শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খোশ আমদেদ মাহে রমজান সংখ্যা

অমুসলিমদের রোজা রাখার পাঁচটি সাম্প্রতিক ঘটনা

সৈয়দ ইবনে রহমত | প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম রোজা। তাই রমজান মাসে সুবেহ সাদিকের পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার না করাসহ ইসলামি বিধান মতে রোজা রাখা মুসলমানদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার’ (সুরা বাকারাহ: ১৮৩)। ইমানদারগণ মহান আল্লাহপাকের এই নির্দেশ যথাযথভাবে পালনও করেন এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু মুসলিম না হয়েও যখন কেউ রোজা রাখেন, তখন সেটা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। প্রশ্ন আসবে, যারা মুসলিম নন; আল্লাহ, আল্লাহর রাসুল, আল কোরান এবং সুন্নাহ’র ওপর যাদের বিশ্বাস নেই তারা কেন রোজা রাখবেন? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া হয়তো কঠিন। তবে অমুসলিম হয়েও যারা মুসলমানদের মতোই রোজা রাখেন তাদের অভিজ্ঞতার বয়ান থেকেই কিছুটা উপলব্ধি আসতে পারে। নিচে এমনই পাঁচটি সাম্প্রতিক ঘটনা তুলে ধরছি।

২০১৭ সালের রমজান মাসে প্রচারিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘৩৪ বছর ধরে রোজা রাখছেন হিন্দু বৃদ্ধা’। সংবাদের বিবরণে জানা যায়, ভারতের আমেদাবাদের জামালপুরের বাসিন্দা পরীবেন লেওয়া নিয়ম মেনে ৩০ দিনই রোজা পালন করতেন। কিন্তু এখন শারীরিক অসুস্থতার কারণে সে নিয়মে ছেদ পড়েছে। তিনি জানিয়েছেন, এবছর মাত্র তিনদিন তাঁকে রোজা রাখার অনুমতি দিয়েছেন চিকিৎসকরা। শুরুটা হয়েছিল ১৯৮২ সালে। সেবার নিজের ভাইয়ের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন ওই মহিলার স্বামী। মামলা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। তখন স্থানীয় একটি দরগায় গিয়ে মানত করেছিলেন, যদি মামলায় স্বামীর পক্ষে রায় হয়, তাহলে তিনি রোজা রাখবেন। সেবছরই মামলার রায় বেরোয় এবং তারা জয়ী হন। সেই থেকেই পরীবেন লেওয়ার রোজা রাখা শুরু। আর ২০১৭ সালের জুন মাসের প্রথমার্ধে যখন খবরটি গণমাধ্যমে আসে, তখন পরীবেন লেওয়ার বয়স চলছিল ৮৫ বছর। শুধু রোজা রাখা নয়, বরং স্থানীয় মুসলমান প্রতিবেশীদের সাথেও তার আন্তরিক সম্পর্ক আছে এবং মুসলমানদের যেকোনো আনুষ্ঠানিকতাতেও তিনি থাকার চেষ্টা করেন। এমনকি ইফতারিও আদান-প্রদান করেন তিনি।
দিল্লির তিহার কারাগার কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে ২০১৮ সালের ২৮ মে দ্য সিয়াশাত ডেইলির প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘কারাগারে রোজা রাখছেন হিন্দু বন্দিরা’। খবরের বিবরণে বলা হয়, তিহার কারাগারে বন্দি মুসলিমদের সঙ্গে রোজা রাখছেন হিন্দু বন্দিরা। ভারতের নয়া দিল্লির এই কারাগারে আটক ২ হাজার ৯শ ৯৯ জন মুসলিম বন্দি রোজা পালন করছেন। ওই মুসলিমদের সঙ্গে ৫৯ জন হিন্দু বন্দিও রোজা রাখছেন। রোজাদারদের জন্য বিশেষ ইফতারের আয়োজন করেছে জেল কর্তৃপক্ষ। ৪৫ বছর বয়সী এক হিন্দু নারী অপহরণের হামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বন্দি রয়েছেন তিহার কারাগারে। এই নারী জানিয়েছেন, বাইরে থাকা তার ছেলের কল্যাণের জন্য তিনি রোজা রাখছেন। আরেক কারাবন্দি হিন্দু নারী জানান, তিনি রোজা রাখছেন। কেননা তিনি আশা করছেন, এই রোজা পালনের মাধ্যমে খুব শিগগিরই মুক্তি পাবেন। ২১ বছর বয়সী অপর এক বন্দি জানান, তিনি মুসলিম সহ-বন্দিদের উপবাস ও তাদের সঙ্গে অংশ নিতে রোজা রাখছেন। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, সে বছরের ২৭ মে রোববার দিল্লির তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই প্রচন্ড গরমেও হিন্দু কারাবন্দিরা রোজা রেখেছেন!
মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদ মাধ্যম খালিজ টাইমসের বরাত দিয়ে ঢাকাটাইমস ২০১৬ সালের ১০ জুন প্রচারিত এক সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘৯ বছর ধরে রোজা রাখছেন অমুসলিম জ্যাসন’। খবরে বলা হয়, মালয়েশিয়ার নাগরিক জ্যাসন একজন ব্যায়াম প্রশিক্ষক। জ্যাসন লু জি সেংয়ের মা খ্রিস্টান এবং বাবা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। নয় বছর ধরে দুবাইতে আছেন। একজন অমুসলিম হওয়া সত্তে¡ও জ্যাসন প্রতি রমজানেই রোজা রাখেন। দুবাইতে আসার পরই দেশটির মনোমুগ্ধকর সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্য জানার চেষ্টা করেন লু জি সেং। ইসলাম সম্পর্কেও তার ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। জ্যাসনের বক্তব্য থেকে জানা যায়, ‘মালয়শিয়াও একটি মুসলিম দেশ। তাই আমি স্কুলে পড়া অবস্থায় রোজা রাখার চেষ্টা করতাম কিন্তু পারতাম না। কারণ আশেপাশের মানুষ এবং পরিবেশ থেকে তেমন অনুপ্রেরণা পেতাম না। কিন্তু দুবাইতে আসার পর রোজা রাখতে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা পেয়েছি। একজন ব্যায়াম প্রশিক্ষক হিসেবে রোজা রাখা আমার পক্ষে কঠিন হতে পারত। কিন্তু আমি নির্দিষ্ট ডায়েট, নিয়মিত শিডিউল এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করি। সারাদিন রোজা রাখার অভিজ্ঞতা আমার কাছে খুব ফলপ্রসূ মনে হয়। বিশেষ করে যখন ইফতারে পানিতে প্রথম চুমুকটা দিই তখন মনে হয় দুনিয়াটাই আমার।’
খালিজ টাইমসের বরাত দিয়ে ২০১৫ সালের ২৮ জুন ‘এক অমুসলিম জার্মানির রোজার অভিজ্ঞতা’ শিরোনামের খবরে জানা যায়, জার্মান নাগরিক স্টেফান হাটের রোজা রাখার অভিজ্ঞতার কথা। চাকরির সুবাদে তিনি সপরিবারে পাড়ি জমিয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে। মাত্র তিন মাস আগে আবুধাবিতে আসেন তিনি। পেশায় একজন ফাইনান্সিয়াল কনসালটেন্ট। আবুধাবির জীবনধারার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন। আর এর মধ্য দিয়ে রমজাম মাসে এসে যাওয়ায় তার জীবনের অভিজ্ঞতা ভিন্ন এক দিকে মোড় নেয়। প্রথমেই অনেকের কাছে প্রশ্ন করে জানার চেষ্টা করেন, রমজান মাসে কী কী করতে হবে আর কী কী করা যাবে না। কিন্তু এগুলো জানা আর তা পূর্ণাঙ্গ রূপে পালন করা পুরোই ভিন্ন একটি বিষয়। রোজার প্রথম সপ্তাহে নিরব স্থান খুঁজে বের করে পানিতে চুমুক দিয়েছেন স্টেফান। আর কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা জানালার পেছনে খোলা ক্যাফেগুলোতে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরেছেন। কিন্তু এর মধ্যেই এক সহকর্মী তার বাড়িতে স্টেফানকে ইফতারের দাওয়াত দেন। সহকর্মীদের কাছে জানতে চাইলেন, দাওয়াতে আতিথ্যকর্তার জন্য কোনো উপহার নিয়ে যাবেন কি না। তখন তারা তাকে জানান, সবথেকে সেরা যে উপহারটা দেয়া যায় তা হলো- যদি ওই দিন রোজা রেখে দাওয়াতে যাওয়া যায়। সেটাই সবথেকে আন্তরিকতার সঙ্গে প্রশংসিত হবে।
এরপর স্টেফান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে রোজা রাখার চেষ্টা করে দেখবেন। দাওয়াতে যাওয়ার আগের রাতে বেশ ভারী নৈশভোজ করলেন স্টেফান। পরদিন শুরু হলো তার জীবনের প্রথম রোজা। সকালে এক কাপ কফি না খাওয়া ছিল তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সকাল ১১টা বাজতেই গলা এতোটা শুকনো অনুভূত হলো যে কথা বলতেই কষ্ট হচ্ছিল। সময় যতো গড়াচ্ছিল ততই হাল ছাড়ার ইচ্ছা উঁকি দিচ্ছিল মনে। কিন্তু স্টেফান তার চারপাশে রোজা রাখা সহকর্মীদের দেখে অনুপ্রাণিত বোধ করলেন। ভাবলেন, তারা যদি পারে তাহলে আমিও পারবো। শেষ পর্যন্ত রোজা রেখেই ইফতারের আগ দিয়ে সহকর্মীর বাড়িতে পৌঁছালেন স্টেফান। সহকর্মী তাকে দেখে বললো, তোমাকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ‘আমি তাকে বললাম, আমি ক্লান্ত নই। আমি রোজা রেখেছি। এতে আমার ওই সহকর্মী অত্যন্ত বিস্মিত আর খুশি হলো। আমার সঙ্গে করমর্দন করলো। লক্ষ করলাম, তার চোখে প্রায় পানি চলে এসেছে। ওই দিন আমি একজন বন্ধু পেয়েছি।’ রোজা রাখার চ্যালেঞ্জ আর এর পুরস্কার স্টেফানের মনে গভীর দাগ কাটে। তাই সিদ্ধান্ত নেন পুরো রমজান মাসই তিনি রোজা রাখবেন।
কট্টর হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া এবং বামপন্থী রাজনীতির অনুসারী সঞ্জয় মিত্রের রোজার রাখার বিষয়টি তো আরো চমকপ্রদ। তিনি রোজা রাখেন প্রতিবাদ হিসেবে। তার রোজা রাখা নিয়ে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘২১ বছর ধরে রোজা রেখে সঞ্জয় মিত্রের অভিনব প্রতিবাদ’। সংবাদের বিবরণে বলা হয়, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে ২১ বছর যাবত ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মতো করে রোজা রাখছেন কট্টর হিন্দু পরিবারের সন্তান সঞ্জয় মিত্র। ইসলাম ধর্মের মতো করে রোজা রেখে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন এই বামপন্থী আদর্শের অনুসারী। ছোট বেলার অসংখ্য স্মৃতি, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার বিভৎসতা, অনেক বছর পরে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের হাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়া; দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা এসব ব্যাপার তার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল প্রতিবাদ হিসেবে। একেবারে ব্যক্তিগত প্রতিবাদ আর লজ্জা হিসেবে। তাই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরের বছর থেকেই মুসলমান বন্ধু আর প্রতিবেশীদের মতো রমজান মাস রোজা রাখতে শুরু করেন কলকাতার হিন্দু পরিবারের সন্তান সঞ্জয় মিত্র। তিনি বলেন, বাবরি মসজিদের ঘটনা ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২। আমি তারপর থেকেই রোজা রাখি। আমি তখন দিল্লিতে ছিলাম। আমার তখন নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছিল। তখন চিন্তা করলাম আর কিছু না পারি একক প্রতিবাদ আমি করেই যাব। তাই এই রোজা রাখা। এই ব্যপারে কেউ বাধা দেয় নাকি জানতে চেয়ে প্রশ্ন করা হলে মিত্র বলেন, আমার স্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করেছিল মুসলমানদের রোজা রাখ কিন্তু নিজের ধর্মের কিছু পালন করোনা কেন? তখন থেকে আমি চৈত্র মাসেও উপোস থাকি। কারণ মমসূত্র এগ্রিকাল্চার লেবার নামে হিন্দু জাতি আছে। যাদের চৈত্র মাসে কোনো খাবার থাকে না। তখন তারা খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে আর ভিক্ষে করে। আর যা পায় তা দিয়ে রাতে খায়। এখন আমি তো আর ভিক্ষে করতে পারবো না। তাই তাদের মতো উপোস থাকি।
ইউরোপেও অমুসলিমদের মধ্যে ইদানীং উপবাসে থাকার প্রবণতা বাড়ছে। তবে সেটি ঠিক মুসলমানদের রোজার মতো না, ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে গবফরপধষ ভধংঃরহম. এ প্রক্রিয়ায় সাধারণত রাতের খাবারের পর সকালের নাশতা বাদ দিয়ে একেবারে দুপুরে খেতে বলা হয়। এ ধরনের চেতনা সৃষ্টির পেছনে ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত প্রখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদ ড. হেলমুট লুটজানারের বই ঞযব ংবপৎবঃ ড়ভ ংঁপপবংংভঁষ ভধংঃরহম. (উপবাসের গোপন রহস্য) ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। বইটিতে লেখক মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালি বিশ্লেষণ করে নিরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরের কয়েকটি দিন উপবাস থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এর সাথে নতুন মাত্রা যোগ করেছে অটোফেজি প্রক্রিয়ার ক্রিয়া-কৌশল আবিষ্কার করার জন্য ২০১৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে জাপানের বিজ্ঞানী ইওশিনোরি ওসুমির নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। অটোফেজি মূলত গ্রিক শব্দ, যার বাংলা অর্থ হলো- ‘আত্মভক্ষণ’ বা নিজেকে খেয়ে ফেলা। এটি শরীরের আভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোকে পরিষ্কার করার একটা প্রক্রিয়া, যা সম্পন্ন হয় কোষীয় পর্যায়ে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন কাজ করার জন্য প্রতিনিয়ত প্রোটিন তৈরি বা সংশ্লেষ হয় এবং এ তৈরি হওয়া প্রোটিনের কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য তার (প্রোটিনের) গঠনটি অ্যামিনো এসিড দ্বারা ত্রিমাত্রিক হতে হয়। যদি ত্রিমাত্রিক গঠন না হয় তবে প্রোটিনটি শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হবে এবং তা নানা রোগের সৃষ্টি করবে। আর এই ক্ষতিকারক উপাদানগুলো কোষ তার নির্ধারিত জায়গায় আবদ্ধ করে রাখে। জমতে জমতে এর পরিমাণ বেশি হয়ে গেলেই এটা শরীরের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, সৃষ্টি করতে পারে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের। তবে মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকলে আমাদের দেহের কোষ তার মধ্যে জমা থাকা এসব ক্ষতিকারক প্রোটিন খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলে। ফলে নিরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম শরীর পেতে মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকার প্রবণতা যে বিশ্বব্যাপী আরো বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে, উপর্যুক্ত পাঁচটি ঘটনা ম্যাডিকেল ফাস্টিং বা অটোফেজির ধারণা থেকে উদ্ভূত নয়, বরং ইসলামি বিশ্বাস ও চিন্তাধারা থেকে উৎসারিত। তাই ঘটনাগুলো আমাদের মনে আলাদাভাবে দাগ কাটে। দুনিয়া জুড়ে এমন আরো অসংখ্য ঘটনাই হয়তো পাওয়া যাবে, দেখা যাবে নানা কারণে মুসলিম না হয়েও অনেকে মুসলিমদের মতোই রোজা রাখছেন। তাদের একেক জনের কাছে রোজা রাখার কারণটাও হয়তো একেক রকম। তবে যে কারণেই রোজা রাখুন না কেন, তারা কিন্তু ম্যাডিকেল ফাস্টিং বা অটোফেজির সুফল থেকেও বঞ্চিত হবেন না। কারণ আল্লাহপাক শুধুমাত্র আনুগত্য ও বিশ্বাসের জন্যেই রোজার রাখার নির্দেশ দেননি, বরং তিনি বলেছেন, ‘যদি রোজা রাখো তবে তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ, যদি তোমরা সেটা উপলব্ধি করতে পারো’ (সুরা বাকারাহ : ১৮৪)।

এরপর স্টেফান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে রোজা রাখার চেষ্টা করে দেখবেন। দাওয়াতে যাওয়ার আগের রাতে বেশ ভারী নৈশভোজ করলেন স্টেফান। পরদিন শুরু হলো তার জীবনের প্রথম রোজা। সকালে এক কাপ কফি না খাওয়া ছিল তার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সকাল ১১টা বাজতেই গলা এতোটা শুকনো অনুভূত হলো যে কথা বলতেই কষ্ট হচ্ছিল। সময় যতো গড়াচ্ছিল ততই হাল ছাড়ার ইচ্ছা উঁকি দিচ্ছিল মনে। কিন্তু স্টেফান তার চারপাশে রোজা রাখা সহকর্মীদের দেখে অনুপ্রাণিত বোধ করলেন। ভাবলেন, তারা যদি পারে তাহলে আমিও পারবো। শেষ পর্যন্ত রোজা রেখেই ইফতারের আগ দিয়ে সহকর্মীর বাড়িতে পৌঁছালেন স্টেফান। সহকর্মী তাকে দেখে বললো, তোমাকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ‘আমি তাকে বললাম, আমি ক্লান্ত নই। আমি রোজা রেখেছি। এতে আমার ওই সহকর্মী অত্যন্ত বিস্মিত আর খুশি হলো। আমার সঙ্গে করমর্দন করলো। লক্ষ করলাম, তার চোখে প্রায় পানি চলে এসেছে। ওই দিন আমি একজন বন্ধু পেয়েছি।’ রোজা রাখার চ্যালেঞ্জ আর এর পুরস্কার স্টেফানের মনে গভীর দাগ কাটে। তাই সিদ্ধান্ত নেন পুরো রমজান মাসই তিনি রোজা রাখবেন।
কট্টর হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া এবং বামপন্থী রাজনীতির অনুসারী সঞ্জয় মিত্রের রোজার রাখার বিষয়টি তো আরো চমকপ্রদ। তিনি রোজা রাখেন প্রতিবাদ হিসেবে। তার রোজা রাখা নিয়ে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘২১ বছর ধরে রোজা রেখে সঞ্জয় মিত্রের অভিনব প্রতিবাদ’। সংবাদের বিবরণে বলা হয়, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে ২১ বছর যাবত ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মতো করে রোজা রাখছেন কট্টর হিন্দু পরিবারের সন্তান সঞ্জয় মিত্র। ইসলাম ধর্মের মতো করে রোজা রেখে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন এই বামপন্থী আদর্শের অনুসারী। ছোট বেলার অসংখ্য স্মৃতি, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার বিভৎসতা, অনেক বছর পরে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের হাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়া; দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা এসব ব্যাপার তার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল প্রতিবাদ হিসেবে। একেবারে ব্যক্তিগত প্রতিবাদ আর লজ্জা হিসেবে। তাই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরের বছর থেকেই মুসলমান বন্ধু আর প্রতিবেশীদের মতো রমজান মাস রোজা রাখতে শুরু করেন কলকাতার হিন্দু পরিবারের সন্তান সঞ্জয় মিত্র। তিনি বলেন, বাবরি মসজিদের ঘটনা ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২। আমি তারপর থেকেই রোজা রাখি। আমি তখন দিল্লিতে ছিলাম। আমার তখন নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছিল। তখন চিন্তা করলাম আর কিছু না পারি একক প্রতিবাদ আমি করেই যাব। তাই এই রোজা রাখা। এই ব্যপারে কেউ বাধা দেয় নাকি জানতে চেয়ে প্রশ্ন করা হলে মিত্র বলেন, আমার স্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করেছিল মুসলমানদের রোজা রাখ কিন্তু নিজের ধর্মের কিছু পালন করোনা কেন? তখন থেকে আমি চৈত্র মাসেও উপোস থাকি। কারণ মমসূত্র এগ্রিকাল্চার লেবার নামে হিন্দু জাতি আছে। যাদের চৈত্র মাসে কোনো খাবার থাকে না। তখন তারা খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে আর ভিক্ষে করে। আর যা পায় তা দিয়ে রাতে খায়। এখন আমি তো আর ভিক্ষে করতে পারবো না। তাই তাদের মতো উপোস থাকি।
ইউরোপেও অমুসলিমদের মধ্যে ইদানীং উপবাসে থাকার প্রবণতা বাড়ছে। তবে সেটি ঠিক মুসলমানদের রোজার মতো না, ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে গবফরপধষ ভধংঃরহম. এ প্রক্রিয়ায় সাধারণত রাতের খাবারের পর সকালের নাশতা বাদ দিয়ে একেবারে দুপুরে খেতে বলা হয়। এ ধরনের চেতনা সৃষ্টির পেছনে ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত প্রখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদ ড. হেলমুট লুটজানারের বই ঞযব ংবপৎবঃ ড়ভ ংঁপপবংংভঁষ ভধংঃরহম. (উপবাসের গোপন রহস্য) ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। বইটিতে লেখক মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালি বিশ্লেষণ করে নিরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরের কয়েকটি দিন উপবাস থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এর সাথে নতুন মাত্রা যোগ করেছে অটোফেজি প্রক্রিয়ার ক্রিয়া-কৌশল আবিষ্কার করার জন্য ২০১৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে জাপানের বিজ্ঞানী ইওশিনোরি ওসুমির নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। অটোফেজি মূলত গ্রিক শব্দ, যার বাংলা অর্থ হলো- ‘আত্মভক্ষণ’ বা নিজেকে খেয়ে ফেলা। এটি শরীরের আভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোকে পরিষ্কার করার একটা প্রক্রিয়া, যা সম্পন্ন হয় কোষীয় পর্যায়ে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন কাজ করার জন্য প্রতিনিয়ত প্রোটিন তৈরি বা সংশ্লেষ হয় এবং এ তৈরি হওয়া প্রোটিনের কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য তার (প্রোটিনের) গঠনটি অ্যামিনো এসিড দ্বারা ত্রিমাত্রিক হতে হয়। যদি ত্রিমাত্রিক গঠন না হয় তবে প্রোটিনটি শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হবে এবং তা নানা রোগের সৃষ্টি করবে। আর এই ক্ষতিকারক উপাদানগুলো কোষ তার নির্ধারিত জায়গায় আবদ্ধ করে রাখে। জমতে জমতে এর পরিমাণ বেশি হয়ে গেলেই এটা শরীরের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, সৃষ্টি করতে পারে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের। তবে মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকলে আমাদের দেহের কোষ তার মধ্যে জমা থাকা এসব ক্ষতিকারক প্রোটিন খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলে। ফলে নিরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম শরীর পেতে মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকার প্রবণতা যে বিশ্বব্যাপী আরো বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে, উপর্যুক্ত পাঁচটি ঘটনা ম্যাডিকেল ফাস্টিং বা অটোফেজির ধারণা থেকে উদ্ভূত নয়, বরং ইসলামি বিশ্বাস ও চিন্তাধারা থেকে উৎসারিত। তাই ঘটনাগুলো আমাদের মনে আলাদাভাবে দাগ কাটে। দুনিয়া জুড়ে এমন আরো অসংখ্য ঘটনাই হয়তো পাওয়া যাবে, দেখা যাবে নানা কারণে মুসলিম না হয়েও অনেকে মুসলিমদের মতোই রোজা রাখছেন। তাদের একেক জনের কাছে রোজা রাখার কারণটাও হয়তো একেক রকম। তবে যে কারণেই রোজা রাখুন না কেন, তারা কিন্তু ম্যাডিকেল ফাস্টিং বা অটোফেজির সুফল থেকেও বঞ্চিত হবেন না। কারণ আল্লাহপাক শুধুমাত্র আনুগত্য ও বিশ্বাসের জন্যেই রোজার রাখার নির্দেশ দেননি, বরং তিনি বলেছেন, ‘যদি রোজা রাখো তবে তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ, যদি তোমরা সেটা উপলব্ধি করতে পারো’ (সুরা বাকারাহ : ১৮৪)।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন