বেশি সুন্নাত-নফল এবং ফরজ ইবাদত করে মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিল করতে পারি- এ বিষয়ে আমাদের আরো বেশি যত্মশীল হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে মাহের রমজানের পূর্ণ ফয়েজ এবং বরকত দান করুন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন