রমজান হিজরি সনের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মাস, সবচেয়ে বেশি ফজিলতের মাস, সবচেয়ে বেশি সওয়াব অর্জনের মাস। আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ এক নেয়ামত স্বরূপ বান্দার জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার এই মাহে রমজান।
ব্যবসায়ী তার মৌসুম আসার আগে মনে মনে প্রস্তুতি নেয় যে, এ মৌসুমকে আমার কাজে লাগাতে হবে। অন্য কোনো কাজ, কোথাও বেড়ানো এবং ঘোরাঘুরি আমি বুঝি না। এই মৌসুমের সময় আমি ব্যবসা ছাড়া আর কিছু বুঝি না, রমজানের জন্যও এরকম মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। দুনিয়ার যত ঝামেলা আছে, রমজান আসার আগেই আমি সে সব ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যাব। অন্তত এতটুকু মুক্ত হয়ে যাব যে, রমজানের রোজা রাখতে এবং অন্যান্য ইবাদাত যেমন- তরাবীহ্ পড়া, কুরআন তেলাওয়াত করা ইত্যাদির জন্য কোনো বাধা না থাকে। সব বাধা আমি দূর করে নেব। রমজানের জন্য আগে থেকেই এরকম প্রস্তুতি নেওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শাবান মাসের চাঁদ ঠিকমতো গণনা করে রাখো।’ শাবানের কয় দিন যাচ্ছে আর কয়দিন রমজান আসতে বাকি আছে ঠিকমতো খেয়াল রাখ। রমজানের খাতিরে তোমরা এটা কর। সে জন্য প্রয়োজন প্রস্তুতি নেওয়ার। প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজেদের আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে রমজানের আগেই যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
সামাজিক প্রস্তুতি: সামাজিক পরিমন্ডলে রমজানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রতিবেশী ও সমাজের লোকজন একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে রমজানের বিভিন্ন ফজিলত ও ইতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করে। এ ব্যাপারে অন্যকে রোজার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা চাই। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় এ মাস আসার আগেই সামাজিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, যেন সমাজটাও হয় ইসলাম বান্ধব।
শারীরিক প্রস্তুতি: অনেকেই গ্যাস্ট্রিক বা এ জাতীয় অন্য কোনো অসুখের দোহাই দিয়ে রোজা পালন থেকে বিরত থাকতে চায়। এটা ঠিক না। এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। চিকিৎসার প্রয়োজন হলে আগেভাগেই সেরে নেওয়া দরকার। শারীরিকভাবে পরিপূর্ণ সুস্থতা অর্জনের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
পরিবারে প্রস্তুতি: পরিবারের সদস্যদের রমজানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে রোজার ফজিলতের হাদিস ও এর বিভিন্ন উপকারিতা তুলে ধরে খাবারের টেবিলে বা অন্য কোনো সুযোগ প্রতিদিন কিছু সময় ঘরোয়া আলোচনা হতে পারে। এ ব্যাপারে মাতা-পিতা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারেন। পরিবারে এমন একটি রুটিন করে নেওয়া প্রয়োজন, যাতে কাজের কারণে ইবাদাতে ব্যাঘাত না ঘটে। একটি মুহূর্তও নফল ইবাদাত, কুরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর জিকিরমুক্ত না হয়। তাই রমজান ও ঈদের কেনাকাটা আগেই সেরে নেওয়া উত্তম।
গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি: নিজের ভালোর জন্যই গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে। জাহান্নাম থেকে নিজেকে বাঁচাতে গুনাহগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর ছেড়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে দৃঢ়সংকল্প করে গুনাহর উপায়-উপকরণগুলো দূর করে ফেলতে হবে আগেই।
চাকুরীজীবীদের প্রস্তুতি: রমজান তো ভালো মানুষ হয়ে যাওয়ার ট্রেনিং কোর্স। চাকরিতে মালিককে না ঠকানো এবং ইবাদাত ছেড়ে নিজেও না ঠকার প্রশিক্ষণ নিতে হবে রমজানে। অনৈতিক কোনো অভ্যাস থাকলে তা ছেড়ে দেওয়ার দৃঢ়সংকল্প করতে হবে। কর্মব্যস্ততার ভেতরেও কীভাবে বেশি ইবাদাত করা যায়, তার পরিকল্পনা করা উচিত। অফিসের কাজের ফাঁকে ও অফিসে যেতে যে সময় রাস্তায় কাটে, সে সময়টুকু ইবাদাতে ব্যবহার করতে জিকির, মোবাইলে কুরআন তেলাওয়াতসহ বিভিন্ন ইসলামিক অ্যাপস চালু করে তা কাজে লাগাতে পারেন।
প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের প্রস্তুতি: প্রত্যেক মুসলমানেরই উচিত রমজানের প্রয়োজনীয় মাসায়েল জেনে নেওয়া। প্রয়োজনে রমজানের আগেই এ বিষয়ে কিছু পুস্তক কিনে নেওয়া যায়, যাতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও তা পড়তে পারে। ই‘তিকাফ করতে আগ্রহীরা এর জন্য প্রস্তুতি নেবেন আগে থেকেই। যারা কুরআন সহীহভাবে তিলাওয়াত করতে পারি না, তারা এই রমজানে কুরআন শিক্ষার জন্য চেষ্টা করতে পারি।
ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি: ঈমানদারদের বেশি সওয়াব অর্জনের প্রতীক্ষার বিপরীতে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রস্তুতি নিতে থাকেন গণমানুষকে ঠকিয়ে লাভ করার। ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যরে প্রশিক্ষণের মাস রমজানে ভ্রাতৃঘাতী ও নির্মমতার চর্চা করেন তাঁরা। মজুদকরণ বা অপকৌশলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে ‘বড়লোক’ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হন। তাঁদের লুটের মনোভাবের কারণে বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম। চাল, ডাল, ছোলা, চিনি, ভোজ্য তেল, খেজুর ইত্যাদির দাম হয় গগণচুম্বী। একজন মুসলমান ব্যবসায়ীর রমজান কেন্দ্রিক এমন প্রস্তুতি হতে পারে না। কারণ পণ্য মজুদকরণের মাধ্যমে দাম বাড়ালে সে ব্যবসায়ীর প্রতি আল্লাহ তা’আলা ক্ষুব্ধ হন এবং সম্পর্ক ছিন্ন করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্য মজুদ রাখল সে আল্লাহর কাছ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল, আল্লাহ নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে’ (মুসনাদে আহমাদ: ৮/৪৮১)।
পক্ষান্তরে, যারা মজুদদারী না করে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করল, এ ব্যবসা পরিণত হবে ইবাদাতে। তার উপার্জন আল্লাহ তা’আলা বরকতময় করে দেবেন। তাকে অপ্রত্যাশিত রিজিক প্রদান করেন। রাসূল (সা.) বলেন, ‘খাঁটি ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয় আর মজুদকারী অভিশপ্ত হয়’ (ইবনে মাজাহ্: ২/৭২৮)। তাই দুনিয়ার রিজিকে বরকত পাওয়ার পাশাপাশি হাশরের ময়দানেও পুরস্কৃত হবে। তাকে প্রদান করা হবে নবীগণের সঙ্গী হওয়ার পরম সৌভাগ্য। রাসূল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীদের হাশর- নবীগণ, সিদ্দিগণের সঙ্গে হবে’ (তিরমিজি: ৩/৫১৫)।
রমজানের আর্থিক প্রস্তুতি: রমজান আর্থিক ইবাদাতেরও এক অপূর্ব সুযোগ। এ মাসে দৈহিক ইবাদাতের মতো আর্থিক ইবাদাতেও সওয়াব বেশি। আত্মীয়-স্বজনের কাছে ইফতারসহ নিত্যপণ্য কিনে পাঠানোর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। রাসূল (সা.) বলেন, ‘কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করালে সে উক্ত রোজাদারের সমান সওয়াব পাবে। তবে এতে সে রোজাদারের সওয়াব একটুও কমবে না’ (তিরমিজি: ৩/১৭১)। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত রমজানকেন্দ্রিক আর্থিক একটা পরিকল্পনা করা। কিছু টাকা জমিয়ে তা দিয়ে অভাবী প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়-স্বজনের ঘরে যেন কিছু ইফতার ও খাদ্যসামগ্রী পাঠানো যায়। যাদের উপর যাকাত ফরজ, তাদের আগে থেকেই রমজান কেন্দ্রিক যাকাতের পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।
আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানে রোজা ও ইবাদাত বন্দেগী করে তাঁর নৈকট্য অর্জনের জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণের তাওফিক দান করুন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন