যাই নেই কৃষি ডিপ্লোমার সনদ, নেই কোন কৃষিতে উচ্চতর ডিগ্রী, তিনি একজন সাধারণ কৃষক তিনি হলেন নূও মোহম্মদ। রাজশাহী থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দুরে তানোর উপজেলার গোল্লাাপাড়া বাজারে প্রবেশের আগেই রান্তাার ডানপাশে তাকালে ধানের ক্ষেতের মধ্যে দেখা মিলবে ছোট ছোট নাম্বারিং করা অনেক সাইনবোর্ড। আরো কাছে গিয়ে দেখা যাবে বেগুনি, সোনালী, সবুজ, খয়রী, মুড়িকালার, সাদাগুঠিসহ নানা প্রকারের ধানে ভরপুর ক্ষেত। তবে শুরুতেই যে কেউ দেখলে ভাববেন এটি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের কোন পর্দশনী প্লট। কিন্তু না। এটি গ্রামের প্রান্তিক কৃষক নূর মোহাম্মদের নিজস্ব ধান গবেষণার প্রদর্শনী প্লট। এ প্লটে চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে প্রায় ২৭ প্রকারের জাতের ধান সঙ্করায়নের মাধ্যমে নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন তিনি।
প্রান্তিক কৃষক নূর মোহাম্মদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো সনদ নেই, তবে তার আছে ধান নিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবন চিন্তা। সঙ্করায়ণ করে একের পর এক নতুন ধান উদ্ভাবন করছেন তিনি। স্বশিক্ষিত এই বিজ্ঞানীর কাজ আমলে নিয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরাও। ধানগুলো জাত হিসেবে স্বীকৃতির অপেক্ষায় রয়েছে।
কৃষক নূর মোহাম্মদ ধান বিজ্ঞানী হিসাবেই উপাধি পেয়েছে অত্র বরেন্দ্রঅঞ্চলে। এমনকি কৃষি সম্প্রাসারণ অফিসগুলোতেই তাকে বিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ নামেই চেনে। বাড়ি রাজশাহীর তানোর উপজেলার গোল্লপাড়া গ্রামে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। বরেন্দ্রভূমিতে প্রায় প্রতি বছরই খরায় নষ্ট হয়ে যায় ধান। সেই ধান রক্ষা করতেই কাজে লেগে যান তিনি। নিজের মাটির ঘরটাকে বানিয়ে ফেলেছেন হারানো ধানের গবেষণাগার।
নতুন ধান ও প্রায় বিলুপ্ত ধান মিলে নূর মোহাম্মদের কাছে সংরক্ষণ করা আছে এমন ধানের জাতের সংখ্যা ২০০টি। সর্বশেষ তিনি একটি নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। তার দাবি, দেশে প্রচলিত বোরো ধান বপন থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত ১৪০ দিন লাগে। তার উদ্ভাবিত এই ধান বোরো মৌসুমে বপন থেকে ১৩০ দিনের মধ্যে কাটা যাবে। তিনি খরাসহিষ্ণু এই ধানের সারির নাম দিয়েছেন ‘এনএমকেপি-১০৫’। এনএমকেপির অর্থ হচ্ছে ‘নূর মোহাম্মদ কৃষি পরিষেবা’। প্রথম দিকে তিনি এনএমটি অর্থাৎ ‘নূর মোহাম্মদ তানোর’ নামে ধানের নামকরণ করতেন।
নূর মোহাম্মদ জানান, চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে তার এক একর জমিতে ২৭ জাতের ধান সঙ্করায়ণের মাধ্যমে উদ্ভাবন করেছেন। এগুলো এখন পাক ধরেছে। কিছু কর্তন শুরু হয়েছে। এসব ২৭ জাতের ধানের শুধু নম্বর প্লেট দেয়া রয়েছে। ক্ষেতের এসব ধান কৃষি কর্মকর্তারা দেখে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করবেন। কোন কোন জাতকে স্বীকৃতির দেয়া হবে। স্বীকৃতির পরেই ধান জাতগুলোর নাম ও কৃষকের মধ্যে বীজ বিতারণ করা হবে।
নূর মোহাম্মদ জানান, তার যে ২৭ জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে এর মধ্যে পাঁচটি জাত স্বীকৃতি পাওয়ার মতো বলে মনে করেন তিনি। সেগুলো হচ্ছে এনএমকেপি-১ থেকে এনএমকেপি-৫ পর্যন্ত। তিনি দেশের প্রচলিত ধানের জাতকে উজ্জীবিত করে তার জীবনকাল কমিয়ে এনেছেন। কোনোটির ফলন বাড়িয়েছেন। খরাসহিষ্ণু জাতের উদ্ভাবন করেছেন।
সম্প্রতি তার প্রদর্শনী প্লটের ক্ষেতের কৃষক নূর মোহাম্মদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে ধান কর্তনের উদ্বোধন করেছেন তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, কৃষক নূর মোহাম্মদ বললে ভুল হবে, সে একজন কৃষি বিজ্ঞানী। তার নতুন নতুন উদ্ভাবন ধান জাত বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকের জন্য আর্শিবাদ বয়ে আনবে।
তিনি আরো বলেন, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটও এই জাতের আমন উদ্ভাবন করেছে, কিন্তু তারটা সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের। তিনি বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য উপযোগী করে এই ধান উদ্ভাবন করেছেন। এই ধান ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত বৃষ্টি না পেলেও খরা মোকাবিলা করে ভালো ফলন দিতে সক্ষম। এর ফলন বিঘায় ৩৫ থেকে ৪০ মণ পর্যন্ত হবে।
কৃষি কর্মকর্তা আরো বলেন, নূর মোহাম্মদের উদ্ভাবন করা ২৭ প্রকার ধান জাতের মধ্যে নির্বাচন করে বাছাই করা হবে। এর মধ্যে এনএমকেপি-১০৫ এর জাতটি সব চেয়ে সবার কাছে ভাল লেগেছে। এ ধানটি বিঘা প্রতি ফলন ৪০ মণ। এই ধানের বিশেষত্ব হচ্ছে, পাকার পরও পাতা সবুজ থাকে। গাছ মজবুত। খরাসহিষ্ণু। পোকামাকড় ও রোগবালাই অনেক কম। এটি রোপা আমন মৌসুমেও হয়। তখন জীবনকাল হয় ১১০ থেকে ১১৫ দিন। এ ধান বোরো মৌসুমে ৪০ মণ ও আমন মৌসুমে ২৮ মণ পর্যন্ত হয়। এই জাতের ধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরুর আগেই ঘরে তোলা যাবে। আগাম ওঠার কারণে ভালো বাজার মিলবে। চাল চিকন। ভাত খেতে ভালো।
কৃষি উৎপাদনে সাফল্যের জন্য নূর মোহাম্মদ ২০০৫ সালে পান রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক। সেরা কৃষি উদ্ভাবন ক্যাটাগরিতে তীর-প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার ২০১৮ পেয়েছেন এই কৃষিবিজ্ঞানী। তাকে নিয়ে তানোরের কৃষকেরা গর্ববোধ করেন। কৃষকদের দাবী নূর মোহম্মদকে সরকারীভাবে আথিক অনুদান দেয়া হলে তিনি কৃষিতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারবেন বলে তারা জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন